নজরুলের সৃষ্টিবিশ্ব

কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি : সংগৃহীত
কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) নানা পরিচয়— কবি, গীতিকার ও সুরকার, কথাসাহিত্যিক, শিশু সাহিত্যিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, চলচ্চিত্র পরিচালক ইত্যাদি। সব পরিচয় ছাপিয়ে তিনি মূলত কবি— বিদ্রোহী কবি, প্রেমের কবি, মানবতার কবি, অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি, সাম্যের কবি। সমকালীন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ইত্যাকার পরিম-লে নিজেকে এতটাই ব্যাপৃত রেখেছিলেন যে, তাঁকে সমালোচকবৃন্দ বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, তিনি যুগের কবি— হুজুগের কবি। যুগকে বা কালচেতনাকে তিনি এতটাই গুরুত্ব দিয়েছেন যে, কবিবন্ধু খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন নজরুলকে নিয়ে প্রণীত গ্রন্থের নাম দিয়েছেন ‘যুগস্রষ্টা নজরুল’। তবে কোনো বিশেষ অভিধায় কোনো ব্যক্তিকে যখন অভিহিত করা হয় তখন তাঁর সৃষ্টিশীল ও মননশীল অনেক অভিজ্ঞান য়াকা পড়ে যায়। নজরুলের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছে। কেননা কিছু গান বা কবিতা আছে যেগুলো বিষয়ানুষঙ্গ বিবেচনায় তেমন একটা গুরুত্ব না পেলেও কলানৈপূণ্যে তার তুলনা বিরল। কালের কপোলতালে সেটা হয়ত দ্যুতিছড়াবে কিন্তু বিষয়-বাদীরা তার খোঁজই রাখেন না।
নজরুল কবি পরিচয়ে সমধিক পরিচিত। কিন্তু তাঁর শুরুটা হয়েছিল গল্পের আধিক্য দিয়ে। করাচির সৈনিকজীবনে থাকার সময় সওগাত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, প্রবাসী ও নূর পত্রিকায় প্রকাশিত দশটি রচনার মধ্যে ৬টি গল্প, ৩টি কবিতা ও একটি প্রবন্ধ। শিয়ারসোল রাজ হাইস্কুলে অধ্যয়নের সময় কবিবন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় অন্তত বুঝেছিলেন নজরুল একদিন বড় গল্পকার আর নিজে (শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়) কবি হবেন। কিন্তু নিয়তির কি নিয়ম— হলো তার উল্টোটা। নজরুল হলেন জনপ্রিয়তায় অনন্য এক কালজয়ী কবি।

ক
অগ্নিবীণা (১৯২২), বিষের বাঁশি (১৯২৪), ভাঙার গান (১৯২৪), চিত্তনামা (১৯২৫), সাম্যবাদী (১৯২৫), সর্বহারা (১৯২৬), ফণি-মনসা (১৯২৭), জিঞ্জীর (১৯২৮), সন্ধ্যা (১৯২৯), প্রলয়-শিখা (১৯৩০) প্রভৃতি কাব্য নজরুল সৃষ্টি সম্ভারে বিদ্রোহের ঝড় তুলেছে নিঃসন্দেহে। এ ঝড় রণ-তুর্যবাদকের। বিদ্রোহী আত্মার। দেশপ্রেম, সমাজনীতি, রাজনীতি, ধর্মনীতি নানা আচার-অত্যাচার প্রভৃতি বিষয়াবলম্বনে কবির বিক্ষোভ-বিদ্রোহ, আশা-নিরাশা ইত্যাদি কাব্যরূপ পেয়েছে উপরি-উক্ত কাব্যে। সমকালীন শাসক-সরকারের গায়ে এর উত্তাপ-ঢেউ লেগেছিল বলে বিষের বাঁশি, ভাঙার গান, প্রলয়-শিখা ইত্যাদি কাব্য বাজেয়াপ্ত হয়েছে। শুধু কাব্য নয় প্রবন্ধগ্রন্থ যুগবাণী (১৯২২) এবং গানের সংকলন চন্দ্রবিন্দু (১৯৩১) বাজেয়াপ্ত হয়েছে। আর ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ নামক কবিতা ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় প্রকাশের জন্য উক্ত পত্রিকার ২৬ সেপ্টেম্বর সংখ্যা (১৯২২) বাজেয়াপ্ত করা হয়। শুধু তাই নয় চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহো প্রহসনমূলক বিচারে ১৯২৩ সালের ১৬ জানুয়ারি কবির বিরুদ্ধে রাজদ্রোহিতার অভিযোগ এনে মামলার রায় প্রদান করেন। উক্ত রায়ে ভারতীয় দ-বিধির ১২৪-ক ধারায় ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ এবং ‘বিদ্রোহীর কৈফিয়ত’ লেখার মাধ্যমে রাজদ্রোহের অভিযোগে কবিকে এক বছরের সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়। যা ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে তো বটেই বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত।
