যুগ-প্রবর্তক রাজা রামমোহন রায় আজও সমান প্রাসঙ্গিক, পর্ব–৬

রামমোহনের বিলাত-প্রবাস
১৮২৯-এ তৎকালীন দিল্লির বাদশাহ দ্বিতীয় আকবর তাঁকে ‘রাজা’ উপাধি দেন। সেযুগে ভারতীয়দের ইউরোপ যাওয়া গর্হিত কাজ বলে গণ্য করা হতো। কিন্তু রামমোহন ঐরূপ গোঁড়ামিতে বিশ্বাস করতেন না। তৎকালীন মুগল-বাদশার কতকগুলি দাবিদাওয়া স্থানীয় ইংরেজ শাসকরা মান্য করছিলেন না। দিল্লির বাদশাহ দ্বিতীয় আকবর সেই-সব দাবি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে পেশ করবার জন্য রামমোহনকে ‘রাজা’ উপাধি দিয়ে ১৫ নভেম্বর ১৮৩০ সালে দূত হিসাবে প্রেরণ করেন। স্নেহপালিত পুত্র রাজারাম, দুই জন সঙ্গী রামরত্ন মুখোপাধ্যায় ও রামহরি দাস এবং মুসলমান ভৃত্য শেখ বকসুকে সঙ্গী করে রামমোহন বিলাত যাত্রা করেন, ৮ এপ্রিল ১৮৩১ সালে পৌঁছন। স্থানীয় ইংরেজ সরকার হতসর্বস্ব বাদশার ‘দূত’-এর অস্তিত্ব স্বীকার করতে চাইলেন না, তাই রামমোহন ‘সাধারণ’ ভাবেই বিলাত যান। গোঁড়া হিন্দুরা আগেই তাঁকে ধর্মত্যাগী ঘোষণা করেছিল। এবার তাঁকে সমাজ থেকে পতিত ঘোষণা করা হয়। কিন্তু যে বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন রামমোহন তাতে কোনও ছাপ ফেলতে পারেনি সনাতন গোঁড়া হিন্দুদের এসব বিরোধিতা।
ইংল্যান্ডে তাঁর আগমন বার্তা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল মুহূর্তের মধ্যে। হাজার হাজার কৌতূহলী জনতা এই মহামানবকে দেখার জন্য ভিড় করলো। তাঁর দীর্ঘ ও সুঠাম দেহ, উজ্জ্বল চোখ ও শ্রী-সম্পন্ন মুখ ও তাঁর পাণ্ডিত্য, তেজস্বীতা ও চরিত্রমাধুর্য্যের জন্য সকলেই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হত। সম্ভ্রান্ত খ্যাতনামা জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তিরা এলেন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। তাঁরা রামমোহনের মধ্যেই দেখতে পেলেন ভারতবর্ষের প্রতিচ্ছবি। ভারতবর্ষ সম্বন্ধে সেখানকার মানুষের যে অবজ্ঞার ভাব ছিল তাদের সে ধারণা ধাক্কা খেল রাজাকে দেখে, রাজার সঙ্গে আলাপ করে। তারা মুগ্ধ হল। রাজাকে দেখেই তারা ভারতবর্ষের সভ্যতা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ভারতবর্ষের ঐশ্বর্য ও মর্যাদা সম্বন্ধে সম্যক ধারণা করল।
লন্ডনে থাকাকালীন বিখ্যাত দার্শনিক জেরেমি বেন্থাম তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি তাঁকে দূত হিসাবে স্বীকার না করলেও তিনি বিলাতে রাজসম্মানও লাভ করেন। পরে অবশ্য ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি তাঁকে ভোজ দিয়ে সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন। এসকল ঘটনা হতে সহজেই অনুমেয় বিলাতে রামমোহনের খুব খ্যাতি হয়েছিল। বিলাতে রামমোহন ভারতবর্ষ সংক্রান্ত নানারূপ রাজনৈতিক আলোচনায় যোগদান করেছিলেন ও তাতে ইংরেজ-শাসনে এদেশের লোকদের উন্নতি হয় ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বাড়ে, তার চেষ্টা করেছিলেন। এ ছাড়া দিল্লীশ্বরের যে-কাজের জন্য বিলাত গিয়েছিলেন, তাতে তিনি কৃতকার্য্য হন। তাঁরই প্রচেষ্টায় ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে দিল্লির বাদশাহের বার্ষিক ভাতা তিন লক্ষ টাকা করা সম্ভব হয়। ইংল্যান্ড থেকে রামমোহন নিজের ইংরেজি গ্রন্থাবলীও প্রকাশ করেছিলেন।
