বুদ্ধদেব অরণ্য পেরিয়ে অজানা এক অভিযানে

বুদ্ধদেব গুহ। ছবি: সংগৃহীত
“আমি নিশিদিন তোমায় ভালোবাসি/ তুমি অবসরমতো বাসিও, নিশিদিন হেথায় বসে আছি/ তোমার যখন মনে পড়ে আসি”
কী? একটু চেনা লাগছে কি? অনেকেই বলবেন যে- “হ্যাঁ খুব সহজেই যাচ্ছে চেনা, এ তো রবীন্দ্রসঙ্গীত!” কিন্তু আপনি যদি হয়ে থাকেন বাংলা উপন্যাসপ্রেমী কোনো পাঠক, তাহলে খুব সহজেই এর যোগসূত্র স্থাপন করতে পারবেন আপনার পড়া বেশ কয়েকটি উপন্যাসের সাথে,তা সে হোক সবিনয় নিবেদন, একটু উষ্ণতার জন্য বা বাসনাকুসুম! আর সেই সাথে মনের মধ্যে ভেসে উঠবে বুদ্ধদেব গুহের ছবি!
প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ (৮৫) আর নেই। দীর্ঘদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় থাকার পর রবিবার (২৯ আগস্ট) স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ১১টার দিকে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পাড়ি দিতে হয়েছে না ফেরার দেশে।
বুদ্ধদেব গুহ একজন ভারতীয় বাঙালি ঔপন্যাসিক ও সংগীতশিল্পী। ১৯৩৬ সালে ২৯ জুন কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন বুদ্ধদেব গুহ। কলকাতায় জন্ম হলেও তাঁর ছোটবেলা কেটেছিল পূর্ব বঙ্গের বরিশাল ও রংপুরে।কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সুপরিচিত সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুল ও স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়াশুনা করেন। পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন চাটার্ড অ্যাকাউন্ট হিসেবে। ছিলেন একজন নামী চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট। দিল্লির কেন্দ্রীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে পশ্চিমবঙ্গের আয়কর বিভাগের উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য নিযুক্ত করেছিল। আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের অডিশন বোর্ডের সদস্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের সদস্যও ছিলেন তিনি। বামফ্রন্ট আমলে তাকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বনবিভাগের বন্যপ্রাণী উপদেষ্টা বোর্ড পশ্চিমবঙ্গ বিভাগের উপদেষ্টা বোর্ড এবং নন্দন উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য করা হয়েছিল। বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনে পরিচালন সমিতির সদস্যও নিযুক্ত হয়েছিলেন। বুদ্ধদেব গুহ খুব সুন্দর ছবিও আঁকতেন। নিজের লেখা একাধিক বইয়ের প্রচ্ছদ তিনি নিজেই এঁকেছেন। তাঁর স্ত্রী প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়িকা ঋতু গুহ ২০১১ সালে প্রয়াত হন। বুদ্ধদেব নিজেও ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন এবং তিনি পুরাতনী টপ্পা গান গাওয়াতে বেশ পারদর্শী ছিলেন।

