সংকটে জাগ্রত হোক বিশ্ব মানবতা বোধ

একথা সর্বজন বিদিত, সর্বজন স্বীকৃত আর পাঁচটা প্রাণীর থেকে বিদ্যা বুদ্ধি মেধাতে মানুষ শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে পরিগণিত, সম্মানিত প্রশংসিত। সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই মানুষের জয়যাত্রা অবিরাম দুর্বার গতিতে চলতে আছে। শ্রেষ্ঠত্বের তকমাধারী মানুষ আজ ক্ষমতার দম্ভে উন্মাদ। পৃথিবীতে তার সর্বোচ্চ আধিপত্য বিস্তারের অহর্নিশ অভিযান চলমান। এত কিছু পেয়েও মানুষ যেন আরোও বেশি প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষায় প্রহর গুনতে আছে। অসীম অতৃপ্তির কামনায়, চাহিদা পূরণের অভিপ্সায় মানুষ প্রতি মুহূর্তে ছুটতেই আছে সর্বদা। বলতে গেলে ধরণীতলে আমৃত্যু মানব জাতির প্রাপ্তি ,প্রত্যাশার, নিরবধি আকাঙ্ক্ষা, ভোগবিলাস, পার্থিব মোহ, চাহিদা পূরণ করতেই সতত ব্যস্ত। মানুষ দুর্বার গতিতে ছুটে চলেছে তার সাম্রাজ্য বিস্তারের নিরবচ্ছিন্ন অভিযানের উদ্দেশ্যে। প্রতিমুহূর্তে মানুষ পার্থিব সম্পদ, সুখ, অভিলাষ,কামনা চরিতার্থ চলছে জয়ের যাত্রা। মর্তালোকে শ্রেষ্ঠ জীবের পরাক্রমতা,নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব, অতৃপ্ততা দিনকে দিন আকাশ ছোঁয়া। সমৃদ্ধির শিখরে পৌঁছে ও মানুষ যেন এখনো হতাশা নৈরাশ্য, একরাশ শূন্যতা, জিঘাংসায় তন্ময় হয়ে আছে।
শতাব্দীর প্রাণনাশক করোনাভাইরাসের সংক্রমণে ভেঙে পড়ল মানব সমাজের শৃংখল। মুহূর্তেই অদৃশ্য কিটানুর বিপর্যয়ের ঘনঘটায় শঙ্কিত বিধ্বস্ত দিশেহারা মানবজাতি। চারিদিকে অসহায় নিরীহ মানুষের বিভীষিকা, দুর্বিষহ, অসহনীয়, ভয়াবহ অবস্থা। আমরা দেখলাম ভাইরাসের সংহারে প্রান্তিক দরিদ্র দিনমজুর দিন আনা দিন খাওয়া শ্রমিক, কুলি মজুর এক কথায় সর্বহারা মানুষদের অবস্থা একেবারে তথৈবচ। যেকোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়, অস্থিরতা, সংঘাত হানাহানি, রাজনৈতিক রক্তপাতে ঝরে পড়ে সমাজের একেবারে অসহায় মানুষেরা যারা শুধু পরের দিন কি খাব, কিভাবে বাঁচব, কিভাবে দিনযাপন করব এই আশাতে প্রহর গুনতে থাকে। সেই চিরায়ত প্রবাদ কে আবারও স্মরণ করি-” রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়/ উলুখাগড়ার প্রাণ যায়”। সেই হৃদয়বিদারক বিপর্যস্ত মানুষের আর্তনাদ, কান্না, দগ্ধতার, যাতনার, বিষাদের নিদারুণ প্রতিচ্ছবি এবারের অতিমারিতেও আমরা চরমভাবে পর্যবেক্ষণ করলাম। প্রতি ক্ষেত্রেই সেই শ্রেণী বৈষম্য, শোশন, শাসন, নিপীড়ন যন্ত্রণার পুনরাবৃত্তি। অযাচিতভাবে চলে আসছে পুঁজিবাদের রমরমা পোয়াবারো। মানুষের সীমাহীন সম্পদ প্রীতি, আকাঙ্ক্ষা, লোভ লালসা তাদেরকে অহর্নিশ প্রলয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেইসঙ্গে প্রকৃতির প্রতি রূঢ় আচরণ, প্রাকৃতিক সম্পদের অনাবশ্যক অপ চয়, প্রকৃতির সঙ্গে অবন্ধু সুলভ আচরণ, দাসত্ব গিরি প্রকৃতিকে করে তুলেছে অসহনীয়, ক্ষুব্ধ, মর্মাহত। কর্তৃত্ব, ক্ষমতা যখন ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায় তখন নেমে আসে প্রকৃতির প্রত্যাঘাত। কিন্তু প্রকৃতির এই বিপর্যয় সবথেকে বেশি আক্রান্ত, ক্ষতিগ্রস্ত শিকার হয়েছে সাধারণ মানুষেরা। অদৃশ্য ভাইরাসের সংক্রমনের দাপটে, প্রাদুর্ভাবে দীর্ঘ লকডাউনের স্তব্ধতায় কর্মসংস্থান হিন হয়ে পড়েছে অসংখ্য মানুষ। বেকারত্বের জ্বালা যন্ত্রনায় দিন গুজরান করছে অগণিত মানুষ। সামাজিক ভারসাম্য ভেঙে পড়েছে। ধনী আরো ধনের অধিকারী, গরীব আরও বেশি গরীবিতে নিমজ্জিত। বৈষম্য, ভারসাম্য, সম্প্রীতি, সহবস্থান, সহানুভূতি, সহমর্মিতা, পরোপকারিতা, দায়বদ্ধতা, সামাজিকতা, উদারতা, মহানুভবতা এই সমস্ত শব্দগুলো আজ বড্ড সেকেলে। ভাবতে অবাক লাগে জ্ঞান-গরিমায়, বিদ্যা বুদ্ধিতে শ্রেষ্ঠ জীবের তকমা ধারণ করেও আমরা নিজেদের মধ্যে জমে থাকা বিদ্বেষ, হিংসা, বিভাজন, অশান্তি, মতভেদ দূর করতে পারেনি। আমাদের মধ্যে এখনো রয়ে গেছে নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা, অসহিষ্ণুতা, হঠকারিতা, অসংবেদনশীল, স্বেচ্ছাচারিতা। আমরা এখনো লড়াই করছি নিজেদের মধ্যে। কে কত বেশি ক্ষমতাশালী, কি কত বেশি জ্ঞানের অধিকারী, কে কত বেশি বিত্তবান। আমরা এখনো সামাজিক জীব হিসেবে মনুষ্যত্বের বৈশিষ্ট্যে নিজেদের উত্তরণ ঘটাতে পারেনি। আমরা এখনো নিজেদের মধ্যে নিরন্তর লড়াই প্রতিযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা এখনো জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মিলেমিশে একাকার হয়ে বিশ্ব মানবতার বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারিনি। পরিশেষে করোনা অতিমারিতেই আমরা সবাই অঙ্গীকারবদ্ধ হই প্রকৃত মানুষ হবার। আসুন আমরা সবাই অন্তঃস্থ মনুষ্যত্বের আহবানে সাড়া দিয়ে মনুষ্য জীবে নিজেদের আখ্যায়িত করি। হয়ে উঠি আমরা সবাই প্রকৃত মানুষ। মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়ায়, প্রত্যয়ী হাত বাড়িয়ে দিই অপার সহযোগিতায়। সর্বোপরি একে অপরের মধ্যে অহর্নিশ জেগে উঠুক বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব, বিশ্ব মানবতা, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের চিরায়ত বাতাবরণ।