লাইব্রেরি: গভীর নৈঃশব্দ্যে দারুণ কল্লোলিত

মনতোষ কুমার দে Avatar

মানব সভ্যতা যেসব মহত্তম বিষয়কে আশ্রয় করে আজো ধাবমান রয়েছে, তার মধ্যে সবার আগে যে বিষয় বা প্রতিষ্ঠানের কথা উঠে আসে তা হলো বই এবং লাইব্রেরি। যে চিন্তা, আবিষ্কার, উদ্ভাবন ও সৃষ্টি সভ্যতার অগ্রযাত্রায় অবদান রেখে চলেছে তার সবই রয়েছে বইয়ের আশ্রয়ে। ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য, বিজ্ঞান, ধর্ম, ভূগোলসহ মানববিদ্যার সবকিছুই ধারণ করে আছে বই। আর বইকে সংগ্রহ করে তা কাল থেকে কালে পাঠকদের মধ্যে সরবরাহ করছে লাইব্রেরি।

এই লাইব্রেরি ও বই প্রসঙ্গে কিছু বলার আগে প্রয়োজন মানবমনের গতি-প্রকৃতি ও তার সত্তার গভীরে ছড়িয়ে থাকা নানা প্রবণতাকে শনাক্ত করা। তার স্বপ্ন-কল্পনা, আকাঙ্ক্ষা-অভিলাষ কীভাবে চৈতন্যে তরঙ্গ সৃষ্টি করে মননশীলতা ও সৃজনশীলতার উন্মোচন ঘটায়, সে সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করা। আর সেজন্যই শুরুতেই আমাদের অবস্থান সম্পর্কে এবং এই অবস্থানে আমাদের ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়াগুলো কেমন তা তুলে ধরতে চাই।

সঙ্গ-নিঃসঙ্গতায় আমরা
মানুষের সত্তার গভীরে আছে এক নিদারুণ নিঃসঙ্গতা। আছে একাকিত্বের দূরতিক্রম্য দিগন্ত। এই নিঃসঙ্গতা বা একাকিত্ব তাকে যেমন যন্ত্রণাবিদ্ধ করে, তেমনি এর নৈঃশব্দ্যে স্থান পেয়ে সে ধ্যানমৌনীও হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে আত্মদর্শী। অর্থাৎ নিঃসঙ্গ মুহূর্তগুলো মানুষকে নিজের মুখোমুখি করে। তাই এই সময়ে সে যা ভাবে তা জীবনের অতলান্তিক বোধে মহত্তম হয়। আবার একাকিত্বের কারণেই মানুষের জীবন দুঃসহ হয়ে ওঠে। হয়ে পড়ে হতাশাক্লিষ্ট। তাই সামাজিক মানুষ সমাজ সংশ্লিষ্ট সকলেরই সঙ্গ কামনা করে। সান্নিধ্য প্রত্যাশা করে স্বজন-প্রিয়জনসহ চারপাশের অন্তরঙ্গ মানুষগুলোর। শুধু মানুষ নয়, প্রকৃতি, প্রাণী, পশু, পাখিসহ সবকিছুর সঙ্গে এক নিবিড় সখ্য গড়ে তোলে সে। আর এর মাধ্যমে জীবনের মাধুর্যকে আস্বাদন করতে চায়।

সামাজিক মানুষ সমাজ সংশ্লিষ্ট সকলেরই সঙ্গ কামনা করে। সান্নিধ্য প্রত্যাশা করে স্বজন-প্রিয়জনসহ চারপাশের অন্তরঙ্গ মানুষগুলোর। শুধু মানুষ নয়, প্রকৃতি, প্রাণী, পশু, পাখিসহ সবকিছুর সঙ্গে এক নিবিড় সখ্য গড়ে তোলে সে। আর এর মাধ্যমে জীবনের মাধুর্যকে আস্বাদন করতে চায়।

নির্জনতা, নিঃসঙ্গতার সব
শূন্যতা ভরে দিয়ে পেতে চায় পরম পরিপূর্ণতাকে। কিন্তু তারপরও যখন এই সব প্রত্যাশা পূরণ হয় না, অন্ধকারে ঢেকে যায় রোদের তৃষ্ণা, তখন ঘৃণা ও বিতৃষ্ণায় ক্ষুদ্ধ হয়ে আহ্বান করে নির্জনতাকে, নৈঃসঙ্গকে। কেননা এই নিঃসঙ্গতা তাকে নিয়ে যায় জীবনের তাৎপর্য উদ্ধারে, রহস্য উন্মোচনে। তাই সঙ্গ ও নিঃসঙ্গতা দুই প্রয়োজন। জীবনে একা যেমন সত্য, তেমনি সত্য এই একাকিত্বের মধ্যে ডুব দিয়ে মহত্তর সঙ্গসুধা আহরণ।