নজরুল কবিতার বড় বাঁক বদল হয়েছে অগ্নিবীণা কাব্যের অন্তগত ‘বিদ্রোহী’ নামক কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে। এই ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লেখা হয়েছিল ১৯২২ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে। প্রথম প্রকাশ পায় অবিনাশ ভট্টাচার্য সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ পত্রিকায়। কিন্তু বিদ্রোহী কবিতা হঠাৎ করে লিখেছেন বটে (কবিতাটি শেষ রাতে কলম নয় পেন্সিল দিয়ে লেখা) তবে এর পিছনে কবির অনেক অনুশীলন বর্তমান ছিল।

কবি করাচি সেনা ছাউনিতে থাকার সময় লিখেছেন ‘মুক্তি’ (বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশ) ‘কবিতা সমাধি’ (সওগাত) এবং ‘আশায়’ (প্রবাসী)। আর করাচি থেকে কলকাতায় ফিরে এসে (১৯২০ সালের মার্চ মাস) এক বছর নয় মাস পরে লিখেছেন ‘বিদ্রোহী’। এর মধ্যে লিখেছেন কিছু কালজয়ী কবিতা (প্রায় ৫০টি) যেমন— ‘বাদল রাতের শরাব’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘শাতিল আরব’, ‘আগমনী’, ‘রণভেরী’, ‘আনোয়ার পাশা’, ‘কামাল পাশা’, ‘ফাতেহা-ই-দোয়াজদহম’ (আর্বিভাব ও তিরোভাব), ‘বিজয়িনী’ ইত্যাদি। ‘বাদল রাতের শরাব’ ও ‘খেয়াপারের তরণী’ কবিতার উচ্ছ্বাসিত প্রসংসা করেছিলেন কবি ও সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার। আর ‘আগমনী’ কবিতা সম্পর্কে বলা হয় এটা হল ‘বিদ্রোহী’র সূচনা পর্ব। এখানে দুর্গাবন্দনা, দেশপ্রেম ও মানবিক প্রেম যেভাবে প্রকাশ পেয়েছে, সে বিষয় ও উপস্থাপন কলারীতি কাব্যমোদিদের চমক দিয়েছিলো নিঃসন্দেহে। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা যখন প্রকাশ পেল তখন কাব্যাঙ্গনে পড়ে গেল রীতিমত হৈ চৈ— বাজিমাত। কবিবন্ধু ও সুহৃদ মুজফ্ফর আহ্মদ দাবি করেছেন সাপ্তাহিক বিজলীতে (সপ্তাহে দুই বার বের হয়ে) প্রায় ২৯ হাজার কপি ছাপা হয়েছিল এবং অন্যান্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে প্রায় দেড় থেকে দুই লক্ষ পাঠক কবিতাটি পড়ার সৌভাগ্য পেয়েছিলেন। কোনো কবিতা প্রকাশ পেয়ে এমন অভূতপূর্ব সাড়া— কাড়াকাড়ি! বাংলা সাহিত্যে নয় বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে এমন ঘটনাও বিরল। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার অমোঘ উচ্চারণ হল ‘আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ’, অথবা ‘আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির।’
দোলন-চাঁপা (১৯২৩), ছায়ানট (১৯২৫), পূবের-হাওয়া (১৯২৬), সিন্ধু-হিন্দোল (১৯২৮) ও চক্রবাক (১৯২৯) প্রভৃতি কাব্যে কবির প্রেমিক সত্তায়ই অধিকমাত্রায় আভাসিত। উপরি-উক্ত পাঁচটি কাব্যের মধ্যে নজরুল মানসের অসংযত রোমান্টিক আবেগ-উল্লাস থাকলেও চক্রবাক কাব্যে এসে লাভ করেছে সংহতি, দর্শনের সঙ্গে আত্মলগ্ন হয়ে তা উত্তীর্ণ হয়েছে পরমার্থ-বোধে বলে ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ মনে করেন।