রচনাশৈলীর অনন্যতা ও স্বাতন্ত্র্য তাকে বাঙালি পাঠকের অন্যতম প্রিয় লেখকে পরিণত করেছে। প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ‘জঙ্গল মহল’। এরপর থেকে ‘মাধুকরী’, ‘কোজাগর’, ‘অববাহিকা’, ‘বাবলি’— একের পর এক উপন্যাস উপহার দিয়েছেন পাঠকদের। কিশোর সাহিত্যেও ছিল অবাধ বিচরণ। তার সৃষ্ট ‘ঋজুদা’ বা ‘ঋভু’র মতো চরিত্র আকৃষ্ট করে রেখেছে কয়েক প্রজন্মের বহু কিশোর-কিশোরীর মনকে। বুদ্ধদেব গুহ-র বই সমগ্র শুধু উপন্যাস হিসেবে নয়, নগর ও অরণ্যের স্তুতি হিসেবে পাঠকের কাছে ভালোবাসার স্থান পেয়েছে। লেখালেখির পাশাপাশি বুদ্ধদেব গুহ-র বই সমূহ থেকে নির্মিত হয়েছে একাধিক টিভি অনুষ্ঠান ও চলচ্চিত্র। তাঁর রচনার জন্য তিনি বাংলা কথাসাহিত্যে এক মাইলফলক তৈরি করেছেন। পেশায় তিনি একজন সফল চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট, জীবনযাপনের ধরনে খুবই শহুরে। কিন্তু ভেতরকার যে আদিম আরণ্যক ডাক, তা যেন তার লেখায়ই ধরা পড়ে তার জীবনচিত্রের চাইতে অনেকগুণ স্পষ্ট হয়ে।
বুদ্ধদেবকে বলা চলে আরণ্যক এক ঔপন্যাসিক। তাঁর উপন্যাস যেন পরিপূর্ণই হয়ে ওঠে না যতক্ষণ পর্যন্ত না তাঁর গল্পের প্লটজুড়ে ভেসে উঠছে নাগরিক-ক্লেশমুক্ত এক অরণ্যময় প্রকৃতি! পালামৌর বুনো হাতি, পৌরুষ মাখানো বাঘিনী অথবা পাকদন্ডীর কুয়াশার রাস্তা, ম্যাকলাস্কিগঞ্জের সেই সকালের আগমন- এই তো বুদ্ধদেবের উপন্যাস। তাতে থাকতেই হবে নগরবিদ্বেষী এক নায়ক যে অরণ্যে এসে খুঁজে পেয়েছে অপার স্বস্তি ও সারল্যের জীবন। তুলনা নয়, বরং বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক উপন্যাসটির সাথে সাদৃশ্য বলা চলে বুদ্ধদেবের ক্ষেত্রে। তবে ব্যাপার হচ্ছে এই যে, বুদ্ধদেব গুহের উপন্যাসের সফল প্লট কিংবা কাহিনীছন্দ যা-ই বলা হোক না কেন, তা আরণ্যক হয়েই সুর তোলে।
চিঠির প্রতিও বুদ্ধদেবের একটা গভীর আকর্ষণ দেখা যায়। প্রায় উপন্যাসেই এ ওকে চিঠি পাঠায়, সেই চিঠি পুরো সময় জুড়ে একটা সুরেলা গান হয়ে বাজতে থাকে। বুদ্ধদেব খুব সুন্দর করে চিঠি লিখতেন, তাঁর যেকোনো উপন্যাস পড়লেই তা বোঝা যায়! ‘সবিনয় নিবেদন’ উপন্যাসটি তো পুরোটাই চিঠিপোন্যাস! ঋতি ও রাজর্ষি একজন আরেকজনকে না দেখে না শুনে চিঠির এক অদ্ভুত ব্যাকরণে বুনতে থাকে তাদের সম্পর্ককাব্য। অদেখাকেও যে চিঠি লিখে প্রিয় ব্যক্তিতে রূপ দেওয়া যায়, তার সাথে খুনসুটি করা যায়, করা যায় অভিমানী অভিযোগ, চিঠি লিখে যে কাউকে ভালোবাসাও যায়- তার এক অনবদ্য প্রমাণ ‘সবিনয় নিবেদন।
তাঁর ছোট গল্প ও উপন্যাসে পাঠক পায় এক স্বপ্নালু বিমূর্ততা আর রোমান্টিক আবেদন। গল্পের চরিত্রগুলোর জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে পাঠক তাই খুব সহজেই যখন-তখন ডুব দিতে পারে বুদ্ধদেবের লেখায়। প্রথমদিকের লেখাগুলোয় তার লেখক-ইমেজটুকু প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য বুদ্ধদেব গুহ এমন কিছু চরিত্রই বেছে নিয়েছিলেন যাদের সাথে পাঠক পড়ামাত্র নিজেকে যুক্ত করতে পারে। কারণ তিনি বুঝেছিলেন মানুষ নিজের প্রতিফলন দেখতে ভালোবাসে। তাঁর এই শৈলী যে পরে যে খুব বেশি পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে তা নয়, তিনি এক প্রকৃত অনুসন্ধানকারী, প্রকৃতি ও মানবমনের আদিম যে বেষ্টনী আছে তাকে যেন নিজের অভ্যন্তর থেকে টেন বের করে আনেন বুদ্ধদেব। এ বেষ্টনী এমন এক চির-সম্পর্ক যার উপস্থিতি আমরা প্রতিনিয়ত টের পাই, কিন্তু তা স্বীকার করতে পারি না। হয়তো বুদ্ধদেবের লেখা পড়ে সেই অস্বীকৃতিটাই বুক চিরে বের হয় ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস হয়ে। কখনও কখনও পাঠকের এমন দীর্ঘশ্বাসই লেখকের সফলতা, আর বুদ্ধদেব এদিক দিয়ে প্রচন্ড সফল লেখক!