কিন্তু এই একাকিত্বকে ভরিয়ে দিতে কিংবা সান্নিধ্যকে অর্থপূর্ণ করতে প্রয়োজন একটা প্রণোদনা। এই প্রণোদনা বা উৎসাহ আসে কোথা থেকে? চিন্তা থেকে, ভাবনা থেকে, আবেগ থেকে, কল্পনা থেকে। চিন্তা ভাবনার বিচিত্র ঐশ্বর্যে এবং আবেগ-কল্পনার বিপুল প্রাণবন্যায় এই সঙ্গ-নিঃসঙ্গতাকে প্রবহমানতায় চঞ্চল করা এবং তার মাধ্যমে জীবনকে গতিময়তা দেয়া সম্ভব। তা না হলে ভাবের প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়ে বদ্ধ জলাশয়ে রূপ নেয়। যে ভাবনা-চিন্তা এবং আবেগ-কল্পনা মুক্তচিন্তার ধারায় মিলিত হতে পারে না তা কখনোই জীবনের জন্য শুভ নয়। তাই আমাদের এইসব মুহূর্তগুলো যা স্বজন-প্রিয়জনের সান্নিধ্যে মুখর এবং যা নিঃসঙ্গতায় স্তব্ধ তার সবটাই ভরে তুলতে হবে মুক্ত জ্ঞানালোকে। অর্থাৎ আমাদের জীবনের সুদীর্ঘকালের যে ব্যাপ্তি তাকে উপেক্ষা অবহেলায় না কাটিয়ে মননশীলতা ও সৃজনশীলতায় উদ্ভাসিত করে তুলতে হবে। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার যে দাবি উঠেছে আজ তার জন্য চাই জীবনের মূল্যবান সময়গুলোকে ভাবনার ঐশ্বর্যে সমৃদ্ধ করা। চাই মনুষ্যত্বের উদ্বোধন ঘোষণা করে মানবমুক্তির ধারাকে বেগবান করার জন্য জীবনের সময়গুলোর সর্বোত্তম ব্যবহার। সে জীবন হোকনা নৈঃসঙ্গ কবলিত কিংবা কোলাহল মুখরিত। সেখানে অনিবার্যভাবে স্থান করে দিতে হবে চিন্তার চর্চাকে, আবেগের ধারাকে।