দোলন-চাঁপা (১৯২৩), ছায়ানট (১৯২৫), পূবের-হাওয়া (১৯২৬), সিন্ধু-হিন্দোল (১৯২৮) ও চক্রবাক (১৯২৯) প্রভৃতি কাব্যে কবির প্রেমিক সত্তায়ই অধিকমাত্রায় আভাসিত। উপরি-উক্ত পাঁচটি কাব্যের মধ্যে নজরুল মানসের অসংযত রোমান্টিক আবেগ-উল্লাস থাকলেও চক্রবাক কাব্যে এসে লাভ করেছে সংহতি, দর্শনের সঙ্গে আত্মলগ্ন হয়ে তা উত্তীর্ণ হয়েছে পরমার্থ-বোধে বলে ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ মনে করেন। ইতঃপূর্বের কাব্যসমূহে কবি অধরা প্রেমিকাকে কাছে পাবার জন্য ব্যাকুল হয়েছেন, কিন্তু যখন ব্যর্থতা তাঁকে স্পর্শ করেছে, তখন তিনি বেদনাহত হৃদয়ে উচ্চারণ করেছেন হাহাকার— ধ্বনি। প্রথম পর্বের কাব্যে প্রেমের প্রাঙ্গণে মানবাত্মার শাশ্বতিক বিরহকে তিনি আবিষ্কার করতে পারেননি। কিন্তু চক্রবাক কাব্যে এসে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে কবি উপলব্ধি করেছেন প্রেমের জগতে প্রাপ্তি নয়, বরং অপ্রাপ্তি—মিলন নয় বরং বিরহই চিরায়ত সত্য, শাশ্বত প্রাপ্তি। কবি নজরুল রবীন্দ্রনাথের মতো ‘অবরোহী’ পদ্ধতিতে নয়, বরং জীবনানন্দ দাশ কিংবা বুদ্ধদেব বসুর মতো ‘আরোহী’ পদ্ধতিতে আবিষ্কার করেছেন প্রেমের মৌল-সত্য। এ প্রসঙ্গে ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ আরো বলেন, ‘চক্রবাক’ কাব্যে প্রেমিকার কাছে ‘দোলন-চাপা’র প্রবল উচ্ছ্বাস, ‘ছায়ানট’-এর আত্মলগ্নতার উচ্চকণ্ঠ ঘোষণা কিংবা ‘সিন্ধু-হিন্দোল’-এর মান-অভিমান আর চিত্তবিক্ষোভ নেই, বরং আছে প্রজ্ঞালালিত এবং অভিজ্ঞতালব্ধ এক বিশ্বাত্ম প্রেমবোধ, যার মূল কথা মানবাত্মার শাশ্বত বিরহ। বস্তুত, নজরুল ইসলামের প্রেমচেতনার চিত্রময়, সংহত এবং শিল্পিত প্রকাশ হিসাবে ‘চক্রবাক’ এক বিশিষ্ট নির্মাণ।’

কবির অসুস্থ হবার পর নতুন চাঁদ (১৯৪৫) এবং শেষ সওগাত (১৯৫৮) কাব্যদ্বয় প্রকাশিত হয়। নতুন চাঁদ কাব্যের প্রকাশক এই বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন ‘নতুন চাঁদ বাঙলার জরাগ্রস্ত জীবনে নতুন আনন্দ ও আশার বাণী ধ্বনিত করুক।’ চিত্তনামা (১৯২৫) এবং মরু-ভাস্কর (১৯৫১) জীবনীমূলক রচনা। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বীরত্ব-ত্যাগ ও জীবন নিয়ে রচিত চিত্তনামা এবং হযরত মুহম্মদ (সা.) এর জীবনী নিয়ে রচিত মরু-ভাস্কর। নজরুলের বাক ও সংবিৎরুদ্ধ হলে কাব্যটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
খ
দ্বিতীয় সন্তান বুলবুলের জন্মের মধ্য দিয়ে নজরুল গানের বুলবুলি হয়ে উঠলেন। সময়টা ১৯২৬ সালের শেষ দিক। একদিকে কবির ভগ্নস্বাস্থ্য ও আর্থিক সংকট, অন্যদিকে বুলবুলের আগমনে কবিমনে ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাস’। মাঝখানে ছিল কেন্দ্রীয় আইন সভার সদস্য নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয় এবং ২০ ডিসেম্বর (১৯২৬) মাতৃসম মিসেস এম. রহমানের মৃত্যু। ভাঙা-গড়ার এ সন্ধিক্ষণে কবি নতুন করে সৃষ্টির নেশায় মেতে ওঠেন— রচনা করতে থাকেন ধ্রুপদ, ঠুংরী, গজল, বাউল, কীর্তন, সারি, ভাটিয়ালি, লাউনি, রামপ্রসাদী, ঝুমুর, মুর্শিদা, তোড়ী, ছায়ানট, ভৈরবী, আশাবর, বেহাগ, সাহানা, পিলু, খাম্বাজ ইত্যাদি রাগারাগিনীতে গান। প্রচলিত এ রাগরাগিণী ছাড়াও নিজের সৃষ্টিশীল প্রতিভায় জন্ম নিল রূপ-মঞ্জরী, দোলন-চাঁপা, বনকুন্তলা, সন্ধ্যামালতী, মীনাক্ষী, রেণুকা, অরুণরঞ্জনী, নির্ঝরিণী, উদাসী ভৈরব, অরুণ ভৈরব, আশা ভৈরবী, শিবানী ভৈরবী প্রভতি সুরের গান।
