যুগ-প্রবর্তক রাজা রামমোহন রায় আজও সমান প্রাসঙ্গিক, পর্ব–৩

ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা
শুরু হয় সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই। হিন্দু ধর্মকে সংস্কার করতে তিনি আজীবন লড়াই করেছেন। সাম্যবাদের প্রতি রামমোহনের প্রবল ঝোঁক ছিল। রামমোহন অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়, অসাম্যের বদলে সাম্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে এবং হিন্দুধর্মকে সংস্কারমুক্ত করার জন্য তিনি ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথমে ‘আত্মীয় সভা’ গঠন করেন। ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে তিনি একে ‘ব্রাহ্মসভা’য় পরিণত করেন। ১৮২৮ এটি আবার ‘ব্রাহ্মসমাজ’ নামে পরিচিত হয়। ব্রাহ্মসভার মূল বক্তব্য ছিল, ঈশ্বর এক ও অভিন্ন, সকল ধর্মের মূল কথা এক। তিনি মনে করেছিলেন ব্রাহ্ম আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতীয়গণের মধ্যে ধর্মগত ভেদাভেদ দূর হবে। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের মত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সহযোগিতায় রামমোহন রায় ১৮২৮ সালের ২০ আগস্ট প্রতিষ্ঠা করেন ব্রাহ্মসমাজ। ১৮৩০-এর ৮ জানুয়ারি ব্রাহ্মসমাজের আদর্শকে রূপ দেবার জন্য একটি দলিল স্বাক্ষরিত হয়। ব্রাহ্মসমাজ সম্পর্কে রচিত তাঁর ট্রাস্ট দলিল গণতন্ত্রের এক সোচ্চার ঘোষণা ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। সেই দলিলের অন্যান্য মন্ত্র ছিল দান, সেবা, নৈতিক চরিত্র উন্নয়ন, দয়া, ঈশ্বরভক্তি,পরের হিত-সাধন,জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের সঙ্গে সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের বন্ধন দৃঢ়করণ। ব্রাহ্মসমাজ এক সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলন এবং বাংলার পুনর্জাগরণের পথ-প্রদর্শক হিসাবে কাজ করেছিল।
যে সকল হিতাকাঙ্ক্ষীরা রামমোহনের সুকঠিন মহৎ ব্রত উদযাপিত করতে হাসিমুখে তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা হলেন, পাথুরিয়াঘাটার প্রসন্নকুমার ঠাকুর, জোড়াসাঁকোর দ্বারকানাথ ঠাকুর , টাকির বৈকুন্ঠনাথ মুন্সী, কালীনাথ, বৃন্দাবন মিত্র( ডাক্তার রাজেন্দ্রলাল মিত্রের ঠাকুরদা) এবং কাশীনাথ মল্লিক, ভূকৈলাসের রাজা কালীশঙ্কর ঘোটাল, তেলেনীপাড়ার বৈদ্যনাথ ব্যানার্জি প্রমুখ জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তি। এছাড়াও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে নন্দকিশোর বসু( রাজনারায়ণ বসুর পিতা), ব্রজমোহন মজুরদার, হলধর বসু, রাজনারায়ণ সেন, তারাচাঁদ চক্রবর্তী এবং চন্দ্রশেখর বসুর নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
রামমোহন ও সংবাদপত্র