অর্জনে বিসর্জনে আমরা
আজকাল একটা আত্মপ্রসাদের জায়গা তৈরি হয়েছে আমাদের। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা অনেক এগিয়ে গেছি। বলা হচ্ছে, সমৃদ্ধির পথে অনেক সাফল্যের সূচক আমরা স্পর্শ করতে সক্ষম হয়েছি। কৃষিতে ধারাবাহিক সাফল্যের কারণে আমরা খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। পোশাক খাতে রফতানী বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন বেড়েছে। এদিকে রেমিটেন্সও বেড়েছে অনেক বেশি। দেশে-বিদেশে অনেক বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় মানুষের আয়-উপার্জন বেড়েছে। ব্যাংকে রিজার্ভের অবস্থাও ভালো প্রবৃদ্ধির হারও নাকি পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় বেশি। এতসব ভালোর মধ্যেও কালোর ছায়া ঘিরে আছে। মধ্যযুগীয় অন্ধকার নেমে আসছে মাঝে-মধ্যেই। দানবীয় উৎপাতে লণ্ডভণ্ড হচ্ছে সব অর্জন। আর্থিক দৈন্য নয়, চিন্তার দীনতা শান্তি, স্বস্তি, সম্প্রীতিকে বিনষ্ট করছে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে মানবিক মূল্যবোধ। বিপন্ন হচ্ছে মানবতা। ক্ষমতার লোভ বিত্তের লালসা এতই প্রবল হয়ে উঠেছে যে, এরই জন্য চরম নিষ্ঠুরতা ও নির্মম সহিংসতার ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। প্রাণ হারাচ্ছে নিরীহ মানুষ। অন্যদিকে নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশে ধর্ম ব্যবসায়ীরা সহজ-সরল মানুষগুলোকে বিভ্রান্ত করছে। বিনষ্ট করছে শান্তির পরিবেশকে। ফলে আমাদের অর্জনগুলো জীবনের জন্য তেমনভাবে ইতিবাচক হয়ে উঠতে পারছেনা। মানসিক দৈন্যের কারণে সর্বত্রই একটা চিন্তার দুর্ভিক্ষ বিরাজ করছে। একই কারণে সত্যকে চিনতে ভুল হচ্ছে। আমরা যা ভাবছি তার মধ্যে রয়েছে অনেক অসংগতি। এবং যা করছি তা হয়ে উঠেছে আত্মবিনাশী। অর্থাৎ আমাদের ভাবনাটা যুক্তিনির্ভর নয়, নয় মনুষ্যত্ব সংশ্লিষ্ট। নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা অন্যের অধিকারকে খর্ব করতে কুণ্ঠিত নই। এই যে অবিবেচনা তা এসেছে চিন্তার দৈন্য থেকে। আর চিন্তা তো সবসময়ই মুক্তচিন্তা। সাধারণের মধ্যে এই মুক্তচিন্তার প্রবাহটা একদম নেই। সাধারণ বলছি কেন ডিগ্রিধারী শিক্ষিতদের (!) মধ্যেও জীবনের অনুকূল চিন্তার দারুণ অভাব। মুক্তচিন্তার পরিপন্থি বিভিন্ন কার্যকলাপে লিপ্ত হয়ে তারা এক চোখা দৈত্যের মতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। এই জায়গাটায় একটা কথা উঠতে পারে যে শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে আমরা এই শূন্যতাকে কাটিয়ে উঠতে পারি। পারি চিন্তার দৈন্যকে দূর করতে। না,তা হবার নয়। কেননা এতবছর শিক্ষার যে প্রসার হয়েছে তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। পাশ দিয়েছে বিপুল সংখ্যক। কিন্তু তাদের আচার- আচরণে, কার্যকলাপে শিক্ষার কোনো আলোকিত উদ্ভাসন নেই। উপরন্তু কূপমণ্ডুকতা, গোঁড়ামী, কুসংস্কারাচ্ছন্নতা, সাম্প্রদায়িকতা ও অন্ধতাসহ মানবতা বিদ্বেষী অপতৎপরতায় জড়িয়ে তারা সমাজে আতঙ্ক হয়ে উঠেছে। তাই এই শিক্ষিতরা (!) বিপজ্জনক। প্রমথ চৌধুরীর কথাকে এই সময়ের প্রেক্ষাপটে আমরা একটু অন্যভাবে নিয়ে বলতে পারি, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে অসুস্থ মানুষ নয়, ভয়ঙ্কর মানুষ তৈরি হচ্ছে। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে ‘বই’ নামের সবচেয়ে বিস্ময়কর বস্তুর সহায়তায় মুক্তচিন্তার অনুশীলন করতে হবে। আর তাহলেই এই দৈন্য কাটিয়ে আমরা প্রকৃত শিক্ষার আলোকে মানসিক ঐশ্বর্যের সন্ধান করতে পারি। এই ঐশ্বর্য ব্যতীত ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে কল্যাণমুখী ধারায় পরিচালনা করা কখনোই সম্ভব নয়। আর বিলম্ব নয়, বইয়ের জগতে প্রবেশ করে মানব মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করার এই তো সময়। তা না হলে অন্ধকার আরো গভীর হয়ে আমাদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলবে। মুক্তচিন্তার চর্চার মাধ্যমে। শুভবুদ্ধির উন্মেষ ঘটলেই ওই দানবীয় শক্তির পরাজয় নিশ্চিত হবে। আমরাও রক্ষা পাব এই বিপন্নতা থেকে।

প্রমথ চৌধুরীর কথাকে এই সময়ের প্রেক্ষাপটে আমরা একটু অন্যভাবে নিয়ে বলতে পারি, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে অসুস্থ মানুষ নয়, ভয়ঙ্কর মানুষ তৈরি হচ্ছে। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে ‘বই’ নামের সবচেয়ে বিস্ময়কর বস্তুর সহায়তায় মুক্তচিন্তার অনুশীলন করতে হবে। আর তাহলেই এই দৈন্য কাটিয়ে আমরা প্রকৃত শিক্ষার আলোকে মানসিক ঐশ্বর্যের সন্ধান করতে পারি। এই ঐশ্বর্য ব্যতীত ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে কল্যাণমুখী ধারায় পরিচালনা করা কখনোই সম্ভব নয়। আর বিলম্ব নয়, বইয়ের জগতে প্রবেশ করে মানব মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করার এই তো সময়। তা না হলে অন্ধকার আরো গভীর হয়ে আমাদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলবে। মুক্তচিন্তার চর্চার মাধ্যমে। শুভবুদ্ধির উন্মেষ ঘটলেই ওই দানবীয় শক্তির পরাজয় নিশ্চিত হবে। আমরাও রক্ষা পাব এই বিপন্নতা থেকে।