গানের জগতে নজরুলের পূর্বসুরীদের দিকে যদি তাকাই তবে দেখতে পাবো নজরুল বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়, রজনীকান্ত সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গানও গেয়েছেন। এক পর্যয়ে এসে নিজেই কালজয়ী রাগরাগিণী-সুর সৃষ্টি করেছেন। সঙ্গীত সাধনায় রবীন্দ্রনাথ প্রধানত কবি, আর অতুল প্রসাদ প্রধানতকম্পোজার বা সুরস্রষ্টা। সেজন্য অতুল প্রসাদের অনেক গানের কথার প্রকাশ রবীন্দ্র-সঙ্গীতের মতো এতখানি নিটোল নয়। সুরলীলারমধ্যে ভাবের চমৎকার বিকাশই অতুলপ্রসাদের লক্ষ্য, তাই রবীন্দ্রনাথের চেয়ে তাঁর গানে রাগ-রাগিণীর মীড় অধিকতর যত্নে বিন্যস্ত ও বিচিত্র।
গানের জগতে নজরুলের পূর্বসুরীদের দিকে যদি তাকাই তবে দেখতে পাবো নজরুল বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়, রজনীকান্ত সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গানও গেয়েছেন। এক পর্যয়ে এসে নিজেই কালজয়ী রাগরাগিণী-সুর সৃষ্টি করেছেন। সঙ্গীত সাধনায় রবীন্দ্রনাথ প্রধানত কবি, আর অতুল প্রসাদ প্রধানতকম্পোজার বা সুরস্রষ্টা। সেজন্য অতুল প্রসাদের অনেক গানের কথার প্রকাশ রবীন্দ্র-সঙ্গীতের মতো এতখানি নিটোল নয়। সুরলীলারমধ্যে ভাবের চমৎকার বিকাশই অতুলপ্রসাদের লক্ষ্য, তাই রবীন্দ্রনাথের চেয়ে তাঁর গানে রাগ-রাগিণীর মীড় অধিকতর যত্নে বিন্যস্ত ও বিচিত্র। অন্যদিকে নজরুল ইসলাম সুর-ঝঙ্কারে প্রথমত ‘মস্ত্ হয়ে ওঠেন’ কী সুরে গানটি বাঁধবেন সেটি ঠিক করে নেন প্রথমে, তারপর সেই সুরে ফেলে শব্দ সংযোজন করে দেন। এজন্য তাঁর গানে রাগের রূপাবলী অপেক্ষাকৃত অধিক বলে আবদুল কাদির মনে করেন। রবীন্দ্র-নজরুলের গানের তুলনা করে আবদুল কাদির লিখেছেন, ‘রবীন্দ্র সঙ্গীতে আমাদের আত্মা শুনিতে পায় তার ঊর্ধ্বমুখীন কামনার পাখা-ঝাপটানি, আর নজরুল-সঙ্গীতে আমাদের হৃদয়াবেগ তার প্রতি দিনের হাসি-কান্নার লীলায়িত প্রকাশ অনুভব করিতে পায়।’ তিনি আবেদন বিচারে রবীন্দ্র সঙ্গীতকে বলেছেন, ‘এই গান নিঃসঙ্গ জগতের গান, এক প্রশান্ত আত্মবিরহের রসে ইহা উদাস হইয়া আছে। কিন্তু নজরুলের গান রক্তাক্ত আত্মার গান।’

নজরুলের সঙ্গীত প্রতিভার পেছনে বাল্যকালে লেটোর দলের ‘গোদা কবি’ হয়ে গান রচনার বিষয়কে অনেকে গুরুত্ব দিয়েছেন। চারণ কবির মতো মুখে মুখে গান রচনা করে লেটোর দলে তিনি যে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছিলেন তারই ধারাবাহিকতায় দেখেছি রুটির দোকানে কাজের ফাঁকে গান গাওয়া, সুর করে পুথি পাঠ করা, ত্রিশালে এসে মাঠে বসে বাঁশি বাজানো, করাচির সৈনিকজীবনে গানে গানে মুখরিত করে রাখতেন আড্ডাগুলো। ‘ব্যথার দান’ গল্প গ্রন্থে অনেকগুলো গান রয়েছে এমনকি পাত্র-পাত্রীদের পছন্দ নয় শুধু নজরুলের নিজেরও কবিগুরুর গান পছন্দ। আস্তে আস্তে ১৯২৬ সাল থেকে এই গানের পথেই নিজেকে ডুবিয়ে রাখেন— ১৯২৯ সালে গিয়ে সেটা আরো ব্যাপক মাত্রায়। তখন কবিতার চেয়ে গান রচনা ও সুর দেয়া এবং সংগীত পরিচালনা করা নজরুল জীবনে ব্রতী পর্যায়ে চলে যায়। এতে তাঁর অনেক খ্যাতি-যশ এমনকি অর্থও এসেছে। তবে রেডিও ও গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে সম্মানি ও পারিশ্রমিক যথাযথভাবে পাননি। গান ভাল চল্লেও কোম্পানির লোকেরা নজরুলকে নায্য পাওনা থেকে কবিকে বঞ্চিত করেছেন। এজন্য এ বিষয়টি টেনে কবি একদিন আক্ষেপ করে বলেছেন,‘এতদিন আমি কুকুরের সেবা করেছি।’
