ঝিলটুলি থেকে ‘মহাপৃথিবী’র মৃণাল সেন

১৯২৩ সালের ১৪ মে মৃণাল সেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত পূর্ব বঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) ফরিদপুরের বৈদ্যব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ফরিদপুরে থাকাকালীন সময়ে তিনি সেখানেই উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষা সম্পন্ন করেন। এরপর কলকাতায় স্কটিশ চার্চ কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা পড়াশোনা করেন। ছাত্রাবস্থায় কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক শাখার সঙ্গে যুক্ত হন। যদিও তিনি কখনও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন নি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করবার পর সাংবাদিকতা, একজন ওষুধ বিপননকারী ও চলচ্চিত্রে শব্দ কলাকুশলী হিসাবে কাজ করেন। ১৯৫৫ সালে প্রথম পরিচালিত ছবি রাত-ভোর মুক্তি পায়। দ্বিতীয় ছবি নীল আকাশের নিচে তাকে স্থানীয় পরিচিতি এনে দেয়। তার তৃতীয় ছবি বাইশে শ্রাবণ থেকে তিনি আন্তর্জাতিক পরিচিতি পান। উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র হলো—ভুবন সোম (১৯৬৯), ইন্টারভিউ (১৯৭১), কলকাতা ৭১ (১৯৭২) এবং পদাতিক (১৯৭৩) এক দিন প্রতিদিন (১৯৭৯), খারিজ (১৯৮২) আকালের সন্ধানে (১৯৮০), মহাপৃথিবী (১৯৯২), অন্তরীন (১৯৯৪), আমার ভুবন(২০০২)। মৃণাল সেন বাংলা ভাষা ছাড়াও হিন্দি, ওড়িয়া ও তেলেগু ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর ৯৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর জন্মজয়ন্তীতে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
‘ভুবনসোম’ এর মৃণাল সেনের ‘একদিন প্রতিদিন’ ছবিটা দেখেছিলাম সেই কবে! এখনও তার অভিঘাত রয়ে গেছে মনে, যেমন থাকবেন তিনি তাঁর অনন্য সব চলচ্চিত্রসৃষ্টির সূত্রে চিরজাগরুক হয়ে। আত্মজীবনী ‘তৃতীয় ভুবন’ এ গার্সিয়া মার্কেসের সাথে তাঁর আলাপ ও সখ্যের স্বাদু-বিবরণ মুগ্ধ করার মতো। ‘আকালের সন্ধানে’ ফিরে আসলে তো চেনাতে চেয়েছেন মানুষের জন্য সুদিনের ঘরদোর। একদিন প্রতিদিন বৈষম্যমূলক এই সমাজটা এভাবেই চলছে বলেই একে যারা ধ্রুব ভাবতে পারেন নি কখনও, ‘খারিজ’ করেছেন অবিরত মৃণাল সেন তাঁদেরই একজন, ‘পদাতিক’ কমরেড। ২০২০-এও অপ্রাসঙ্গিক হয় না তাঁর ‘কলকাতা ৭১’। জন্মভূমি ফরিদপুর থেকে কলকাতা হয়ে পৃথিবীর ধুলোবালি গায়ে মেখে আজ মহাপৃথিবীর অংশ হয়ে আমাদের সুষম আগামীর ভোরে মৃণাল সেন আছেন মরচে না পড়া স্বপ্নাস্ত্র হয়ে।
২.
মৃণাল সেন; ‘একদিন আচানক’ আমিও গিয়েছিলাম ফরিদপুরের ঝিলটুলিতে, আপনার জন্মবাড়িতে। ফরিদপুরে সেটাই আমার প্রথম সফর। ২০১৯ এর পড়ন্ত বিকেলে আপনারই প্রিয় জসিমউদদীনের বাড়ি থেকে আমি ঝিলটুলিতে আসতে ব্যাকুল ছিলাম। কোনোভাবেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না সেই আকাঙ্ক্ষিত মৃণাল-সদন। অবশেষে ফরিদপুরেরই সন্তান কবি অভীক সোবহান-সহযোগে আবিষ্কার করা গেল ঝিলটুলির এখনও প্রায়-অক্ষত আপনার জন্মবাড়ি। কী মায়াময়, শান্তশ্রী, সবুজ তরুলতা-ছাওয়া; ঠিক যেন আপনার সৃষ্টিসবুজেরই মতো। আফসোস হল, আপনি কেন এই বাড়িটাকে পটভূমি করে ফরিদপুরকে ধারণ করলেন না আপনার সেলুলয়েডে! অথচ আত্মকথা ‘তৃতীয় ভুবন’-এ ভাস্বর কতটা গহন আপনার সতেরো বছরের ফরিদপুর!- জুবিলি পার্কে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জনসভায় যখন সুভাষ বসুর বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ চলছিল তখন এর প্রতিবাদে সোচ্চার আপনার ‘মেজদা’ আফজল খানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া ইতিহাসের এক সাম্প্রদায়িক মাস্টারমশাইয়ের মাথায় ছাতার বাঁট দিয়ে মারের যে উল্লেখ আপনি করেছেন, তাই তো হতে পারতো এক অনিবার্য সিনেমা। আসলে আপনার প্রতিটি সিনেমা তো এই জাতপাত, বৈষম্য ও পীড়নের তেলতেলে টাকে এক একটি সজোর ছাতার বাঁট।
৩.