শিক্ষা ও চিন্তার সংকটে আমরা
আমাদের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষা তা অনেকাংশেই ব্যর্থ হয়েছে। ব্যর্থ বললে যথেষ্ট বলা হবে না, বলতে হবে মানবিক বোধের পরিপন্থি হয়ে উঠেছে। এই রকম চরম কথা বলার পক্ষপাতী আমি কখনোই ছিলামনা। কিন্তু তবুও এটা বলতে হলো এই জন্যই যে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আসা অধিকাংশই আজ যে আচরণ ও তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে তা ভয়াবহভাবে মানবতা বিদ্বেষী। সুস্থ ধারার আধুনিক চিন্তার পরিবর্তে এরা ভীষণভাবে পুরানো ধ্যান-ধারনার অনুসারী। অথচ বিগত শতাব্দীর ষাট ও সত্তর দশকে এমনটি দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যাঁরাই বেরিয়ে এসেছিলেন তাঁরা অধিকাংশই ছিলেন প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার মানুষ। কিন্তু এখন তার উল্টোটাই দেখা যায়। আবার এও লক্ষ করা যায় যে সেদিনের প্রগতিশীল ও বাম রাজনৈতিক চিন্তাধারার অতিবিপ্লবী মানুষগুলোর অনেকেই বর্তমানে প্রতিক্রিয়াশীল শিবিরের মুখপাত্র হয়ে উঠেছেন। ব্যাপারটা খুবই ঘোলাটে।

এর জন্য আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা যে দায়ী তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে আরো একটি বিষয় এর পেছনে কাজ করছে, সেটি লোভ। অর্থের লোভে এরা মনুষ্যত্ববিরোধী অপতৎপরতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছে। আমরা তো জানি এই তৎপরতায় অংশ নিতে বা সমর্থন করতে দেশে এখন অজস্র টাকা ছড়ানো হচ্ছে। তাই দীর্ঘদিনের মতাদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে বিত্ত বৈভবের আশায় অধিকাংশই যোগ দিচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক শক্তির শিবিরে। বিষয়টিকে Identity crisis বলা যেতে পারে। কিন্তু আজকের আলোচনার স্বার্থে আমি বলব Crisis of thought,চিন্তার সংকট। আমাদের শিক্ষায় এই চিন্তার সংকট প্রবল। প্রখ্যাত চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াস বলেছিলেন, “চিন্তা ছাড়া শিক্ষা বৃথা, শিক্ষা ছাড়া চিন্তা বিপজ্জনক।” উক্তিটির দুটি অংশই আমাদের জন্য প্রযোজ্য। তবে আমরা এখন চিন্তার বিপজ্জনক পর্যায়ে আছি। যে চিন্তাকে লালন করছি, যে ভাবনাকে আশ্রয় করে জীবন ধারণ করবার চেষ্টা করছি, তা ব্যর্থতাই ডেকে আনবেনা, হয়ে উঠবে বিপজ্জনক। আর সেজন্যই প্রকৃত শিক্ষার সাধনায় সকলকে যুক্ত করতে হবে। আর চিন্তা কখনো যেন বিপজ্জনক না হয়ে ওঠে তার জন্য কারো উপর নির্ভরশীল না হয়ে স্বাধীন পাঠে আত্মনিয়োগে করতে হবে। হতে হবে স্বশিক্ষিত।

বই ও মুক্তচিন্তা
চিন্তার এই দৈন্যদশা ও বিপজ্জনক অবস্থা থেকে মুক্ত হওয়ার লক্ষ্যেই আমাদের অবশ্যই বইমুখী হতে হবে। বই সম্পর্কে অনেক ভালো কথা আছে। কিন্তু সেগুলোও আছে বইয়ে। আমরা বই বিমুখ বলে তা জানতেও পারিনা। অজানাই থেকে যায় বইয়ের আশ্চর্য ক্ষমতার কথা।

বই হাতের মধ্যে সহজেই ধারণ করা যায়, দৃষ্টি মেলে পাতা ওল্টানো যায় একের পর এক, এমনি এক জাদুময় উজ্জ্বল মনোরম আয়তক্ষেত্র। কোনো জটিলতা নেই, অথচ কী বিস্ময়কর প্রযুক্তি এই বই। এর কালো অক্ষরগুলো অনুসরণ করে যতই এগিয়ে যাই ততই যেন উন্মোচিত হতে থাকে আনন্দময় জগৎ—আলাকিত ভুবন। ভালোলাগার সুখানুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘তিথিডোর‘ উপন্যাসের একজায়গায় লিখেছেন—

‘পাতাগুলি খসখস করে বলল—এসো, এসো কালো কালো অক্ষরগুলি গুণগুণ করল—শোনো শোনো একটু আগে। তার যেমনই খারাপ লাগছিল,তেমনি একটা সুখের ঢেউ ছলছল করে উঠল বুকের মধ্যে‘।

এই যে সুখের ঢেউ ছলছল করে ওঠা, এটাতো বই প্রেমীদের এক আনন্দময় অভিজ্ঞতা। বইয়ের স্পর্শে আলোড়িত হওয়া, স্পন্দিত হওয়া, পুলকিত হওয়ার অভিজ্ঞতা যাঁর, তার কাছে অন্যসব একেবারেই তুচ্ছ।

