বঙ্গবন্ধু ও নজরুল: দুই বিপ্লবীর যুগলবন্দিতা

২৪ মে, ১৯৭২ ঢাকায় ‘কবি ভবনে’ বঙ্গবন্ধু কাজী নজরুল ইসলামকে পুষ্পমাল্যে বরণ করছেন। ছবি: সংগৃহীত
শোকের এ মাসে, জনক হারানোর এ মাস আগস্ট হলো বাঙালি জাতির জন্যে, বাংলা ভাষাভাষীদের জন্যে এক অপূরণীয় কষ্টের মাস। বাংলা মাসের হিসেবে বারো ভাদ্র জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মহাপ্রয়াণের দিন। জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে ছিল এক অনন্য যুগলবন্দিতা। দুজনেই বাংলা মায়ের অপরাজেয় বীর, দুজনেই ট্র্যাজেডির নায়ক।
তাঁরা উভয়েই প্রবল জাতীয়তাবাদী। তাঁদের এই জাতীয়তাবাদের শেকড় এক জায়গাতেই প্রোথিত। আর এই জাতীয়তাবাদ মানেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বিবিসি’র জরিপে এই দুই বাঙালির একজন দখল করে আছেন সর্বকালের সেরা বাঙালির এক নম্বর স্থানটি আর অন্যজন দখল করেছেন তিন নম্বর স্থানটি। এই দুই বাঙালির প্রথমজন হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর অন্যজন বাঙালির জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্মে এ দুই বিপ্লবী হয়ে আছেন ইতিহাস।
এই দুই বাঙালির প্রথমজন হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর অন্যজন বাঙালির জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্মে এ দুই বিপ্লবী হয়ে আছেন ইতিহাস।

১৯২০ সালের ১৭ মার্চে যখন টুঙ্গিপাড়ায় শেখ মুজিবের জন্ম হয় তখন নজরুল মার্চ-এপ্রিলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গনে যুদ্ধের শেষের দিকে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পদে কর্মরত। যুদ্ধফেরত হয়ে নজরুল জুলাই ১২ তারিখে শেরে বাংলার সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নেন বন্ধু মুজফফর আহমদের সঙ্গে। নজরুল যে সময় কলকাতায় হয়ে ওঠেছেন সবার নয়নমণি তখন মুজিব তাঁর নয়নজোড়া নিয়ে পড়েছেন বিপদে। কলকাতার বিখ্যাত চক্ষু সার্জন ডা. টি আহমদের কাছে যখন মুজিব চিকিৎসা নেন তখন নজরুলের গানে-কবিতায় বুঁদ হয়ে আছে কলকাতা। গ্লুকোমার চাপে ১৯৩৬ সাল থেকে চশমা পড়া মুজিব প্রথম কবি কাজী নজরুলকে দেখতে পান সশরীরে ১৯৪১ সালে ফরিদপুর ছাত্রলীগের জেলা সম্মেলনে। সেই সম্মেলনে অন্যান্য শিক্ষাবিদের সঙ্গে আমন্ত্রিত ছিলেন কবি কাজী নজরুল। পুলিশ সে সভায় ১৪৪ ধারা জারি করার কারণে সভা হলো না, হুমায়ূন কবির সাহেবের বাড়িতে কনফারেন্স হলো আর তাতে গান করলেন কাজী নজরুল ইসলাম। এভাবেই প্রথম সশরীরে সাক্ষাৎ হয় মুজিব ও নজরুলের।