তখন কবিতার চেয়ে গান রচনা ও সুর দেয়া এবং সংগীত পরিচালনা করা নজরুল জীবনে ব্রতী পর্যায়ে চলে যায়। এতে তাঁর অনেক খ্যাতি-যশ এমনকি অর্থও এসেছে। তবে রেডিও ও গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে সম্মানি ও পারিশ্রমিক যথাযথভাবে পাননি। গান ভাল চল্লেও কোম্পানির লোকেরা নজরুলকে নায্য পাওনা থেকে কবিকে বঞ্চিত করেছেন। এজন্য এ বিষয়টি টেনে কবি একদিন আক্ষেপ করে বলেছেন,‘এতদিন আমি কুকুরের সেবা করেছি।’
নজরুল স্বদেশপ্রেমমূলক, মানবিক প্রণয়মূলক, ভক্তিমূলক, প্রকৃতি ও হাসির বিষয়ে প্রায় তিন হাজারেরও অধিক গান রচনা করেছেন। বাংলা সাহিত্যে তো বটে বিশ্ব সাহিত্যেও এ দৃষ্টান্ত বিরল। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, গোবিন্দ রায়, মনোমোহন বসু প্রভৃতি মনীষীদের গানে-কবিতায় জাগরণের সাড়া আছে। আবার দ্বিজেন্দ্রনাথ রায়, কামিনীকুমার ভট্টাচার্য্য, মুকুন্দচন্দ্র দাস স্বদেশপ্রেমমূলক গান রচনা করেছেন। নজরুল বাংলা গানের ঐ ঐতিহ্যের ধারায় স্বদেশপ্রেমমূলক গান রচনা করলেও ‘তাঁর গানে দেশপ্রেমের উন্মাদনা পরাধীনতার জ্বালাও বৈপ্লবিকচেতনা যেভাবে ব্যক্ত হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রেই তার তুলনা নেই। নজরুলের কোরাস গানের কৃতিত্ব সম্পর্কে সুশীলকুমার গুপ্ত বলেছেন, বাংলার জাতীয়তাবাদী মুক্তি সংগ্রামের সময়ে রচিত নজরুলের কোরাসগান যৌথসংগীতের ক্ষেত্রে এক বিশেষ দিক খুলে দিয়েছে। জনগণের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও মুক্তিসংগ্রামস্পৃহা এই সব কোরাস গানের মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠেছে। অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতি গীতিকারদের কোরাস সংগীতের তুলনায় নজরুলের কোরাসগীতি মোটেই হীনপ্রভ নয়।’ সুশীলকুমার গুপ্ত নজরুলের কোরাসগানের প্রশংসা করতে গিয়ে কুণ্ঠিত হয়েছেন মনে হয়। তা নাহলে ‘মোটেই হীনপ্রভ নয়’ জাতীয় বাক্যাংশ প্রয়োগ করতেন না। কিন্তু কথা হল নজরুলের ‘দুর্গম দিরি কান্তার মুরু দুস্তর পারাবার’— এ জাতীয় কোরাস সংগীত বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে? আবার কোরাসগানের একটি বিশেষ ধারা মার্চ-সংগীতেও নজরুল অতুলনীয়। যেমন, ‘আমরা শক্তি আমরা বল আমরা ছাত্রদল’, ‘চল্ চল্ চল্’, ‘এই শিকল-পরা ছল মোদের এ শিকল-পরা ছল’, ‘কারার ঐ লৌহ- কবাট’ ইত্যাদি।

প্রেম সংগীতের মধ্যে গজল গানে নজরুল অপ্রতিদ্বন্দ্বী বলে সুশীলকুমার গুপ্ত অবশ্য উচ্ছ্বাসিত প্রশংসা করেছেন। নজরুলের আগেও গজল রচনা করে অনেকেই খ্যাতি লাভ করেছেন। কিন্তু একথা ঠিক নজরুলই প্রথম স্বার্থকভাবে পারস্য গজলের সুরটিকে বাংলা গানের কাঠামোতে ফুটিয়ে তুলেছেন। নজরুলের ঈর্ষাণীয়মাত্রায় জনপ্রিয় গজলের সংখ্যাও কম নয়। যেমন, ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে আজি দোলা’, ‘আমারে চোখ ঈশারায় ডাক দিলে হায় কে গো দরদী’, ‘ বসিয়া বিজনে কেন একা মনে’, ‘এত জল ও-কাজল চোখে পাষাণী আনলে বল কে’ ইত্যাদি।
