যুগ-প্রবর্তক রাজা রামমোহন রায় আজও সমান প্রাসঙ্গিক, পর্ব–৭

রামমোহনের মৃত্যু
রামমোহন ইউরোপে প্রায় আড়াই-বছর-কাল ছিলেন। ব্রিস্টলে থাকাকালীন শেষদিকে তিনি অত্যন্ত অর্থকষ্টে দিন কাটাচ্ছিলেন। তিনি কলকাতায় যে হৌসের সঙ্গে টাকা-পয়সার ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন, তা ব্যর্থ হয়ে যাওয়ায় এই অসুবিধা ঘটে। রামমোহনের যখন এই অবস্থা তখন তিনি কয়েকটি ইংরেজ-পরিবারের কাছ থেকে খুব সাহায্য পেয়েছিলেন। এই সকল পরিবারের মধ্যে হেয়ার ও কার্পেণ্টার পরিবারের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ডা. ল্যাণ্ট কার্পেণ্টার রামমোহনের বিশেষ বন্ধু ছিলেন ও তাঁর মৃত্যুর পর একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী লেখেন।
অত্যধিক পরিশ্রম আর অনিয়মে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসকের সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। জ্বরে আট দিন মাত্র ভুগে ১৮৩৩ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর শুক্রবার রাত্রি দু’টো পঁচিশ মিনিটে পৃথিবীর যাবতীয় দ্বন্দ্ব, যাবতীয় কর্ম অধর্মের হিসেব-নিকেশ মিটিয়ে এই মহামানব মাতৃভূমি থেকে ন’হাজার মাইল দূরে সমুদ্রের পাড়ে ইংল্যাণ্ডের মাটিতে ব্রিস্টলে চিরতরে সুখ-নিদ্রায় মগ্ন হলেন। ৬১ বছর বয়সে রামমোহন রায়ের মৃত্যু হয়। পাছে তাঁর পুত্রদের বিষয়-সম্পত্তি পাওয়া সম্বন্ধে কোন অসুবিধা ঘটে, সেজন্য মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে রামমোহন তাঁর অনুগামী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের অনুরোধ করেছিলেন,–মৃত্যুর পর তাঁর দেহ যেন খ্রিস্টিয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বিধি অনুসারে সমাহিত না করা হয়। ষ্টেপলটন্ গ্রোভের কাছে এক নির্জন গাছের তলায় তাঁকে সমাধি দেওয়া হয়েছিল। দশ বছর পরে তাঁর বন্ধু প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর বিলাতে গেলে রামমোহনের সমাধি ইংল্যাণ্ডের ব্রিস্টল শহরে আর্নস ভেলে স্থানান্তরিত করে একটি সুন্দর সমাধিমন্দির তৈরি করে দিয়েছিলেন। রামমোহন রায়কে সামনে বসিয়ে তাঁর একমাত্র প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন ইংরেজ চিত্রশিল্পী এইচ পি ব্রিগস্, যে ছবি রয়েছে ব্রিস্টলের যাদুঘরে। এই ছবিতে রামমোহন রায়ের পেছনে দেখা যায় একটি মন্দির, একটি মসজিদ এবং তাঁর হাতে বাইবেল। ব্রিস্টল বাঙালি তথা ভারতীয়দের কাছে পবিত্র তীর্থস্থান।
দুটি বিষয় একটু উল্লেখ না করলে এই লেখাটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। লোকে তাঁকে নাস্তিক বলতো—বিধর্মী বলেও তাঁর কম পরিচয় ছিল না। কিন্তু এত সত্ত্বেও তিনি এক মুহূর্তের জন্যও যজ্ঞসূত্র গলা থেকে খোলেন নি কোনো দিন। মৃত্যুকালেও হিন্দুদের পবিত্র এই যজ্ঞসূত্র তাঁর গলায় দেখা গেছে। রামমোহন সর্বদা একটি বিশেষ ধরনের পাগড়ি ব্যবহার করতেন আমরা প্রত্যেকেই সেটা জানি। তাঁর মৃত্যুর পর ঐ পাগড়ি বিলাতে তাঁর গৃহ চিকিৎসক বহু যত্নে সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। পরবর্তীকালে শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয় রামমোহনের ব্যবহৃত ঐ পাগড়িটি আমাদের দেশে নিয়ে আসেন।
রামমোহনের বিশ্বধর্মবোধ
উপমহাদেশে জাতীয় চেতনা উন্মেষেও তাঁর প্রভূত অবদান ছিল। তেজ, বীর্য,ত্যাগ,নিষ্ঠা, আত্মপ্রত্যয়, পাণ্ডিত্য প্রভৃতির সমন্বয়ে তিনি ছিলেন সে যুগের এবং পরবর্তী যুগের জাতির প্রেরণার উৎস। উনবিংশ শতাব্দীতে রামমোহন যে মুক্ত চিন্তাচেতনার আলো জ্বেলে দিয়ে গিয়েছিলেন, সেই আলোতেই ভারতে নব-জাগরণের পথটি ত্বরান্বিত হয়েছিল। তাই তাঁকে বাংলা তথা ভারতের নবজাগরণের জনক বা আধুনিকতার অগ্রপথিক রূপে বর্ণনা করা হয়। রামমোহনই প্রথম ভারতীয় যিনি মানবাধিকারের সপক্ষে প্রথম দৃঢ় মানসিকতা ব্যক্ত করেছিলেন। রামমোহন তাঁর রচনার মধ্য দিয়ে, জীবনের মধ্য দিয়ে যা প্রচার ও প্রকাশ করেছিলেন তা মানবের বিশ্বধর্মবোধ। ভারতের শাশ্বত বাণী হিন্দুর সর্বশ্রেষ্ঠ শাস্ত্রমধ্যে উদ্ গীত হয়েছে এবং সেই বাণীর সঙ্গে পৃথিবীর অন্য শ্রেষ্ঠ ধর্মের বাণীর বিরোধ নেই—এটাই তাঁর সাধনার মর্মকথা। বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক ম্যাক্স মুলার রামমোহনকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন—Rammohan Roy was a truly great man, a man who did a truly great work, and whose name, if it is right to prophesy will be remembered for ever as one of the great benefactors of mankind.
