পাকিস্তান আমলে চা শিল্প এবং একজন আমীনূর রশীদ চৌধুরী

১৯৪৭ সালের পর এক নতুন যুগে প্রবেশ করে চা শিল্প। মালিকানার এক উল্লেখযোগ্য অংশ ব্রিটিশদের নিকট হতে পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতি শ্রেণির হাতে চলে যায়। এর অন্যতম প্রধান কারণ ছিল ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর পূর্ববাংলা এবং সিলেটের অনেক হিন্দু জমিদার ও পেশাজীবী সিলেট পরিত্যাগ করে ভারতে অভিবাসন নেন। তাঁদের অনেকেই পুঁজি বিনিয়োগ করেছিলেন চা শিল্পে। তাঁদের প্রস্থান এক ধরনের সংকট সৃষ্টি করে। এই শূন্যতা পূরণে যারা এগিয়ে আসেন তাঁদের অনেকেই ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতি। এ প্রক্রিয়ায় তাঁরা কেন্দ্রীয় সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। ১৯৬৬ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, ১১৪টি চা বাগানের মধ্যে ৫৬টির মালিক পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতি, ৪৭টির মালিক ইউরোপীয় এবং মাত্র ১১টির মালিক বাঙালি উদ্যোক্তা। ১৯৭০ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, ১৬২টি চা বাগানের মধ্যে ৭৪টির মালিক পশ্চিম পাকিস্তানি উদ্যোক্তা।

বাঙালি মালিকদের মধ্যে যিনি জাঁদরেল ব্রিটিশ ও পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতিদের সঙ্গে চা শিল্পের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দর কষাকষি এবং বিশ্লেষণাত্নক আলোচনা-পর্যালোচনা করতে সক্ষম ছিলেন, তিনি হলেন আমীনূর রশীদ চৌধুরী। পিতার হাত ধরেই তাঁর চায়ের মালিকানা। বাবা আব্দুর রশীদ চৌধুরী। সরকারি চাকরি দিয়ে কর্মজীবন শুরু করলেও পরবর্তীতে আব্দুর রশীদ দিলকুশা, আমীনাবাদ, সিরাজনগর ও রশীদাবাদ চা বাগানের মালিক হন। তাঁর ছিল প্রখর আত্মসম্মানবোধ। একবার সেটেলমেন্ট অফিসার হিসেবে তিনি শোলারহ্যাট মাথায় সাইকেলে চড়ে ভূমি জরিপ কাজে বেরিয়েছেন। পথে আসাম ভ্যালির একটি চা বাগান অতিক্রম করার সময় ইংরেজ ম্যানেজার ডওসন সাহেব নেটিভদের জন্য প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী তাঁকে হ্যাট খুলে সাইকেল থেকে নেমে পথ অতিক্রম করতে বলেন। আবদুর রশীদ তখন ঐ পথে না গিয়ে হ্যাট মাথায় এবং সাইকেলে চড়ে ফিরে আসেন। পরবর্তীতে চাকরি ছেড়ে তিনি যখন দিলকুশা চা বাগানের জমি লিজ নেন, তখন ঘটনাচক্রে সেই ডওসন সাহেবের পোষ্টিং ইসাবিল বাগানে। আর দিলকুশার ভেতর দিয়েই যেতে হয় ইসাবিল বাগানে। একদিন রাস্তার ওপর একটি গাছ আড়াআড়িভাবে পড়ে থাকায় গাড়ি থেকে নেমে আসেন সেই ইংরেজ ম্যানেজার। নেমে দেখেন অদূরে হ্যাট মাথায় ছড়ি হাতে আবদুর রশীদ চৌধুরী। কী ব্যাপার জিজ্ঞেস করতেই আবদুর রশীদের উত্তর ছিল, এটা আমার নিজস্ব সম্পত্তি। এখান দিয়ে যেতে হলে আমার অনুমতি নিয়ে যেতে হবে। ডওসন সাহেব সে যাত্রায় কর্মস্থলে যোগদান করতে পারেন নি এবং শেষ পর্যন্ত চাকরি ছেড়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছিলেন।
বিখ্যাত যুগভেরী পত্রিকার শুরু হয় আবদুর রশীদ চৌধুরীর হাতেই। বাবার প্রখর আত্মসম্মানবোধ ও আপোসহীতার পুরোটাই ছিল আমীনূর রশীদ চৌধুরীর চরিত্রে। অকালে মায়ের মৃত্যুর কারণে ছেলে আমিনূর রশীদ চৌধুরী বড় হয়েছেন খানদানী বৃটিশ পরিবারেই। অবাক ব্যাপার হলো, ইংরেজ বিরোধী অহিংস ও সহিংস আন্দোলনে তিনি শুধু সম্পৃক্তই ছিলেন না। বেশ উঁচু মাপের একজন বিপ্লবীও ছিলেন। তাঁদের বাড়িতে থাকা গোপন অস্ত্রাগার থেকেই সরবরাহ হত বিভিন্ন অস্ত্রের।