ভক্তিমূলক গানের মধ্যে শ্যামাসংগীত ও ইসলামি সংগীতে নজরুল আশ্চর্য উৎকর্ষের পরিচয় দিয়েছেন বলে সমালোচকবৃন্দ মনে করেন। রামপ্রসাদের পরে সবদিক বিচার করলে দেখা যাবে শ্যামাসংগীতে নজরুলের স্থান অনেকেরই উপরে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
আর ইসলামি গানে নজরুলের অবদান কিংবদন্তিতুল্য। আগে যেখানে মুসলিম শিল্পীরা হিন্দু নাম ধারণ করে শ্যামা সংগীত গাইতেন একটা পর্যায়ে এসে নজরুলের অপরিসীম সংগীতিক জাদুশক্তি বলে এবার হিন্দু শিল্পীরাই মুসলিম নাম ধারণ করে ইসলামি গান গাইতে শুরু করেন। বিশেষ করে ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ’ অথবা ‘ইসলামের ঐ সওদা নিয়ে এলো নবীন সওদাগর’ প্রভৃতি গান প্রচারিত হবার পর ধীরেন দাস গণি মিঞা নামে, চিত্ত রায় দেলোয়ার হোসেন নামে, গিরিন চক্রবর্তী সোনা মিঞা নামে এবং আশ্চর্যময়ী ও হরিমতী যথাক্রমে সখিনা বেগম ও আমিনা বেগম নামে ইসলামি সংগীত গেয়ে অপ্রত্যাশিত জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন।
নজরুলের কবিতায় প্রেম ও প্রকৃতি যেমন একাকার হয়ে আছে তেমনি গানেও সেসাফল্যের ধারা বজায় রয়েছে। আর রঙ্গ-ব্যঙ্গ এবং হাসির গানেও নজরুল অসাধারণ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন। বিশেষ করে ‘চন্দ্রবিন্দু’র গানগুলো এ শ্রেণিভুক্ত। মূলত যুগধর্মের স্পন্দন ও উদ্দীপনাই নজরুলের গানের মূল সুর ও স্বর।
নজরুলের কবিতায় প্রেম ও প্রকৃতি যেমন একাকার হয়ে আছে তেমনি গানেও সেসাফল্যের ধারা বজায় রয়েছে। আর রঙ্গ-ব্যঙ্গ এবং হাসির গানেও নজরুল অসাধারণ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন। বিশেষ করে ‘চন্দ্রবিন্দু’র গানগুলো এ শ্রেণিভুক্ত। মূলত যুগধর্মের স্পন্দন ও উদ্দীপনাই নজরুলের গানের মূল সুর ও স্বর।
গ
কথাসাহিত্য বলতে মূলত গল্প ও উপন্যাসকে বুঝায়। নজরুলের গল্পগ্রন্থ তিনটি—ব্যথার দান (১৯২২), রিক্তের বেদন (১৯২৫) ও শিউলি মালা (১৯৩১) এবং উপন্যাস তিনটি—বাঁধনহারা (১৯২৭), মৃত্যুক্ষুধা (১৯৩০) ও কুহেলিকা (১৯৩১)। নজরুলের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ হল ব্যথার দান (১৯২২)। তরুণ বয়সের উদ্দাম, উচ্ছ্বাস, মান-অভিমান, প্রেম-ভালবাসা বিশেষ করে সৈনিক-জীবনের নানা অভিজ্ঞতা এখানে অকৃত্রিমভাবে বর্ণিত হয়েছে। রিক্তের বেদন ও বাঁধনহারা উপন্যাসেও সৈনিক জীবনের প্রসঙ্গ আছে। সৈনিক জীবনের মধ্য দিয়ে আমরা আন্তর্জাতিক নজরুলকে আবিষ্কার করি। নজরুলের আগেই বলা যায় রবীন্দ্রনাথের হাত দিয়ে ছোটগল্পের পূর্ণতা এসেছে কিন্তু সৈনিক-জীবনের অভিজ্ঞতা ও আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞানের পরিচয় আমরা নজরুলের হাত দিয়েই পাই। তাছাড়া শিউলিমালা গ্রন্থের জিনের বাদশা, অগ্নি-গিরি এবং শিউলিমালা গল্পত্রয়ে ব্যক্তিনজরুলের চোখে দেখা মানুষই যেন এখানে ‘চরিত্ররূপে’ চিত্রিত হয়েছে। বাঁধনহারা শুধু সার্থক পত্রোপন্যাস নয় আত্মজৈবনিক গ্রন্থ হিসেবেও এর যথেষ্ট মূল্য রয়েছে। নিজের চোখে দেখা ব্যক্তি ও ঘটনার জীবন্ত ভাষারূপ মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসে। নজরুল যখন কৃষ্ণনগরে চাঁদ সড়কে ছিলেন তখন রাজমিস্ত্রি, খানসামা, কুমার, গৃহকর্মী— প্রভৃতি শ্রেণি পেশার মানুষকে নিবিড়ভাবে দেখার সুযোগ লাভ করেছিলেন। এই চোখে দেখা ‘মেজ-বৌ’কেই নজরুল কালজয়ী মাতৃত্বের শাশ্বতিকরূপ দিয়েছেন। কুহেলিকা উপন্যাসে ইংরেজ প্রশাসনের বিরুদ্ধে ও দেশকে স্বাধীন করার মানসে বিপ্লবী দলের যে ত্যাগ ও ভূমিকা বর্ণিত হয়েছে নজরুল পূর্ব বাংলা কথাসাহিত্যে তার তুলনা মেলা ভার। মূলত কথাসাহিত্যের নজরুলের ব্যক্তিগত চিন্তুা-চরিত্রের ছাপকে গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করা যায়।