আরও বলা যায়, ‘বই’ নামের এই প্রযুক্তিটির ব্যবহার এতই সহজ যে, এর জন্য অতিরিক্ত কিছুর উপর নির্ভর করতে হয় না। বইয়ের ব্যবহারে লাগে না বিদ্যুৎ কিংবা অন্য কোনো সংযোগ। যখন ইচ্ছে তখনই ব্যবহার করে তা থেকে নিজের প্রয়োজনটা সেরে নেয়া যায়। নেটওয়ার্কের অপেক্ষায় থেকে বিরক্তিকর সময় অতিবাহিত করতে হয় না। বই এমন একটা স্পর্শ সুখ দেয় যার সঙ্গে অন্যকিছুরই তুলনা হয় না। নতুন বইয়ের গন্ধ তো সবাইকেই শিহরিত করে। প্রিয় সান্নিধ্যের মতোই বই ছুঁয়ে, নেড়ে রোমাঞ্চিত হওয়া যায়। ভীষণ স্পর্শগ্রাহ্য জিনিস বই। বই যা হাতে নিলে ব্যথা লাগে না। যাকে আপন করে নিতে কোনো বাধা নেই। যা বিকল হয়ে প্রতারণা করে না বা বিমুখ হয়না। আমাদের শরীরের যেকোনো অবস্থার সঙ্গে বেমালুম খাপ খেয়ে যায়। বসে, শুয়ে, দাঁড়িয়ে এমনকি চলতে চলতেও বই আমাদের সঙ্গী থাকে। জল, স্থল, আকাশযানেও আমরা বইয়ের সান্নিধ্য পেতে পারি। একের সঙ্গে অন্যের যোগাযোগ বইয়ের মাধ্যমেই হয় সার্থকভাবে। অন্য যোগাযোগগুলো যেখানে তাৎক্ষণিক বন্ধনে আলগা, বই সেখানে গভীর ও সুদূরপ্রসারী সম্পর্কে প্রসারিত। বইয়ের মাধ্যমে লেখকের সঙ্গে পাঠকের যে যোগাযোগ হয় তা মূলত চেতনাবিস্তারী এবং মনন ও সৃজন নৈকট্যে ঘনিষ্ঠ। তাই বইই সর্বোৎকৃষ্ট যোগাযোগ মাধ্যম। বই আছে বলেই মানবজাতির ইতিহাস আছে, আছে তার অস্তিত্বের বিস্তার। বইয়ের বস্তুগত অবস্থানটি অন্য সবকিছুর চেয়ে প্রবল বলে বই মানসিকভাবে প্রভাবিত করে খুব বেশি। বই দৃশ্যমানতায়ও অনন্য। লাইব্রেরিতে সারে সারে রক্ষিত বই একই সঙ্গে দৃষ্টিতে ধরা দেয়। আর তখন তা মনের ভিতরে একটা আকুলতা সৃষ্টি করে। অন্যকোনো যোগাযোগ মাধ্যমে এই দৃশ্যমানতা খুবই কম। সেখানে যা আছে তাতে আছে এক নির্মম আড়াল। ইচ্ছা হলে তা দেখতে পারি, নচেৎ তাকে অন্তরালে বন্দি রাখতে পারি। পক্ষান্তরে বই উন্মোচনে সার্থক। তাকে উপেক্ষায় অবহেলায় দূরে ঠেলে দেয়া সম্ভব নয়। সে যেন শিশুর মতোই কোলে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়। তখন নির্দয় মানুষটিও মমতায় আর্দ্র হয়ে ওঠে। এইখানেই বইয়ে শ্রেষ্ঠত্ব।

বই’ নামের এই প্রযুক্তিটির ব্যবহার এতই সহজ যে, এর জন্য অতিরিক্ত কিছুর উপর নির্ভর করতে হয় না। বইয়ের ব্যবহারে লাগে না বিদ্যুৎ কিংবা অন্য কোনো সংযোগ। যখন ইচ্ছে তখনই ব্যবহার করে তা থেকে নিজের প্রয়োজনটা সেরে নেয়া যায়। নেটওয়ার্কের অপেক্ষায় থেকে বিরক্তিকর সময় অতিবাহিত করতে হয় না। বই এমন একটা স্পর্শ সুখ দেয় যার সঙ্গে অন্যকিছুরই তুলনা হয় না। নতুন বইয়ের গন্ধ তো সবাইকেই শিহরিত করে। প্রিয় সান্নিধ্যের মতোই বই ছুঁয়ে, নেড়ে রোমাঞ্চিত হওয়া যায়।

বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার ও প্রযুক্তির বিস্ময়কর উদ্ভাবনের ফলে সভ্যতার অভাবনীয় অগ্রগতি হয়েছে। মানব জীবনে এসেছে নানামুখী স্বাচ্ছন্দ্য। কিন্তু একটি প্রযুক্তি, যা বর্তমানের আর সব প্রযুক্তির বিবেচনায় খুবই তুচ্ছ, সামান্য, সেই বইটি যে কত বিস্ময়কর তা ব্যাপক ব্যবহারের কারণে আমরা ভুলতে বসেছি। আমাদের চিন্তাজগৎকে কীভাবে যে ঐশ্বর্যময় করে তুলেছে এই বই, তা ভাবলে অবাক হতে হয়। বইকে আশ্রয় করে আমাদের সৃজনশীলতা কত বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে, লাভ করেছে কী বিশাল ব্যাপ্তি’তা ভাবাই যায়না। শুধু তাই নয়, বইকে কেন্দ্র করেই আমাদের জীবনধারা, আমাদের আদর্শ-বিশ্বাসের জায়গাগুলোও পাল্টাচ্ছে। হচ্ছে নতুন  নতুন উপলব্ধিতে শানিত। “দিব্যোন্মাদ গ্রন্থভুকদের সঙ্গে” শিরোনামের বইবিষয়ক এক লেখায় লেখক চিন্ময় গুহ বলেছেন—‘আমাদের প্রতিদিনের জীবনে যে প্রযুক্তিকে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করি আমরা, অথচ আলাদা করে মনেও রাখিনা, সেটি ওই আয়তক্ষেত্রটি। মানব ভাবনা আর তথ্যে সেই আধার, যা অধিকাংশ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের চেয়েও আরও গভীরভাবে মানব সভ্যতাকে বদলে দিয়েছে। আমাদের মেরুদণ্ডি ধী-অস্তিত্বের প্রথমতম ঋণ তো বইয়ের কাছেই।”

বই আছে বলেই মানব অস্তিত্ব এত অর্থপূর্ণ। বই আছে বলেই সময়ের স্রোত বিলীন হয় না, তা বাধা থাকে কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে। অতীতের সবকিছুই আশ্চর্য ক্ষমতায় সংরক্ষণ করে বই। আর তা করে বলেই মানব সভ্যতার ক্রমধারা আছে। এই যে আমরা বর্তমানের যে জীবনধারায় বহমান রয়েছি তা অতীতের অনেক অর্জন থেকেই প্রাপ্ত। বই না থাকলে আমাদের যাত্রা করতে হতো শূন্য থেকে। মাতৃগর্ভে আমাদের শারীরিক জন্ম হয় সত্য, কিন্তু মানসিক জন্মলাভ ঘটে বইয়ে। যে চিন্তা, যে ভাবনা আমাদের মানব অস্তিত্বের বিষয়টিকে মর্যাদা দেয় তাকে পাওয়া যায় বইয়েই। তাইতো মালার্মে বলেছিলেন, “পৃথিবীটা টিকে আছে শুধু বইতে সেঁধোনোর জন্য।” বইই হচ্ছে চিন্তার আশ্রয়। তাই বইকে সজীব মানবভাবনার প্রতীকও বলা যায়। বিশ্বব্রহ্মান্ডের কথা বলতে গিয়ে গ্যালিলিও লিখেছিলেন, ‘আমাদের চোখের সামনে নিরন্তর খুলে যাচ্ছে ওই বিরাট দর্শনের বইটি।’ জাঁ পল সার্ত্রে আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, ‘আমি বইয়ের মধ্যে জন্মেছি, সম্ভবত বইয়ের মধ্যে মরব।’

বই নিয়ে অনেক কথা বলেছেন বাংলাভাষার লেখকেরাও। তাঁদের মধ্যে প্রমথ চৌধুরী ও সৈয়দ মুজতবা আলীর কথা সবাই জানেন। বইয়ের গুরুত্ব তাঁরা নানাভাবে প্রকাশ করেছেন। এমনকি চরম সিদ্ধান্তও দিয়েছেন বইয়ের জন্য। এসবের উল্লেখ থেকে বিরত থাকছি এজন্যই যে তা পুনরুক্তি মনে হতে পারে অনেকের কাছে।