রামমোহনের প্রাসঙ্গিকতা
সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার প্রবক্তা এবং মানবকল্যাণকামী এই মহান মানুষটি আজও নতুন প্রজন্মের কাছে সমান প্রাসঙ্গিক। দেশ ও জাতি গঠনে তাঁর যে অবদান— বর্তমানকালের রাজনৈতিক, আর্থিক, সামাজিক, ধর্ম ও শিক্ষা সংস্কারে এখনও সে সকল প্রাসঙ্গিকতা ফুরিয়ে যায় নি। রামমোহনের প্রকৃত মূল্যায়ন বাঙালি করে নি। সেই কবে প্রথম বাঙালি সমাজবিজ্ঞানী অক্ষয়কুমার দত্ত আক্ষেপ করে লিখেছেন, “……কেহ কি আজও তোমাকে (রামমোহন রায়কে) চিনিল? জীবদ্দশায় তোমাকে আমরা স্বীকার করি নাই, মৃত্যুর পরেও আমরা তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিব না। এমনই অপদার্থ আমরা! ” রাজা রামমোহন রায়ের জন্মের আড়াইশো বছরের দোরগোড়ায় এসেও অক্ষয়কুমার দত্তের আক্ষেপ এখনও আমাদের মননে অনুরণিত হয়।
বহুভাষাবিদ, শাস্ত্রজ্ঞানী, প্রবল যুক্তবাদী, ব্যক্তিস্বাধীনতাকামী, অনন্য আন্তর্জাতিকতাবাদী রামমোহন রায় নরোত্তমই থেকে গেলেন। দেবত্ব বা পূর্ণ-ব্রহ্মত্ব লাভ করে ‘পুজো’ পাবার অবকাশ পেলেন না। তিনি মানুষই থেকে গেলেন এবং সেইজন্য আমরা তাঁকে মানুষের মতো করেই দেখে এসেছি, তাতে তাঁর মর্যাদার হানি হয়নি। রবিঠাকুর চারিত্রপুজা প্রবন্ধে যথার্থই বলেছেন,” বর্তমান বঙ্গসমাজের ভিত্তি স্থাপন করিয়াছেন রাজা রামমোহন রায়। আমরা সমস্ত বঙ্গবাসী তাঁহার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী, তাঁহার নির্মিত ভবনে বাস করিতেছি।…আমাদের যদি কেহ বাঙালি বলিয়া অবহেলা করেন আমরা বলিব, রামমোহন রায় বাঙালি ছিলেন।”
আরও পড়ুন :
যুগ-প্রবর্তক রাজা রামমোহন রায় আজও সমান প্রাসঙ্গিক, পর্ব–১
যুগ-প্রবর্তক রাজা রামমোহন রায় আজও সমান প্রাসঙ্গিক, পর্ব–২
যুগ-প্রবর্তক রাজা রামমোহন রায় আজও সমান প্রাসঙ্গিক, পর্ব–৩
যুগ-প্রবর্তক রাজা রামমোহন রায় আজও সমান প্রাসঙ্গিক, পর্ব–৪
যুগ-প্রবর্তক রাজা রামমোহন রায় আজও সমান প্রাসঙ্গিক, পর্ব–৫
যুগ-প্রবর্তক রাজা রামমোহন রায় আজও সমান প্রাসঙ্গিক, পর্ব–৬
ঋণ
- প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়: রামমোহন ও তৎকালীন সমাজ ও সাহিত্য ( কলকাতাঃ বিশ্বভারতী, ১৩৯৪ বঙ্গাব্দ)
- পশ্চিমবঙ্গ, রামমোহন সংখ্যা ( ১৪০৩), তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: চারিত্রপূজা, রাজা রামমোহন রায়
- সুবোধ চক্রবর্তী: ভারতপথিক রামমোহন
- ধ্রুবপদঃ প্রসঙ্গ বাংলা গান, ১৯৯৯ বার্ষিক সংখ্যা, সম্পাদক সুধীর চক্রবর্তী