ঘ
নজরুল সংবাদপত্র সম্পাদনায় বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। যেখানে তিনি হাত দিয়েছেন সেখানে বিদ্রোহের বীজ বপন করেছেন। এজন্য প্রথম দিকে সৃষ্টির উদ্দামতায় বিদ্রোহ-বিপ্লবের হুল সমাজ-শাসককে ফোটানোর কারণে অনেক গ্রন্থ/ পত্রিকা বাজেয়াপ্ত হয়েছে। সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ (১৯২০) পত্রিকা সম্পাদনার কিছুদিনের মধ্যে অসহাযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে গণমুখী উত্তেজাপূর্ণ লেখা প্রকাশের জন্য এর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। একে একে সম্পাদনা করেছেন অর্ধসাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’ (১৯২২), সাপ্তাহিক ‘লাঙল’ (১৯২৫-২৬), সাপ্তাহিক ‘গণবাণী’ (১৯২৬) ইত্যাদি। এ সমস্ত পত্রিকা সম্পাদনার সূত্র ধরে যে সম্পাদকীয় কলাম, ফিচার ও প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন সেগুলোর গ্রন্থবদ্ধরূপ হল যুগবাণী (১৯২২), দুর্দিনের যাত্রী (১৯২৬), রুদ্রমঙ্গল (১৯২৭) ও ধূমকেতু (১৯৬১) প্রভৃতি প্রবন্ধগ্রন্থ। সমকালীন সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গ ও অভিমত অভিঘাতে আচ্ছন্ন এসব প্রবন্ধ গ্রন্থ। জাগ্রত ও শাণিত বিবেক থাকায় নজরুল কোন তোষামুদে সম্পাদকীয়/প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা করেননি। এজন্য নজরুল হয়ত একমাত্র কবি-সম্পাদক যিনি ১৯২২ সালে ধূমকেতু সম্পাদনার সময় দাবি তুলেছিলেন ‘ধূমকেতু পূর্ণ স্বাধীনতা চায়’। এমন দাবি উত্থাপন করার কথা সেদিন রাজনীতিবিদেরাও উচ্চারণ করতে সাহস পাননি জেল-জুলুমের ভয়ে।
ঙ
অনুবাদক হিসেবে নজরুলের অবদান অসামন্য। তাঁর অনূদিত গ্রন্থ তিনটি—রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ (১৯৩০), কাব্য-আমপারা (১৯৩৩) এবং রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম (১৯৫৯)। শিয়ারসোল রাজ হাইস্কুলে অধ্যয়নের সময় হাফিজ নূরুন্নবী নামক জনৈক শিক্ষকের কাছে ফারসিতে নজরুলের হাতেখড়ি হয় আর সৈনিকজীবনে (১৯১৭-২০) বাঙলি পল্টনের পাঞ্জাবি মৌলবি সাহেবের কাছে ফার্সি ভাষা শিখে সমস্ত কবিদের প্রায় বিখ্যাত কাব্যই অধ্যয়ন করেন। সেই অনুপ্রেরণা থেকে হাফিজের গজলের অনুবাদ করেন। এর কয়েক বছর পরে হাফিজের ‘দিওয়ান’ অনুবাদ শুরু করেন এবং বুলবুলের রোগশয্যায় বসে এই অনুবাদ যেদিন শেষ করলেন ঐদিন বুলবুল মৃত্যুবরণ করে। কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার, কান্তিচন্দ্র ঘোষ, অজয়কুমার ভট্টাচার্য প্রমুখ হাফিজের দিওয়ানের অনুবাদ করেছেন। নজরুলের বিশেষত্ব হল তিনি দিওয়ানের মূল ফারসি থেকে অনুবাদ করেছেন। রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়ামও ফারসি থেকে অনূদিত। আর কাব্য-আমপারা আরবি থেকে অনূদিত। এতেই বুঝা যায় আরবি-ফারসির উপর কতটুকু দখল নজরুলের ছিল। রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়ামে’র অনুবাদকের সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু নজরুলের রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম সম্পর্কে সৈয়দ মুজতবা আলী বলেন, ‘কাজীর অনুবাদ সকল অনুবাদের কাজী।’
