নজরুল ও তাঁর শিক্ষক কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক

কিশোর নজরুল
কিশোর তরুণ তেজস্বী নজরুল,
অম্লান, তাজা, টাটকা গোলাপ ফুল,
প্রীতি-গীতিময় তাহার বসুন্ধরা
আগুন এবং আঙুর দিয়ে যে গড়া।
বুকেতে তাহার ছুটিতেছে নিশিদিন
ভাব ও ভাষার বিদ্যুৎ-বেদুইন।
আলোকে পুলকে প্রতিভায় ভরা প্রাণ
মরীচিকা মাঝে রচিতেছে মরুদ্যান।
কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে এই কবিতাটি লিখেছিলেন তাঁর স্কুল জীবনের শিক্ষক, বাংলা সাহিত্যের অত্যন্ত সুপরিচিত কবি শ্রী কুমুদরঞ্জন মল্লিক। মাত্র ৮ লাইনের এই কবিতায় ‘কিশোর নজরুলের’ যে ছবি আমরা পাই তা অনবদ্য।
বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট থানার অন্তর্ভুক্ত মাথরুন একটি গ্রাম। এই গ্রামটি কাসিম বাজারের মহারাজা মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর জন্মস্থান। তিনি তাঁর জন্মস্থানে তাঁর পিতার নামে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। বিদ্যালয়ের আসল নাম মাথরুন নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশন। কবি শ্রী কুমুদ রঞ্জন মল্লিক এই বিদ্যালয়ের হেডমাস্টার ছিলেন। ‘আমাদের নজরুল’ শীর্ষক রচনায় কুমুদরঞ্জন মল্লিক স্মৃতিচারণা করেছেন তাঁর অত্যন্ত স্নেহের ছাত্র সম্পর্কে – “আমি তেইশ বৎসর বয়সে মাথরুন উচ্চ ইংরাজী স্কুলে শিক্ষক হিসাবে ঢুকি।…নজরুল কলিকাতায় আমাকে জানায় যে, সে আমার স্কুলের ছাত্র এবং ভক্তিভরে প্রণাম করে। আমি শুনিয়া আনন্দিত হই ও গৌরব বোধ করি। তখনকার দিনে 6th Class-এ নজরুল পড়িত। ছোট্ট সুন্দর ছনছনে ছেলেটি, আমি ক্লাস পরিদর্শন করিতে গেলে সে আগেই আসিয়া প্রণাম করিত। আমি হাসিয়া তাহাকে আদর করিতাম। সে বড় লাজুক ছিল। হেডমাস্টারকে অত্যন্ত সম্ভ্রমের সহিত দেখিত। ছোট ছেলে কাছে আসিতে সাহসী হইত না, সে নিজেরই আমাকে এ কথা বলিয়াছে। শিশুকালেই তাহার ব্যবহার ও কথা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিল। ক্লাসের ছেলেরাও সকলে তাহাকে ভালবাসিত।”
স্কুল জীবনের শিক্ষক শ্রী কুমুদরঞ্জন মল্লিকের প্রতি কাজী নজরুল ইসলামের শ্রদ্ধা আজীবন অটুট ছিল। পরবর্তীতে নজরুলকে কলকাতায় দেখতে আসেন কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক। সেই ঘটনার অত্যন্ত সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন মুজফ্ফর আহ্মদ তাঁর ‘কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথায়’।
স্কুল জীবনের শিক্ষক শ্রী কুমুদরঞ্জন মল্লিকের প্রতি কাজী নজরুল ইসলামের শ্রদ্ধা আজীবন অটুট ছিল। পরবর্তীতে নজরুলকে কলকাতায় দেখতে আসেন কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক। সেই ঘটনার অত্যন্ত সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন মুজফ্ফর আহ্মদ তাঁর ‘কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথায়’।
“নজরুল যে এক সময়ে মাথরুনের হাইস্কুলে পড়েছে এবং কবি শ্রী কুমুদরঞ্জন মল্লিক যে সেই স্কুলে তার শিক্ষক ছিলেন এই কথা আমরা প্রথম তার মুখেই শুনি। সে যখন ১৯২০ সালের মার্চ মাসে ফৌজ হতে ফিরে আসে তখন বাঙলা দেশে কবি কুমুদরঞ্জনের এই গানটি-
