যুগ-প্রবর্তক রাজা রামমোহন রায় আজও সমান প্রাসঙ্গিক, পর্ব–৪

সমাজ সংস্কারক রামমোহন
সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত : ভারতীয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী শুধু পেয়ে এসেছে অবিচার, লাঞ্ছনা ও নির্যাতন। নারীর এই করুণ অবস্থার প্রতিকারের জন্য রামমোহন তাঁর সমস্ত শক্তি দিয়ে সংগ্রাম করেছিলেন। নারী সমাজের প্রতি সহানুভূতি এবং সমাজের অধিকার আদায়ের দৃঢ়সঙ্কল্প থেকেই তিনি সামাজিক নানা আন্দোলন করতে অনুপ্রাণিত হন। অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ্বে বাঙালির জাতীয় জীবনে যে অন্ধকার নেমে আসছিল, তার ফলে নানাধরনের কুসংস্কার যেমন সতীদাহ, মানত করা সন্তান গঙ্গাসাগরে বিসর্জন দেওয়া, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, অন্তর্জলী যাত্রা, অস্পৃশ্যতা বাঙালির জীবনকে পরতে পরতে আবৃত করে ফেলেছিল। নিঃসন্দেহে তাঁর মহত্ত্বম অবদানের একটি, সেটি হল সতীদাহ প্রথা নিবারণ।
সহমরণ এক অতি প্রাচীন প্রথা। মহাভারতে রয়েছে রাজা পাণ্ডুর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী মাদ্রী সহমরণে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। ইতিহাস বলে গ্রিক সম্রাট আলেকজাণ্ডারের সঙ্গে ভারতে এসেছিলেন ক্যাসাণ্ড্রিয়ার ঐতিহাসিক এরিষ্ট বুলুস। তিনি তক্ষশীলায় সতীদাহ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। অনেকের মতে, এক সময় মুসলিম বিজেতাদের সঙ্গে রাজপুতদের যুদ্ধ শুরু হয় এবং রাজপুতরা পরাজিত হয়। তখন মুসলিম বিজেতাদের হাত থেকে রাজপুতানার মহিলারা নিজেদের আত্মরক্ষা করতে জহরব্রত অর্থাৎ আগুনে ঝাঁপ দিয়ে পুড়ে মারা যেতেন। তবে এই তথ্য নিয়ে বিতর্ক আছে। দিল্লির সুলতানি আমলে মহম্মদ বিন তুঘলক ছিলেন সতীদাহের ঘোর বিরোধী। মোঘল সম্রাট হুমায়ুন আইন করে সতীদাহ বন্ধ করার চেষ্টাও করেছিলেন। মোঘল সম্রাট আকবর, শাহজাহান এমনকি ঔরঙ্গজেব পর্যন্ত সতীদাহের তীব্র সমালোচক ছিলেন। তবুও এই বর্বর প্রথা দীর্ঘদিন টিকে ছিল বহাল তবিয়তে।
সতীদাহের মতো নৃশংস ব্যাপারে ইংরেজদের দৃষ্টি আগেই পড়েছিল। ১৮৪৩-এ কাশিমবাজারের কুঠির সামনে ১৮ বছরের এক বিধবা সহমৃতা হন। ইংরেজরা এই ঘটনার প্রতিবাদ করতে সাহসী হয়নি। ১৮৪৫-এ গর্ভনর জেনারেলের সেক্রেটারি বিধবাদের যাতে জোরপূর্বক দাহ করা না হয় সেজন্য বিধি জারি করেন। ইংরেজ সরকার এর উদ্যোগ নিয়েছিল ঠিক কথা, কিন্তু তাদের উদ্যোগ অর্থবহ এবং সফল হতে পারতো না যদি রামমোহন এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন একদল উদারমনস্ক, বাঙালি বুদ্ধিজীবী এগিয়ে না আসতেন। রামমোহনের সহমরণের চরম বিরুদ্ধাচারণের ঘটনার সূত্রপাত ১৮১২ সাল। তিনি তাঁর এক বৌদিদি অলোকামঞ্জরী দেবীকে জোরপূর্বক সতী বানানোর ঘটনার সাক্ষী হয়ে এই বর্বর প্রথার কট্টর সমালোচক হন। হন্যে হয়ে অনুসন্ধান চালাতে লাগলেন প্রচলিত হিন্দু শাস্ত্রে কোথাও বিধান আছে কিনা। না শাস্ত্রের পাতায় এমন কোনো ছত্র তাঁর দৃষ্টিগোচর হলো না যা সহমরণকে সমর্থন করছে বা সহমরণ প্রসঙ্গ উল্লেখ আছে। তারপর এই নৃশংস প্রথা দূর করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রবল জনমত গড়ে তুলতে প্রয়াসী হন রামমোহন রায়। রামমোহন রায়ের ‘কৌমুদী’ ও ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চন্দ্রিকা’ সতীদাহের বিপক্ষে ও পক্ষে জনমত গঠনে প্রয়াসী হয়। তিনি সতীদাহ প্রথা নিবারণের জন্য বাংলায় তিনটি ও ইংরেজিতে চারটি গ্রন্থ রচনা করেন এবং এই গ্রন্থগুলি বিনামূল্যে বিতরণ করেন। বাংলা গ্রন্থগুলি হল—’সহমরণ বিষয় প্রবর্তক ও নিবর্তক সম্বাদ’ ( ১৮১৮), ‘ প্রবর্তক ও নিবর্তকের দ্বিতীয় সম্বাদ ‘ (১৮১৯) এবং ‘সহমরণ বিষয়’ ( ১৮২৯)। শুধু লেখনী ধারণ করেই রামমোহনের আন্দোলন শেষ হয়নি, তিনি বিপদের ঝুঁকি নিয়ে বন্ধুদের সাথী করে শ্মশানে শ্মশানে ঘুরে জ্বলন্ত চিতা থেকে বিধবাদের উদ্ধার করতে শুরু করেন। এই রকম দুঃসাহসী ছিলেন রামমোহনের। ঐ সময়ের বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ দু’দিকে বিভক্ত হয়ে পড়েন। এমনকি রামমোহনের প্রাণনাশের চেষ্টা চলেছিল।
হিন্দু ধর্মমতে আঘাত লাগতে পারে বলে ইংরেজরা প্রথমে এই আইন প্রণয়ন করতে চায়নি। অবশেষে ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক সতীদাহ নিবারণ আইন করেন, যার প্রধান কৃতিত্ব রামমোহন রায়ের। রামমোহন রায় এবং তাঁর অনুগামীদের সমর্থনের ফলেই লর্ড বেন্টিঙ্কের পক্ষে সতীদাহ প্রথা নিবারণ আইন প্রণয়ন করা সম্ভব হয়েছিল। সতীদাহ নিবারণের জন্য কলকাতার হিন্দুরা খুবই উত্তেজিত হয়ে এই আইন রদ করবার জন্য বেণ্টিঙ্ককে আবেদন করেন। অপরদিকে রামমোহন রায় মাত্র কয়েকজন বন্ধুর স্বাক্ষরযুক্ত অভিনন্দন পত্র লর্ড বেণ্টিঙ্ককে পাঠিয়ে তাঁকে প্রশংসা জ্ঞাপন করেন। আন্দোলন চলতে থাকে। সমাজ চেতনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সতীদাহ প্রথা ক্রমে বন্ধ হয়ে যায়।
রামমোহন ও নারীর স্বাধীকার
ভারতে বহু-বিবাহ ও বর্ণভেদ প্রথার বিরুদ্ধেও রাজা রামমোহন রায় তীব্র আন্দোলন চালিয়ে যান। নারী ও পুরুষের সমানাধিকার এবং বিষয় সম্পত্তিতে নারীদের উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যও তিনি লড়াই চালিয়ে গেছেন। নারীরা যাতে স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারে তার জন্য বিষয় সম্পত্তিতে নারীদের উত্তরাধিকারের দাবি প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারেও রামমোহন রায়ের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। স্ত্রী-শিক্ষা প্রবর্তনের জন্য রামমোহনকে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখা যায়। ১৮২২ সালে ‘ Brief Remarks regarding Modern Encroachments on the Ancient Rights of Females according to the Hindoo of Inheritance’ নামে গ্রন্থে ইংরেজিতে স্ত্রী-শিক্ষাবিষয়ক তাঁর একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। নারীদের অধিকার ও স্ত্রী-শিক্ষা বিষয়ে রামমোহন এই গ্রন্থে আলোচনা করেন। তিনি বলেছিলেন, নারীর শিক্ষা প্রসার না ঘটলে নারীর বন্দিনী দশা কখনই ঘুচবে না। যদিও তাঁর আগে মিশনারিরা স্ত্রী-শিক্ষা প্রচার ও মেয়েদের পড়াশোনার জন্য বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। রামমোহন নারীকে শুধু জননী, জায়া, ভগিনী, কন্যা, কিংবা কেবলমাত্র পুরুষের অনুগামিনী হিসেবে দেখেননি, তিনি নারীকে নতুন যুগের আলোকে দেখেছিলেন। নারীকে ব্যক্তি বা স্বাধীন সত্তার অধিকারণী হিসেবে দেখেছিলেন। নারীর হাতে তিনি তুলে দিয়েছিলেন মুক্তিসূর্যের পতাকা।