প্রখ্যাত সাংবাদিক ও গবেষক কৃষ্ণ ধর বলেছেনঃ ”ভারতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য প্রথম যে কণ্ঠস্বর, সেটি ছিল রাজা রামমোহন রায়ের।” রামমোহন রায় ব্রাহ্মনিকাল ম্যাগাজিন নামে তাঁর প্রথম দ্বিভাষিক পত্রিকা প্রকাশ করেন ১৮২১ সালে। পত্রিকার বাংলা নাম ছিল ব্রাহ্মণ সেবধি: ব্রাহ্মণ ও মিশনারি সংবাদ। দ্বিভাষিক এই পত্রিকার মাত্র তিনটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। ঐ বছরই সংবাদ কৌমুদী নামেও একটি পত্রিকা বের করেন তিনি। এর এক বছর পর রামমোহন ফারসি ভাষায়ও একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন যার নাম ছিল মিরাত-উল-আকবর। সংবাদ কৌমুদী ছিল বাঙালি সম্পাদিত ও বাঙালি পরিচালিত প্রথম সংবাদপত্র। এর আগে “বেঙ্গল গেজেট” নামে একটি সংবাদপত্র প্রকাশিত হতো। সংবাদ কৌমুদী প্রকাশিত হয়েছিল দশ বছর। জীবনের শেষ নয় বছরে রামমোহন রায় মোট পাঁচটি সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং এর থেকে সাংবাদিকতা সম্পর্কে তাঁর আগ্রহের প্রমাণ পাওয়া যায়। যুক্তিবাদী এই সমাজ সংস্কারক তাঁর প্রকাশিত পত্রিকাগুলিতে যুক্তিবাদ দিয়ে তৎকালীন সমাজের নানা কুসংস্কার খণ্ডন করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি তাঁর সংবাদপত্রে তুলে ধরতেন কীভাবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিপ্লব মানুষকে মুক্তির সন্ধান দিয়েছে। মেকি পণ্ডিত, মৌলভী ও পাদ্রী প্রত্যেকের মুখোশ তিনি সর্বদা খুলে দেবার জন্য প্রস্তুত থাকতেন। এর জন্য হিন্দু, মুসলমান,খ্রিষ্টানদের কাছ থেকে জীবনে অনেক আঘাত আসে।
আইনসংস্কারক রামমোহন
তিনিই প্রথম ভারতে বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে আলাদা করতে চেয়েছিলেন। রিফর্ম বিল এনে তিনি বলেছিলেন যে বিচার বিভাগ এবং শাসন বিভাগ এক থাকলে কখনও সুবিচার হয় না। তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, জুরি ব্যবস্থায় ভারতীয়দের কেন প্রতিনিধিত্ব থাকবে না? গবেষক কৃষ্ণ ধরের মতে, “এটা বলা যায় যে ভারতের জাতীয় মুক্তি আন্দোলন পরবর্তীকালে যে রূপ নেয়, তার প্রাথমিক উন্মেষ এর মধ্যেই ছিল। এটা শুধু জাতীয়তাবাদী চেতনা ছিল না, ছিল আধুনিক চেতনার সূত্রপাত। তিনি তখন বর্হিবিশ্বে যা ঘটছে, তা মানুষকে জানাচ্ছিলেন তার সংবাদপত্রের মাধ্যমে, যেমন ফরাসী বিপ্লবের কথা। এছাড়াও ইংরেজ শাসনকে গ্রহণ করে নিলেও সেই শাসনের যেসব দিক তাঁর কাছে আপত্তিকর মনে হয়েছে, সেগুলো সম্পর্কেও তিনি তাঁর পত্রিকায় নির্মম ছিলেন।” সংবাদপত্রের উপর থেকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ তুলে দিয়ে ভারতবাসীকে স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার দেবার দাবি জানিয়ে ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দের ‘প্রেস রেগুলেশন’ এর প্রতিবাদ জানিয়ে রাজা রামমোহন রায় সুপ্রীম কোর্টে দরখাস্ত পেশ করেছিলেন। ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দের বৈষম্যমূলক ‘জুরি আইন’ বন্ধ করার জন্য এবং কৃষকদের ওপর করের বোঝা কমাবার জন্য রাজা রামমোহন রায় বহু চেষ্টা করেন।