ফরাসি বিপ্লব তাঁকে দারুণভাবে উদ্ভুদ্ধ করেছিল। ১৮৩২ সালের শরৎকালে তিনি ফ্রান্সেও গিয়েছিলেন। সম্রাট লুই ফিলিপ তাঁকে যারপরনাই সমাদর করেছিলেন। সম্রাটের সঙ্গে একত্রে ভোজনও করেছিলেন। ফ্রান্সের বিখ্যাত কবি টমাস মুরের সঙ্গেও তাঁর আলাপ হয়েছিল। টমাস মুর রামমোহনের মধুর ব্যবহার এবং উদার অসাম্প্রদায়িক মনোভাবে মোহিত হয়েছিলেন। কবি টমাস মুর তাঁর রোজনামচায় রামমোহনের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের কথা লিখেছেন।
রামমোহনের রাজনৈতিকসত্তা
শুধু ধর্ম বা সমাজ সংস্কারই নয়, ঐতিহাসিক বাসুদেব চট্টোপাধ্যায় বলছেন রামমোহন ভারতবাসীকে তাদের অধিকার সম্পর্কে অনেক সচেতন করেছেন, এমনকী ভারতে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশও ঘটেছিল রামমোহন রায়ের হাত ধরে। তাঁর রাজনৈতিক ধারণা গড়ে তুলতে তিনি দার্শনিক জেরিমি বেনথামের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। তাঁর কালে বর্হিভারতে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯ -৯১), আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণা (১৭৭৪) এবং ইংল্যাণ্ডের শিল্পবিপ্লব। এই সমস্ত ঘটনা তাঁর মনে গভীর রেখাপাত করেছিল।
রামমোহন জানতেন যে ব্রিটিশ শাসনধীন ভারতে জনসাধারণের কোনও প্রকার রাজনৈতিক অধিকার ছিল না। ইংরেজ শাসন ছিল বহু অবৈধ এবং দমনমূলক ব্যবস্থা, যেগুলিকে সুনির্দিষ্ট করা হয়েছিল তাদের নিম্নস্তরে নামিয়ে দেওয়ার জন্য। তিনি হিসেব করে দেখিয়েছিলেন যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ব্রিটিশ সরকারের এবং জমিদারদের সম্পত্তি বৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু কৃষকদের অবস্থা হয়েছিল শোচনীয়, ‘very miserable ‘. রামমোহন রায়ই প্রথম ভারতীয় যিনি দেশের কৃষকদের শোষণের বিরুদ্ধে তাঁর লিখিত বক্তব্য পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট পর্যন্ত। ব্রিটেনের পার্লামেন্টে সেসময় ভারতের সামাজিক উন্নয়নের জন্য তিনি একটি জোরালো বক্তব্য রাখেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে পেশ করা তাঁর বক্তব্যে তিনি আবেদন করেছিলেন যাতে ভারতে একটা সুশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। যথার্থ শিক্ষা ব্যবস্থা যাতে হয়। ভারতবর্ষে শিক্ষার্থীরা যাতে বিজ্ঞানের আলো পায়। পরবর্তীতে ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির সনদ প্রাপ্তির সময় রাজা রামমোহন রায় বিলাতের পার্লামেন্টে যে প্রতিবেদন পাঠান, তা তাঁর প্রগতিশীল অর্থনৈতিক চিন্তার পরিচায়ক। তিনি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে শোষিত কৃষককুলের সপক্ষে বক্তৃতা করেছিলেন। নতুন সনদে তিনি কৃষকদের স্বার্থরক্ষা জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।
ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষের কৃষি-শিল্প-পুঁজি প্রসঙ্গেও তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট ছিল। স্থান-কালের প্রেক্ষাপটে নিশ্চিত কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাঁর সীমাবদ্ধতা ছিল কিন্তু সেসময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর চিন্তাধারা যথেষ্ট প্রগতিশীল। তিনি দৃঢ়কণ্ঠে ব্যক্ত করেছিলেন ইংরেজরা যদি ভারতীয় সমাজ ও আর্থিক পটভূমিকে গুরুত্ব আরোপ না করে শুধুমাত্র ভারতবর্ষের ধন-সম্পদ লুন্ঠন করতে থাকে তাহলে উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্ক অবনতি হবে। এ ক্ষেত্রে দেশীয় সামাজিক বিন্যাসের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ফার্ম তৈরি করে পুঁজি বিনিয়োগের আবেদন করেছিলেন।
1 thought on “যুগ-প্রবর্তক রাজা রামমোহন রায় আজও সমান প্রাসঙ্গিক, পর্ব–৬”