এবার বইয়ের অবলম্বন যে কাগজ সে সম্পর্কে কিছু তথ্য পরিবেশন করবো। যখন কাগজ আবিষ্কৃত হয়নি তখন বৃক্ষপত্রই ছিল লেখার অবলম্বন। খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ সাল কিংবা তারও আগে নীল নদের ধারে মিশরীয়রা প্যাপিরাস গাছ থেকে মানবভাবনার আধারটি তৈরি করেছিলো প্লিনির Natural History তে এর বিশদ বর্ণনা আছে। ১০৫ খ্রিস্টাব্দে চিনের হুন সম্রাট হান-হো-তি’র সভাসদসাই-লুন প্রথম কাগজ তৈরির প্রস্তাব করেন। তবে অনেক ঐতিহাসিকের অভিমত, খ্রিস্টপূর্ব ১০৪ থেকে ৮৬-র মধ্যে কাগজের আবির্ভাব হয়ে থাকতে পারে। শায়িত বা লম্বালম্বি রাখা প্যাপিরাস বা পার্চমেন্টের স্ক্রোলই হোক, অথবা তালপাতা, ভূর্জপত্র বা অনেক পরে কাগজের বই এসবই এক অপূর্ব মানব উদ্যমের অঙ্গ। ইতিহাসের এই তথ্য আমাদের জানিয়ে দেয় যে, যে কাগজ দিয়ে বই, তার উৎস বৃক্ষ। বইতো আর কিছু নয়, এ হলো মানস উৎকর্ষের এক বিস্ময়কর প্রযুক্তি। একটি ফরাসী প্রবচনের উদ্ধৃতি দিয়ে বর্তমান প্রসঙ্গটি শেষ করবো যেখানে বলা হয়েছেঃ ‘কথা উড়ে যায় কিন্তু লিখিত শব্দ বেঁচে থাকে।’ আর এই লিখিত শব্দ আশ্রয় পায় বইয়ে।

লাইব্রেরি : গভীর নৈঃশব্দ্যে দারুণ কল্লোলিত

যে বিষয়ে প্রবেশের জন্য এতসব দরোজা খুলতে হলো, তা হলো লাইব্রেরি। এই লাইব্রেরি বলতে সাধারণভাবে বুঝি অজস্র বইয়ের সংগ্রহ। বই আর লাইব্রেরি এ দুটো যেন এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে আবদ্ধ। তবে বই হলো কোনো লেখকের ব্যক্তিগত ভাবনা-চিন্তার স্বাক্ষর সম্বলিত একটি প্রযুক্তি। আর লাইব্রেরি হলো এই প্রযুক্তিকে সর্বোত্তম ব্যবহারের উপযোগী করে তোলার প্রতিষ্ঠান। পাঠকের রুচি ও পছন্দ অনুযায়ী বই সরবরাহ করা লাইব্রেরির দায়িত্ব। মানুষের মেধা ও সৃজনশীলতাকে লালন করতে লাইব্রেরি পাঠকের হাতে তুলে দেয় বিচিত্র সব বই। পাঠাভ্যাস গড়ে তুলে পাঠককে স্বাধীন পাঠে আগ্রহী করে তোলাই লাইব্রেরির কাজ। জীবন ও জগতের রহস্য উন্মোচনে যে গবেষণা, যে সাধনা যে অনুসন্ধন চলছে প্রতিনিয়ত তাকে সহায়তা দেয়াও লাইব্রেরির দায়িত্ব।  ‘ লাইব্রেরিই পারে মানুষের অনুসন্ধিৎসাকে জাগ্রত করতে। তার জ্ঞানের তৃষ্ণাকে মেটাতে। বিভিন্ন মত পথের আশ্চর্য সমাবেশ থাকে লাইব্রেরিতে। লাইব্রেরিতে থাকে নানা চিন্তার ঐশ্বর্য। থাকে শিল্প-সংস্কৃতি, ইতিহাস-দর্শন,বিজ্ঞান-প্রযুক্তিসহ দৈনন্দিন বিষয়ের অজস্র বই। আমাদের জ্ঞানের যে বিশাল পরিধি তা এখানে এসে এক বিন্দুতে মিলিত হয়েছে। মনে পড়ে যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের সেই অসাধারণ শিল্পগুণ সমৃদ্ধ ‘লাইব্রেরি’ প্রবন্ধের কালজয়ী উক্তি:

‘মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে, সে ঘুমাইয়া পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহাশব্দের সহিত এই লাইব্রেরির তুলনা হইত। এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে।’

‘মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে, সে ঘুমাইয়া পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহাশব্দের সহিত এই লাইব্রেরির তুলনা হইত। এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে।’