অনুবাদক হিসেবে নজরুলের অবদান অসামন্য। তাঁর অনূদিত গ্রন্থ তিনটি—রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ (১৯৩০), কাব্য-আমপারা (১৯৩৩) এবং রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম (১৯৫৯)। শিয়ারসোল রাজ হাইস্কুলে অধ্যয়নের সময় হাফিজ নূরুন্নবী নামক জনৈক শিক্ষকের কাছে ফারসিতে নজরুলের হাতেখড়ি হয় আর সৈনিকজীবনে (১৯১৭-২০) বাঙলি পল্টনের পাঞ্জাবি মৌলবি সাহেবের কাছে ফার্সি ভাষা শিখে সমস্ত কবিদের প্রায় বিখ্যাত কাব্যই অধ্যয়ন করেন। সেই অনুপ্রেরণা থেকে হাফিজের গজলের অনুবাদ করেন।
চ
নজরুলের শিশুতোষ রচনা খুব বেশি নয়। তবে শিশুদের আনন্দ দানের অভিপ্রায়ে প্রণীত কল্পনাপ্রধান লেখায় নজরুলের জুড়ি মেলাভার। নজরুলের শিশু সাহিত্য রচনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, দক্ষিণারঞ্জন মজুমদার ও সুকুমার রায়ের প্রভাব থাকলেও তাঁর শিশুসুলভ খামখেয়ালিপনা, ভাবালুতা, বাধাবন্ধনহীনতা এবং হাস্যপরিহাসের লঘুতা শিশুমনের এতই অভ্রান্ত অভিব্যক্তি পেয়েছে যে অন্যদের তুলনায় নজরুলের খ্যাতি অনন্য-অসাধারণ। ঝিঙেফুল (১৯২৬), ঘুম জাগানো পাখি, পুতুলের বিয়ে (১৯৩৩), শেষ সওগাত (১৯৫৯), সঞ্চয়ন (১৯৫৫), ঝড় (১৯৬১), পিলে পটকা পুতুলের বিয়ে (১৯৬৪) প্রভৃতি রচনায় শিশুদের নির্মল আনন্দদানের অনন্য উদাহরণ।

ছ
ড. সুশীলকুমার গুপ্তসহ কেউ কেউ নজরুলের গল্প, উপন্যাস, নাটক ও প্রবন্ধ নিয়ে খুব একটা আগ্রহ দেখাননি। যেমন ড. গুপ্ত নজরুলের নাটক প্রসঙ্গে এভাবে মূল্যায়ন করেছেন, ‘বাঙলা নাট্যসাহিত্যে নজরুলের দান অকিঞ্চিৎকর।’ কিন্তু অনুপম হায়াৎ ‘নাট্যকার নজরুল’ গ্রন্থে নজরুলের ৮০টি নাটকের সন অনুসারে পর্যায় ক্রমিক একটি তালিকা দিয়েছেন। আমরা বলব ঝিলিমিলি (১৯৩০), আলেয়া (১৯৩১), মধুমালা (১৯৫৯) প্রভৃতির মতো প্রেমময়, সংগীত প্রধান, রূপক-সাংকেতিক নাটকই বা কয়খানা লেখা হয়েছে বাংলা সাহিতে। নজরুলের নাটকের বিষয় অনুসারে সাজালে দেখা যাবে সেখানে বৈচিত্র্যও কম নয়। যেমন মনোনাট্য (২টি), একাঙ্ক (৪টি), পূর্ণাঙ্গ নাটক (৪টি), হিন্দি নাটক (১টি), ছোটদের একাঙ্ক (১০টি), গীতিনাট্য (১২টি), বেতার নাট্য (১২টি), কাব্যনাট্য (১টি), নৃত্যনাট্য (১টি) ইত্যাদি।
নজরুল শুধু নাটক নাটিকা রচনা করেননি অন্যের নাটকের গীতিকার ও সুরকার হিসেবে আদর্শস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। চলচ্চিত্রের জগতেও নজরুল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভূমিকা পালন করেছেন। চলচ্চিত্রে তিনি যে অবদান রেখেছেন তা এভাবে বলা যেতে পারে— তিনি সুর-ভা-ারী, পরিচালক, সংগীতকার, সুরকার, গীতিকার, অভিনেতা, গায়ক, চিত্রনাট্যকার, সংলাপকার ও সংগঠক ইত্যাদি। ১৯৩১-১৯৪২ কালপর্বে তিনি প্রায় ২১/২১ টি চলচ্চিত্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষাভাবে যুক্ত ছিলেন।
পরিশেষে আমরা বলবো বিভিন্ন পর্বে বিভক্ত করে নজরুল সম্পর্কে যেটুকু বলা হল সেটা হল নজরুলের বিশাল সৃষ্টি বিশ্বের একটু আঁচড় মাত্র। নজরুলের সৃষ্টি সম্ভারের বিশাল সিন্ধুর মধ্যে এটা বিন্দুর উন্মীলন বৈকি।