এরপর ১৯৫২ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে জেল হতে মুক্তি পান মুজিব। মে মাসে পশ্চিম পাকিস্তানে লাহোর হয়ে করাচী যান মুজিব। উদ্দেশ্য গুরু শহীদ সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। করাচিতে শহীদ সাহেবের সঙ্গে গাড়িতে চলাকালীন পেছনে বসা শহীদ সাহেবের পেশাগত বন্ধু অ্যাডভোকেট সাহেবরা মুজিবের কাছে বাংলা ভাষার আন্দোলন প্রসঙ্গে জানতে চেয়ে নজরুল ইসলামের কবিতা শুনতে চেয়েছিলেন। মুজিব তাদের ‘কে বলে তোমায় ডাকাত বন্ধু’, ‘নারী’, ‘সাম্য’সহ আরও কয়েকটা কবিতার কিছু কিছু অংশ এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কবিতাও দু’একটার কয়েক লাইন শোনালেন যা শহীদ সাহেব তৎক্ষণাৎ ইংরেজি তর্জমা করে বুঝিয়ে দেন। এ থেকে বুঝা যায়, মুজিবের কবিতা পাঠের অভ্যাস ছিল এবং নজরুলের কবিতা তাঁর নিয়মিত চর্চায় ছিল। আরও বুঝতে অসুবিধা হয় না যখন জানা যায় মুজিবের ছোটবেলা হতেই তাদের বাড়িতে ‘সওগাত‘, ‘দৈনিক আজাদ‘, ‘মাসিক মোহাম্মদী‘ পত্রিকাগুলো রাখা হতো। অর্থাৎ ছোটবেলা হতেই মুজিব এসব পত্রিকা মারফত নজরুলের লেখা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন।
করাচিতে শহীদ সাহেবের সঙ্গে গাড়িতে চলাকালীন পেছনে বসা শহীদ সাহেবের পেশাগত বন্ধু অ্যাডভোকেট সাহেবরা মুজিবের কাছে বাংলা ভাষার আন্দোলন প্রসঙ্গে জানতে চেয়ে নজরুল ইসলামের কবিতা শুনতে চেয়েছিলেন। মুজিব তাদের ‘কে বলে তোমায় ডাকাত বন্ধু’, ‘নারী’, ‘সাম্য’সহ আরও কয়েকটা কবিতার কিছু কিছু অংশ এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কবিতাও দু’একটার কয়েক লাইন শোনালেন যা শহীদ সাহেব তৎক্ষণাৎ ইংরেজি তর্জমা করে বুঝিয়ে দেন।

নজরুল চাঁদপুরে এসেছিলেন ১৯২১ সালের ৮ জুলাই। কুমিল্লা হতে কলকাতা যাওয়ার পথে যাতায়াত ভাড়া সংকটে তিনি একদিন চাঁদপুরে ডাক বাংলোয় রাত্রি যাপন করলেও নৌপথে বরিশাল, ফরিদপুর, মাদারীপুরে যাওয়ার সময় তিনি আরও অনেকবার চাঁদপুরের নৌ-পথ দিয়ে যান। বঙ্গবন্ধু ১৯৫৩ সালে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হককে নিয়ে চাঁদপুর আসেন প্রথমবার এবং শেষবার আসেন ১৯৭৪ সালের ২৫ জুলাই তারিখে ‘ইনভেস্টিগেটর’ নামে বিআইডব্লিউটি এর জাহাজে চড়ে পুরানবাজারের নদী-ভাঙন পরিদর্শন করতে। এর মাঝে আরো কয়েকবার চাঁদপুরে আসেন এবং নজরুলের মতো বেশ কয়েকবার চাঁদপুরের নৌ-পথ দিয়ে যাতায়াত করেন।
নজরুল বাংলাদেশ‘ কথাটি কবিতায় ব্যবহার করেন ১৯৩১ সালে। তিনি লেখেন, ‘নমঃ নমঃ নমঃ বাংলাদেশ মম, চির মনোরম চির মধুর’ আর বঙ্গবন্ধু সেই কবিতাকে ঊনিশশো মর্মে গেঁথে রেখে ১৯৪৭–৪৮ সাল থেকেই বাংলাদেশ শব্দটি চেতনায় ধারণ করেন। এই শব্দটিকে তিনি ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর তারিখে মনের গভীর থেকে মুক্তি দেন। তিনি পূর্ব বাংলাকে নিয়ে গঠিত দেশের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ।