লাইব্রেরিতে আমাদের কর্ম ও চিন্তার, আশা ও আকাক্ষার এবং স্বপ্ন ও কল্পনার সব কিছুই এক স্তব্ধতায় আচ্ছন্ন। হয়ে আছে। নীরব হয়ে আছে নানা মতপথের আশ্চর্য সব শব্দাবলি। তাই লাইব্রেরিতে এসে সে সবকে নৈঃশব্দ্য থেকে উদ্ধার করে এনে আমরা জীবনকে স্পন্দিত করে তুলতে পারি। পারি বেগবান করতে। জীবন তো স্থবির নয়, নয় শুধু যাপন, জীবন চঞ্চল, মুখর। লাইব্রেরি বা বই জীবনকে মুখরতা দিতে পারে। দিতে পারে উদযাপনের আনন্দ। আমাদের ক্ষুদ্রতা, নীচতা, সংকীর্ণতা এইখানে এসে মহতের সান্নিধ্য পায়। খুলে যায় হৃদয়ের বদ্ধ দুয়ার। মনুষ্যত্বের আলোকতীর্থ নিকটবর্তী হয়ে ওঠে। এখানে এসেই আমাদের মুক্তির প্রত্যাশা প্রবল হয়। পরিত্রাণের আকাঙ্ক্ষায় ডানা মেলতে চায় দিগন্তে। যে প্রসারণের ক্ষুধা মানুষের মধ্যে চিরন্তন, তা এই সীমাবদ্ধতায় সার্থকতা খুঁজে পায়। এইখানেই জেগে ওঠে অনন্তের আকাঙ্ক্ষা। একটি ক্ষুদ্র পরিসর, অথচ এরই মধ্যে ছড়িয়ে থাকে অন্তহীন বিশালতা। সকল মতপথের আশ্চর্য সহাবস্থানে এক ব্যাপ্তিময় ভুবন যেন এই লাইব্রেরি। এখানে মানবের মুখরিত জীবন গভীর নৈঃশব্দ্যে দারুণ কল্লোলিত। রবীন্দ্রনাথ আরো বলেছেন—

‘লাইব্রেরির মধ্যে আমরা সহস্র পথের চৌমাথার উপর দাঁড়াইয়া আছি। কোনো পথ অনন্ত সমুদ্রে গিয়াছে, কোনো পথ অনন্ত শিখরে উঠিয়াছে, কোনো পথ মানব হৃদয়ের অতলস্পর্শে নামিয়াছে। যে যেদিকে ধাবমান হও, কোথাও বাধা পাইবেনা। মানুষ আপনার পরিত্রাণকে এতটুকু জায়গার মধ্যে বাঁধাইয়া রাখিয়াছে।’

‘লাইব্রেরির মধ্যে আমরা সহস্র পথের চৌমাথার উপর দাঁড়াইয়া আছি। কোনো পথ অনন্ত সমুদ্রে গিয়াছে, কোনো পথ অনন্ত শিখরে উঠিয়াছে, কোনো পথ মানব হৃদয়ের অতলস্পর্শে নামিয়াছে। যে যেদিকে ধাবমান হও, কোথাও বাধা পাইবেনা। মানুষ আপনার পরিত্রাণকে এতটুকু জায়গার মধ্যে বাঁধাইয়া রাখিয়াছে।’

আমরা যখন একটা জায়গার মধ্যে থাকি তখন সেই জায়গাটুকুর সীমাবদ্ধতার মধ্যেই থাকি। এই সীমাবদ্ধতা প্রায়শ আমাদের সংকীর্ণ ও অনুদার করে। কিন্তু যখন লাইব্রেরির মধ্যে থাকি তখন অনন্তের মধ্যে থাকি। অর্থাৎ লাইব্রেরি একটা জায়গার ক্ষুদ্রতাকে অতিক্রম করতে পারে অনায়াসে। বৃহতের ও মহতের সন্ধান দেয় বলে লাইব্রেরি অনেক বড়। লাইব্রেরির মধ্যে রয়েছে প্রাণের বিপুল সম্ভার। অনন্তের আস্বাদ অনুভব করি বলেই লাইব্রেরি একটি অখ্যাত জায়গাকেও মর্যাদায় উন্নত করতে পারে। লাইব্রেরির মধ্যে থাকা মানে বড়র সাহচর্যে থাকা, মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ থাকা।

আমাদের দেশে গ্রাম-জনপদে লাইব্রেরি গড়ে তুলে মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা অনেকদিন ধরেই শুরু হয়েছে। তাই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লাইব্রেরিগুলো আমাদের কাছে সবসময়ই বিশেষ গুরুত্ব দাবি করে। এসব লাইব্রেরিতেই দেশের মন বড় হয়। মুক্তমনের মানুষ বর্ধিত হয়। স্থানটি সামান্য হয়েও অসামান্যের ছোঁয়া পায়।

মনতোষ কুমার দে : বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, গবেষক ও লেখক

তথ্যসূত্র:
দেশ বই সংগ্রহ ২০১১, কলকাতা
প্রবন্ধ: সংগ্রহ প্রমথ চৌধুরী,বিশ্বসাহিত্য ভবন,ঢাকা
রবীন্দ্র রচনাবলী,৩য় খন্ড ঐতিহ্য প্রকাশনা,২০০৪

One response to “লাইব্রেরি: গভীর নৈঃশব্দ্যে দারুণ কল্লোলিত”

  1. Habiba Begum Avatar
    Habiba Begum

    চমৎকার বিষয়ে একটি প্রবন্ধ,খুব ভালো লাগল স্যার

মতামত