স্বদেশী আন্দোলনের সন্দেহভাজন হিসেবে জেলও খেটেছেন। ১৯৫১ সালে তাঁকে পাকিস্তান টি বোর্ডের সদস্য করা হয় ছোট ছোট চা বাগানের প্রতিনিধিরূপে। পাকিস্তানের চায়ের তখন খুবই দুরবস্থা। পাকিস্তানের চা বলতে বোঝাত সিলেটেরই চা। চট্টগ্রামে বাগানের সংখ্যা তখন মাত্র কয়েকটি। ১৯৪৬ সালের দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং এর সময় থেকে কলকাতা চায়ের নিলাম বা চা রপ্তানী প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এর জের চলে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের জন্মের পর সিলেট চায়ের বাজার হারায় বহির্বিশ্বে। একদিকে চট্টগ্রাম বন্দর তখন ছোট ছোট জাহাজের যাতায়াতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানিরা ভারতে চা পাঠাতে নারাজ। কলকাতার নিলামে চা বিক্রি করলে সেটা বিলাতে রপ্তানি হওয়ার সুযোগ ছিল। ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত চায়ের বাজারে এই অচলাবস্থা বিরাজ করে। যদিও চট্টগ্রামে চায়ের নিলাম শুরু হয় ১৯৫০ সালে। তবে সেটা ছিল নিতান্ত প্রাথমিক পর্যায়ে। চা শিল্পের দারুণ অর্থ সংকটের সময় ব্যাংকগুলো যখন হাত গুটিয়ে নিয়েছিল, তখন আমিনূর রশীদ চৌধুরী পূর্ববাংলার এই চা বাগানগুলোতে ফাইন্যান্সিং এর জন্য ব্যক্তিগতভাবে অনেক উদ্যোগ নিয়েছেন। উধ্বর্তন ব্যাংক কর্মকর্তাদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে হাল ধরে রাখায় সচেষ্ট হয়েছেন। যার ফলশ্রুতিতে, পাকিস্তানি আইনে কোনো ট্রেড বডির কর্মকর্তাকে তিন বছরের অধিককাল এক নাগাড়ে থাকতে দেয়ার বিধান না থাকলেও তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। যেখানে কোনো বাঙালির স্থান পাওয়াটা ছিল দিবাস্বপ্নের মতো, সেখানে ১৯৬০ সাল থেকে বাংলাদেশ স্বাধীনের আগ পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান টি এসোসিয়েশনের ভাইস-চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি কখনো আইনত, মনোনীত বা নির্বাচিত না থাকলেও মাসিক সভা বা বিশেষ বিশেষ জরুরি সভায় পর্যবেক্ষক হিসেবে ডাক পেতেন। স্বাধীনতার পরও ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ টি বোর্ডের ভাইস-চেয়ারম্যান ছিলেন।