নজরুল বাংলাদেশ‘ কথাটি কবিতায় ব্যবহার করেন ১৯৩১ সালে। তিনি লেখেন, ‘নমঃ নমঃ নমঃ বাংলাদেশ মম, চির মনোরম চির মধুর’ আর বঙ্গবন্ধু সেই কবিতাকে ঊনিশশো মর্মে গেঁথে রেখে ১৯৪৭–৪৮ সাল থেকেই বাংলাদেশ শব্দটি চেতনায় ধারণ করেন। এই শব্দটিকে তিনি ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর তারিখে মনের গভীর থেকে মুক্তি দেন। তিনি পূর্ব বাংলাকে নিয়ে গঠিত দেশের নাম ঘোষণা করেন বাংলাদেশ। বৃটিশ আমলে মাদারীপুরের বিপ্লবী অধ্যক্ষ পূর্ণ চন্দ্র দাস তখন তরুণ বিপ্লবী শেখ মুজিবের প্রেরণা। একসময় বৃটিশের হাতে বিপ্লবী পূর্ণ চন্দ্র ধৃত হন এবং পরবর্তীতে কারামুক্ত হন। নজরুল পূর্ণচন্দ্রের কারামুক্তিতে কালিপদ’র অনুরোধে ১৯২২ সালে বহরমপুর জেলে বসে লেখেন কবিতা, ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’। কবিতাটি যাতে কর্তৃপক্ষের চোখে না পড়ে সেজন্যে পাউরুটির ভেতর কাগজটা ঢুকিয়ে তিনি পাচার করেন কালিপদ’র কাছে। কালিপদ কবিতাটি মুখস্থ করে জেল থেকে বের হয়ে দ্রুত হবহু দুই কপি লিখে ফেলেন। পরবর্তীতে কবিতাটি বিপ্লবী পূর্ণচন্দ্র দাসের কারামুক্তির সংবর্ধনা উপলক্ষে কালিপদ কর্তৃক পঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই কবিতার চরণ হতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি ‘জয় বাংলা’ গ্রহণ করেন। ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’ কবিতায় কবি বলেছিলেন—

‘জয় বাংলার পূর্ণ চন্দ্র, জয় জয় আদি-অন্তরীণ।’ সেই রণধ্বনি দিয়েই আমরা কাবু করেছি একাত্তরে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের।
বাংলাদেশের সঙ্গে নজরুলের সম্পর্ক এত গভীর ছিল যে, ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রথম অধিবেশন আনুষ্ঠানিকভাবে সম্প্রচার হয় ১৯৭১ সালের ২৫ মে, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৮ বঙ্গাব্দে। অর্থাৎ এটি ছিল নজরুলের ৭১তম জন্মদিন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে ক্ষুদ্র মন্ত্রীসভায় প্রস্তাব পাশ হয় নজরুলকে বাংলাদেশে আনার। নজরুলের পরিবার ও ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কথা বলে নজরুলকে শেখ মুজিব বাংলাদেশে আনেন১৯৭২ সালের ২৪ মে এবং নাগরিকত্ব প্রদান করেন। নজরুলকে আনতে তিনি তৎকালিন সংস্কৃতি মন্ত্রী মতিউর রহমান ও আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক মুস্তফা সারোয়ারকে কলকাতা পাঠান এবং নিজে ‘হে কবি…’ বলে কবি ও কবির পরিবারবর্গকে বাংলাদেশে আসার অনুরোধ সম্বলিত চিঠিতে স্বাক্ষর করেন। দুই দফায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিররা গান্ধীর সঙ্গে কথা বলে সম্মতি আদায় করেন। পরবর্তীতে একেবারে রেখে দেয়ার জন্যে ভাসানীর দাবিতে সম্মত হয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে আবারও টেলিফোন করেন।
নজরুলের পরিবার ও ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কথা বলে নজরুলকে শেখ মুজিব বাংলাদেশে আনেন১৯৭২ সালের ২৪ মে এবং নাগরিকত্ব প্রদান করেন। নজরুলকে আনতে তিনি তৎকালিন সংস্কৃতি মন্ত্রী মতিউর রহমান ও আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক মুস্তফা সারোয়ারকে কলকাতা পাঠান এবং নিজে ‘হে কবি…’ বলে কবি ও কবির পরিবারবর্গকে বাংলাদেশে আসার অনুরোধ সম্বলিত চিঠিতে স্বাক্ষর করেন।