একজন লেখকের প্রিয়-অপ্রিয়, ঘটমান-বিচ্ছেদ্য সবকিছুই ছাপ ফেলে তার লেখনীতে। আর জীবনের সঙ্গে যখন মিল দেখা দিতে থাকে, তখনই একজন লেখক সর্বোচ্চ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন যেকোনো রচনার ক্ষেত্রে। বুদ্ধদেব গুহের ক্ষেত্রেও ব্যত্যয় ঘটেনি লেখালেখির জগতে খুব পরিচিত এই নিয়মটির। ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের প্রায় সমস্ত দেশ, কানাডা, আমেরিকা, হাওয়াই, জাপান, থাইল্যান্ড ও পূর্ব আফ্রিকাসহ বহু জায়গায় ঘুরেছেন এই মানুষটি। বারবার প্রকৃতির নেশায় বুঁদ হয়ে রয়েছেন তিনি। বিভিন্ন জায়গা, তাতে বাস করা মানুষের ভিন্ন জীবনের বিপরীতমুখী মাত্রা- সবকিছুর স্বাদই গ্রহণ করেছেন বুদ্ধদেব। তাঁর এই সম্পর্কগুলোকে আমরা বারবার তাঁর গল্প-উপন্যাসের নায়কের সম্পর্কগুলোর মধ্যে দেখি। পূর্ব বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ) জয়পুরহাট, বরিশাল ও রংপুরে কাটানো তাঁর দিনগুলোর ছায়া পড়েছে ‘ঋভু’ সিরিজের বইগুলোতে। তাই ‘ঋভু’র বেশ কিছু বইয়ের উৎসর্গপত্রে লেখা আছে বুদ্ধদেবের পুরাতন বাংলাদেশী কিছু বন্ধুর নাম।

আত্মজীবনী লিখলে একবার নিজের কথা লেখা যায়, বুদ্ধদেব তার প্রতিটি উপন্যাসের মধ্য দিয়ে বারবার নিজের কথা লিখতে পেরেছেন, কেননা ভ্রমণ তাঁর জীবনে এনে দিয়েছে বহুমাত্রিকতা। তিনি যতবারই লিখতে চেয়েছেন, নতুন করে লিখেছেন, গ্রীক দার্শনিক হেরাক্লিটাসের ধারণামতো বুদ্ধদেবও কখনো একই নদীতে পা ডোবাননি। বিচিত্র জীবন তাঁকে উপহার দিয়েছে বহুমোহনায় ডুব দেবার, বহুমাত্রিক কাহিনী রচবার উপাদান ও উপকরণ।
পূর্বভারতের বনজঙ্গল-পশুপাখি ও বনের মানুষের সঙ্গেও সুদীর্ঘকালের নিবিড় ও অন্তরঙ্গ পরিচয় তার। ভ্রমণের একটি হতাশাজনক দিক এই যে কোনো জায়গায় থিতু হওয়া যায় না, গতির মধ্যে থাকতে হয়। যেমন আজ এখানে তো কয়েকদিন পর অন্য কোথাও যেতেই হবে। এজন্যই হয়তো এর নাম- ‘ভ্রমণ’! বুদ্ধদেব গুহ এই ভ্রমণকে, তাঁর সাথে জড়িয়ে থাকা তাৎক্ষণিক কিংবা দীর্ঘস্থায়ী অনুভূতিগুলোকে একেকটা ফ্রেমে আবদ্ধ করেছেন। আমরা সেই ফ্রেমগুলোকে বলি- ‘বই’!
বুদ্ধদেব ‘ঋজুদা’ বলে একটি চরিত্রের স্রষ্টা। এই ঋজুদা যখন-তখন রুদ্রকে সাথে নিয়ে চলে যান জঙ্গলে! বুদ্ধদেবের ভ্রমণগুলো ঋজুদা ও রুদ্রের ছলেই পাঠক গোগ্রাসে গিলতে থাকে। ঋজুদা নিয়ে একটি বই হলো ‘ঋজুদার সঙ্গে জঙ্গলে’।
বুদ্ধদেবের উপন্যাস ‘মাধুকরী’ বাংলা সাহিত্যের জগতে সত্যিকার অর্থেই একটি মাইলফলক হয়ে বিরাজ করছে। পৃথু, কুর্চি, রুষা, মগনলাল, ঠুঠা- এ সকল চরিত্রের মধ্যে কিছু একটা জাদু ছড়িয়ে আছে যা এড়ানো সম্ভব নয় কোনো পাঠকের পক্ষেই। এই উপন্যাসে কেউ কারো পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান করে না, এত সমান্তরালভাবে চরিত্রগুলোকে সম্পৃক্ত রেখেও বয়ে যেতে দিতে বুদ্ধদেবই পারেন! তাই তো বহুদিন ধরেই বেস্টসেলার হয়ে আছে তার ‘মাধুকরী’ বইটি। ১৯৭৬ সালে আনন্দ পুরষ্কার ছাড়াও বুদ্ধদেব পেয়েছেন শিরোমণি ও শরৎ পুরষ্কার।
শহুরে জীবনের এই আরণ্যক ঔপন্যাসিক পাঠককে যে স্বাদ উপহার দিয়েছেন তা তাঁর পাঠকদের মনে বন্ধন-মুক্তির এক গাঢ় ছাপ ফেলে যাবে আজীবন। ঋজুদা আর ঋভুর সঙ্গে আজ তাঁদের স্রষ্টাও পারি দিয়েছেন রহস্যমাখা গন্তব্যে, হয়ত গান ধরেছেন নিজের পছন্দের। অরণ্য পেরিয়ে অজানা এক গন্তব্য, এই অভিযানের কোনও শেষ নেই।