আমিনূর রশীদ চৌধুরী ১৯৬১ সালের ৩ নভেম্বর থেকে ইস্টার্ণ হেরাল্ড ও ৩০ নভেম্বর থেকে যুগভেরী সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। নিজ অঞ্চলের জন্য নিবেদিত যুগভেরীর এ বিরল সাংবাদিকতার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও মেলে। আশির দশকে জাতিসংঘের আওতাধীন এশিয়ান মাস কমিউনিকেশন এশিয়ায় পাঁচটি সংবাদপত্রকে সফল কমিউনিটি সংবাদপত্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। যুগভেরী তার মধ্যে ছিল অন্যতম। এই গুণীজনের মাঝে সৃষ্ট বৃহত্তর জীবনবোধ তাঁকে সমাজ ও মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্তির মাধ্যমে জীবন বিকশিত করার প্রেরণা যোগায়। রাজনীতির অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে সঞ্চারিত উদার অসাম্প্রদায়িক মানবিক বোধ তাঁকে পরিণত করে ব্যতিক্রমী এক উজ্জ্বল ব্যক্তিতে। একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি জেল খেটেছেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক নির্যাতিত হয়েছেন। যদিও ইউরোপীয় বন্ধুদের সহায়তায় ১৩০ দিন পরে তিনি মুক্তি পান।১৯৭৪ সালের একটি ঘটনা। সেনাবাহিনীর কিছু উচ্ছৃঙ্খল সদস্য একদিন সিলেট শহরে ব্যাপক গণ্ডগোল করে। সারা শহরের মানুষ ভয়ে তটস্থ। যুগভেরীর প্রথম পাতা জুড়ে খবর বের হলো ‘সিলেটের ইতিহাসে সেনাবাহিনী কর্তৃক ব্যাপক গণপিটুনি’। সারা শহরে বিরাট চাঞ্চল্য। আর্মি হেডকোয়ার্টার থেকে একজন মেজর এসে আমিনূর রশীদ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করে এ গণপিটুনির প্রতিকার হবে বলে আশ্বাস দেন। পরবর্তীতে শাস্তিস্বরূপ সেনাবাহিনীর ঐ উচ্ছৃঙ্খল ইউনিটকে প্রত্যাহার করে পদব্রজে কুমিল্লা নেওয়া হয়েছিল। আমিনূর রশীদ চৌধুরী শুধু নির্ভীক সাংবাদিকই ছিলেন না, ছিলেন উঁচু মানের সাহিত্যিকও। খুব ভালো গদ্য লিখতেন। কলকাতার দেশ সাময়িকীতে তাঁর লেখা বের হতো। মরমি গানও লিখেছেন প্রচুর। পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপনের জন্য যখন ভয়ে কেউ এগিয়ে আসত না, তখন তাঁর বাসভবনে জাঁকজমকের সঙ্গে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপন করতেন। এরূপ রুচিবান, সংস্কৃতিমনা এবং আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মানুষদের ঘটনাগুলো আমাদের পাঠ্যপুস্তকে আসলে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে নিঃসন্দেহে।

হোসাইন মোহাম্মদ জাকি : গবেষক
সহায়ক গ্রন্থপুঞ্জিঃ
বাংলাপিডিয়া
মুক্তিপথের অভিযাত্রী আমীনূর রশীদ চৌধুরী, অপূর্ব শর্মা, সাহিত্য প্রকাশ
অভিজাত গণতন্ত্রী আব্দুর রশীদ চৌধুরী, অপূর্ব শর্মা, সাহিত্য প্রকাশ
সত্য ও তথ্য অসম্পূর্ণ আত্নজীবনী, আমীনূর রশীদ চৌধুরী, সাহিত্য প্রকাশ
ধন্যবাদ জনাব Hossain Zaki কে ! সংক্ষেপে সুন্দর করে
চা ও পত্রিকা প্রকাশনা শিল্পে বাংগালী প্রতিযশা ব্যেক্তিত্ব মরহুম আমীনুর রশীদ চৌধুরীকে উপস্থাপনের জন্য। আল্লহ তাঁকে জান্নাত বাসি করুন !