তিনি নজরুলকে আমাদের জাতীয় কবি সম্মানে ভূষিত করেন এবং তাঁকে কবি ভবনে রাখার ব্যবস্থা করেন। কবি ভবন বর্তমানে নজরুল ইনস্টিটিউট যার ঠিকানা বাড়ি নং ৩৩০, সড়ক নং ১৫, ভাষা সৈনিক বিচারপতি আব্দুর রহমান সড়ক, ধানমণ্ডি, ঢাকা। মুজিব তাঁকে নিয়মিত দেখতে যেতেন, খোঁজ-খবর রাখতেন। জাতির জনক তাঁর বিছানায় না বসে তাঁর বেডের পাশে হাঁটু মুড়ে বসে কবির সাথে কথা বলেন ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন। প্রথম যেদিন স্বাধীন বাংলাদেশে কবির সাথে জাতির জনকের দেখা হলো, জাতির জনক বিশাল এক ফুলের তোড়া কবিকে উপহার দেন। কবি বঙ্গবন্ধুকে দেখে মুখে বিড় বিড় করে কিছু একটা বলতে চেয়েছিলেন। বাংলা মায়ের এই দুই বিপ্লবীর মিলনপর্বে সেদিন এক অভূপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। বঙ্গবন্ধু নিজে কবি নজরুলের রচিত ‘চল্ চল্ চল্ ঊর্ধ গগনে বাজে মাদল ‘ গানটিকে আমাদের রণসঙ্গীত হিসেব চয়ন করেন।
বঙ্গবন্ধু নিজে কবি নজরুলের রচিত ‘চল্ চল্ চল্ ঊর্ধ গগনে বাজে মাদল ‘ গানটিকে আমাদের রণসঙ্গীত হিসেব চয়ন করেন।

পিকস্ ডিজিজে আক্রান্ত হয়ে নজরুল যেমন অকালে জীবন্মৃত হয়ে ছিলেন, তেমনি ঘাতক আগস্টের ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধুও অকালে জীবন হারান। আগস্ট এই মহান দুই বিপ্লবীকে, দুই সাম্যবাদীকে চিরঘুম পাড়িয়ে রেখেছে বাংলার মায়ার্দ্র মাটিতে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবছর সদ্য পেরিয়ে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্মশত বছরে এই দুই মহা বিপ্লবীকে জানাই লাল সালাম।
বঙ্গবন্ধু এবং নজরুল আমাদের জাতীয় জীবনে দুই স্তম্ভ। একজন স্বাধীনতার মহান স্থপতি আর অন্যজন স্বাধীনতার জাগরণী আনা বিপ্লবী। একজন কথায়, কবিতায় ও গানে আমাদের স্বাধীনতার চেতনাকে উস্কে দিয়েছেন আর একজন আমাদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিয়ে মুক্ত করেছেন। উভয়েই যেমন সাম্যবাদী, তেমনি অসাম্প্রদায়িক এবং তেমনি নিপীড়িত শোষিতের কণ্ঠস্বর। একজন যেমন অগ্নিবীণায় বৃটিশকে পর্যুদস্ত করে তুলেছেন তেমনি অন্যজন সাত মার্চের মহাকাব্যিক ভাষণ দিয়ে জাগিয়ে তুলেছেন বিশ্বকে। বিদ্রোহী কবিতায় নজরুল শাসকের তখতে যেমন আঘাত করেছেন তেমনি ছয়দফা’র মোক্ষম হাতিয়ারে বঙ্গবন্ধু কাঁপিয়ে দিয়েছেন পশ্চিম পাকিস্তানিদের ভিত। পিকস্ ডিজিজে আক্রান্ত হয়ে নজরুল যেমন অকালে জীবন্মৃত হয়ে ছিলেন, তেমনি ঘাতক আগস্টের ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধুও অকালে জীবন হারান। আগস্ট এই মহান দুই বিপ্লবীকে, দুই সাম্যবাদীকে চিরঘুম পাড়িয়ে রেখেছে বাংলার মায়ার্দ্র মাটিতে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবছর সদ্য পেরিয়ে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্মশত বছরে এই দুই মহা বিপ্লবীকে জানাই লাল সালাম।