‘মাঝি তরী হোথা বাঁধব নাকো আজকে সাঁঝে’
বড় বেশী জনপ্রিয় হয়েছিল। কেউ নজরুলকে এই গানটি গাইতে অনুরোধ করা হতেই প্রথমে কথাটা ওঠে। তখনই সে বলেছিল সে কিছুদিন মাথরুন হাইস্কুলে পড়েছিল এবং কবি কুমুদরঞ্জন তার শিক্ষক। সে গর্বের সঙ্গেই কথাটা আমাদের বলেছিল। তার কিছুদিনের ভিতরে কবিতা লিখে নজরুল নাম করে ফেলে। এই সময়ে আমরা কজন একদিন দুপুরবেলা ৩২, কলেজ স্ট্রীটে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে বসে কথাবার্তা বলছিলেম। নজরুল ইসলামও সামিল হয়েছিল আমাদের আলোচনায়। সেই সময় পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় এসে খবর দিল যে কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক নজরুলকে দেখতে এসেছেন এবং নীচে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছেন। শুনেই নজরুল খালি পায়েই নীচের দিকে ছুটল, জুতোর ভিতরে পা গলাবার সময়টুকুও সে নষ্ট হতে দিল না। সে কি করে দেখবার জন্যে আমরাও তার পিছে পিছে ছুটলাম। গিয়েই নজরুল প্রথমে কবি কুমুদরঞ্জনের পায়ের ধূলো নিল, আর তারপরে তাঁকে সসম্মানে সঙ্গে করে দোতলায় নিয়ে এলো। কবি কুমুদরঞ্জন যে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকলেন, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে ওপরে গেলেন না, তার কারণ এই ছিল যে নজরুল কিভাবে তাঁকে গ্রহণ করবে এই বিষয়ে তাঁর মনে সংশয় ছিল। নজরুলের সেই কোন্ ছোটবেলায় তিনি তাকে দেখেছিলেন! নজরুলের ব্যবহারে কিন্তু তিনি আনন্দিত হয়েছিলেন। দুই কবি একত্র হওয়ার পরেও যে কবিতার আবৃত্তি শুরু হলো না তাতে আমি অন্তত খুব খুশী হয়েছিলেম। তাঁরা অনেকক্ষণ অনেক আলাপ-আলোচনা করলেন। নজরুল নিজের সব খবর তাঁকে জানাল। কথায় কথায় সে কবি কুমুদরঞ্জনকে বলে ফেলল যে, ‘স্যার আমিও আপনার মতো পাগল।’ শুনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম যে – ‘খেপাটা আবার একি বলে বসল।’ কিন্তু, কবি কুমুদরঞ্জনের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে সেখান থেকে নজরুলের প্রতি স্নেহ ঝরে পড়ছে।”
‘স্যার আমিও আপনার মতো পাগল।’ শুনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম যে – ‘খেপাটা আবার একি বলে বসল।’ কিন্তু, কবি কুমুদরঞ্জনের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম যে সেখান থেকে নজরুলের প্রতি স্নেহ ঝরে পড়ছে।”
পরবর্তীতে কাজী নজরুল ইসলাম হিজ মাস্টার্স ভয়েস গ্রামোফোন কোম্পানির পক্ষে ৩৭/১ সীতানাথ রোড,কলিকাতা থেকে তাঁর শিক্ষক কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিককে একটি চিঠি লিখেন। স্বল্প দৈর্ঘ্যের এই চিঠিতে শিক্ষকের প্রতি তাঁর যে আচরণ ফুটে উঠেছে, তা সত্যিই শিক্ষণীয়।
37/1, Sitanath Road
Calcutta
06.04.1936
শ্রীচরণারবিন্দেষু,