কমরেড, মৃণাল সেন ; আপনাকে নিয়ে লিখতে গেলে চলে যাই আমার বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের ঝড়ো দিনরাত্রিতে। সারা ক্যাম্পাসে ভাটার বিরুদ্ধতা আর আমরা ক’জন নবীন মাঝি হাল ধরেছি আপনারই সিনেমার শরণ নিয়ে সেই তীরহারা সেই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেওয়ার ব্রতে। ছাত্রহলে লালপতাকার চিহ্নিত কক্ষের অন্ধকার ছাড়া আর কোথায় দেখতে পেতাম আলো-অভিসারী ‘আকালের সন্ধানে’! এখনও কানে বাজে সেই ‘হেই সামালো হেই সামালো’ ধ্বনি, যার রক্তগর্ভ বাণী কখনও ম্লান হওয়ার না। ম্লান কি হতে পারে ‘একদিন প্রতিদিন’ দেখা সেই মেয়েটির মুখ, যা ফিরে ফিরে পৃথিবীর প্রতিটি শৃঙ্খলিত নারীমুখ। সারাদিন গোটা পরিবারের জন্য উপার্জনের ধান্দায় ব্যতিব্যস্ত থাকা মেয়েটা একদিন দেরি করে বাড়ি ফিরলে তার অকর্মণ্য ভাইটা পর্যন্ত বলতে ছাড়ে না ‘তোর জন্য পাড়ায় মুখ দেখানো যাচ্ছে না।’ সিনেমা নিশ্চয়ই সমাজ বদল করে দেয় না কিন্তু আপনি মৃণাল সেন, এই একটি সিনেমাতেই সমাজের অন্যায়-পুষ্ট মুখে যে চাপড় দিয়ে যান তা সমাজবদলের চেয়ে কোন অংশে ন্যূন! আর ‘খারিজ’। কে না জানে এই সিনেমার কাহিনীকথা। আমি শুধু বলতে চাই আমার অনতিতরুণ বয়সে প্রথম ‘খারিজ’ দেখার অভিঘাত ও অভিজ্ঞতা। সেই যে বাচ্চা কাজের ছেলেটা মরে গেল অপঘাতে, এমন মরণ তো হরহামেশাই ঘটে। তার গরিব বাপও হয়তো সামান্য টাকাকড়ির বিনিময়ে এ নিয়ে বাড়ির কর্তা-গিন্নিকে বিপদে ফেলবে না। সবই ঠিকই ছিল। কিন্তু শ্মশানে যখন ছেলেটার চিতায় আগুন জ্বলছে, একদিকে গৃহকর্তারূপী অঞ্জণ দত্ত, অন্যদিকে ছেলেটার অসহায় বাপ আর অন্যদিকে আমার চোখে পড়ল শ্মশাণের মলিন দেয়ালে হয়তোবা সত্তর দশকের নকশালপার্টির কারও ‘ বদলা নেব’ -এজাতীয় কোনো লিখন। ক্যামেরাটা একবারই ওই লেখায় তাক করা হল, আর ওদিকে আগুন শীতল হয়ে আসছিল৷ ছেলেটার বাপ এতক্ষণে হু হু করে কেঁদে দিল আর গৃহকর্তা নিরাপদে বাড়ি ফিরলেন। কিন্তু নিষ্ক্রিয় দর্শকের চোখে চিরকালের মতো সেঁটে গেল একটা এলেবেলে দেয়াল-লিখন ‘বদলা নেব’। কে বলে সিনেমা কোনো সক্রিয়তা তৈরি করে না? ‘খারিজ’ দেখার পর মনুষ্য-মগজের অক্রিয় কোষেও গড়ে ওঠে প্রতিরোধোর সহস্র ব্যারিকেড; ‘বদলা নেব’, ‘বদলা নেব’, ‘বদলা নেব’।
৪. মৃণাল সেন আপনাকে খুঁজছি। কোথায় আপনি? আরে, ওই তো- ঝিলটুলি পেরিয়ে মহাপৃথিবীর পথে ; আর কে! আপনিই তো।
পিয়াস মজিদ : কবি ও প্রাবন্ধিক
শ্রদ্ধেয় মৃণাল সেনকে জানলাম। সুলেখক পিয়াস মজিদকে অভিনন্দন।