বহুদিন আপনার শ্রীচরণ দর্শন করিনি- কলকাতায় এলে খবর দেবেন যেন। আমি বর্তমানে H.M.V Company-র Exclusive Composer. তাদেরই নির্দেশ মতো আপনার কাছে একটি নিবেদন জানাতে এই পত্র লিখছি। আপনার ‘অধরে নেমেছে মৃত্যু-কালিমা’ গানটির Permission (রেকর্ড করার জন্য) চান কোম্পানি। এর আগে আপনার দু-চারটি গান আছে রেকর্ডে। আপনি যদি উক্ত কোম্পানিকে চিঠি দেন, আপনার গানের Royalty (5% Commission) পাবেন। আপনার অনুমতি পেলেই কোম্পানি আপনাকে Royalty দেওয়ার অঙ্গীকারপত্র পাঠিয়ে দেবে। আশাকরি পত্রোত্তর পাব। নিবেদন ইতি –
প্রণত– নজরুল ইসলাম
P.S. আপনার ঐ গানের সঙ্গে আরও কোন গান গাইলে ভালো হয় তা যদি নির্দেশ করেন, বা লিখে পাঠান সেই গানটি, ভালো হয়।
– নজরুল
১৯৩৭ সালের ২৮শে অক্টোবর নজরুল ৫৩-জি, হরিঘোষ স্ট্রীট, কলকাতা থেকে তাঁর শিক্ষককে আরও একখানা চিঠি দেন। এই চিঠি থেকে জানা যায় যে, অত্যন্ত জনপ্রিয় শিল্পী শ্রীমতী ইন্দুবালা দেবী কবি কুমুদরঞ্জনের লেখা দুটি গান গাইবার ইচ্ছে পোষণ করেছেন। গ্রামোফোন কোম্পানীতে রেকর্ড করার জন্যই সেই গান দুটি নজরুল তাঁর শিক্ষককে পাঠানোর অনুরোধ জানান।
৫৩-জি, হরিঘোষ স্ট্রীট
কলিকাতা
২৮-১০-১৯৩৭
শ্রীচরণারবিন্দেষু ,
প্রনাম শতকোটি অন্তে নিবেদন:
বহুপূর্বে আপনার এক আশীর্বাদী পত্র পেয়েছিলাম। আপনার ‘অধরে নেমেছে মৃত্যুকালিমা’ শীর্ষক গানটির কথাগুলি ও তার সাথে অন্য একটি গান (যা ওর জোড় হতে পারে) যদি অনুগ্রহ করে পাঠিয়ে দেন,তাহলে বিশেষ বাধিত হব। শ্রীমতী ইন্দুবালা ঐ গান দুটি গাইতে চান। আপনার প্রেরিত গান দুটি পেলেই রেকর্ড করা হবে। গ্রামোফোন কোম্পানি – আপনাকে প্রত্যেক রেকর্ডে শতকরা আড়াই টাকা হিসেবে রয়ালটি দিতে চান – একসঙ্গে টাকা নেওয়ার চেয়ে এতে বেশি লাভ হবে। গ্রামোফোন কোম্পানি আপনার গান পেলে ঐ শর্ত আনুসারে এগ্রিমেন্ট দেবে। যত শীঘ্র পারেন, গান দুটি পাঠিয়ে দেবেন। বিজয়ার প্রণাম নেবেন। আশা করি কুশলে আছেন।
প্রণত নজরুল
নিবেদনমিতি
স্কুল জীবনে কবি কুমুদ রঞ্জন মল্লিককে শিক্ষক হিসেবে নজরুল বেশিদিন পাননি। কিন্তু শিক্ষকের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা আজীবন অক্ষুণ্ন ছিল। পরবর্তীতে পেশাগত জায়গায় তাঁদের মধ্যে পুনরায় যোগাযোগ গড়ে ওঠে।
তৎকালীন সময়ে খ্যাতনামা কবি, জগত্তারিণী স্বর্ণপদক এবং পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত কবি কুমুদরঞ্জন তাঁর ছাত্রের নীরব হয়ে যাওয়া মেনে নিতে পারেননি। ‘দেবদূত’ কবিতাটির মাধ্যমে তিনি তাঁর অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন।
দেবদূত
স্বর্গ হতে দেবদূত এলো
মুক্তির বাণী লয়ে
কার ডাক শুনি, সহসা থামিল
গেল প্রস্তর হয়ে?
কি সঙ্গীত যে শ্রবণে পশিল
মুখরে করিল মূক?
পথ হারাইল মহাবাণী তার-
দুখে ফেটে যায় বুক।
এভাবেই শিক্ষকের কলমে আমরা যেমন কিশোর, তরুণ, তেজস্বী নজরুলকে পাই, ঠিক তেমনই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যাওয়া ছাত্রের প্রতি তাঁর যে সমবেদনা প্রকাশ পেয়েছে তা পাঠ করার সঙ্গে সঙ্গে নজরুলপ্রেমী হিসেবে আমরা আরও একবার অশ্রুসিক্ত হই।
তথ্যঋণ:
- নজরুল স্মৃতি, বিশ্বনাথ দে সম্পাদিত
- কিশোর কবি নজরুল, রফিকুল ইসলাম
- নজরুলের পত্রাবলি
- কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা, মুজফ্ফর আহ্মদ
- শত কথায় নজরুল, কল্যাণী কাজী সম্পাদিত