রামমোহনের খ্রিস্টান মিশনারির ধর্মান্তকরণের বিরোধিতা
রামমোহন রায়ের কর্মজীবন নিয়ে কাজ করেছেন কলকাতা ব্রাহ্মসমাজের অমিত দাস। তিনি লিখেছেন ভারতীয় উপমহাদেশে শাসকের সুযোগ নিয়ে ইংরেজদের ধর্মান্তকরণের বিরোধিতা করেছিলেন রামমোহন রায় তাঁর পত্রিকার মাধ্যমে । ব্রাহ্মনিকাল ম্যাগাজিনে রামমোহন রায় লিখেছিলেন: ‘বাঙ্গালা দেশে যেখানে ইংরেজের সম্পূর্ণ অধিকার ও ইংরেজের নামে লোকে ভীত হয়, তথায় এরূপ দুর্বল ও দীন ও ভয়ার্ত প্রজার উপর ও তাহাদের ধর্মের উপর দৌরাত্ম্য করাটা, কী ধর্মত, কী লোকত প্রশংসনীয় হয় না ‘। দুর্গাপ্রসাদ মজুমদার তাঁর ‘ রামমোহন রায়ের রাজনৈতিক চিন্তা ও কার্যকলাপ প্রসঙ্গে ‘ প্রবন্ধে বলেছেন, ”রামমোহন স্পষ্ট করেই বলেছিলেন যে ব্রিটিশ শাসনের সুযোগ গ্রহণ করে খ্রিস্টান মিশনারিগণ শুধু ভারতীয়দের ধর্ম এবং সামাজিক রীতি-নীতি ও আচার-ব্যবস্থার প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করতো না। একদিকে তারা ভারতীয়দের অপব্যবহার এবং অপমানিত করতো। অন্যদিকে কিছু পার্থিব সুযোগ-সুবিধার লোভ দেখিয়ে তাদের নিজেদের ধর্ম ছাড়িয়ে খ্রিস্টান ধর্মের অন্তর্ভুক্ত করতে চেষ্টা করতো।”
রামমোহন ও বাংলা গদ্যচর্চা
প্রকৃতপক্ষে রামমোহন ছিলেন বাংলা গদ্যেরও জনক। বাংলা গদ্য তখন সবে শুরু হয়েছে। প্রথম চৌধুরী ‘সাধুভাষা বনাম চলিত ভাষা ‘ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন, ‘ রাজা রামমোহন রায় ও মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকারের লেখার দোষ ধরা সহজ কিন্তু আমরা যেন এ কথা ভুলে না যাই যে, এঁরাই হচ্ছেন বাংলাভাষায় সর্বপ্রথম গদ্য লেখক বাংলা গদ্যের রচনাপদ্ধতি এঁদেরই উদ্ভাবন করতে হয়েছিল।’ বাংলা ভাষার গদ্যচর্চা সূচনা তাঁর কলমে। পরবর্তীতে অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্গিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ বাংলা গদ্যরীতিকে সাবালকত্ব পর্যায়ে উন্নিত করেন। বাংলা গদ্যের বহু গ্রন্থ রচনা করেছিলেন রামমোহন। মূলত হিন্দু শাস্ত্রগুলো তিনি অনুবাদ করেছিলেন। তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন দেশাচার বলে যেগুলো চালানো হয়, সেগুলো হিন্দু শাস্ত্রে কোথাও লেখা নেই। বাংলা গদ্য সাহিত্যে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান উল্লেখযোগ্য। রামমোহনের প্রথম বাংলা রচনা বেদান্ত গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮১৫ সালে। তারপর ১৮৩৩ সাল পর্যন্ত তিরিশটি বাংলা গ্রন্থসমেত সত্তরটি মৌলিক বা অনূদিত বিতর্কমূলক পুস্তক-পুস্তিকা বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষাতেই রচনা করেছিলেন। তিনি ধর্ম সংস্কারের জন্য যে সকল গ্রন্থ রচনা করেছিলেন সেগুলি বাংলা গদ্যের বিকাশে সহায়ক হয়েছিল। তিনি গৌড়ীয় ব্যাকরণ নামে একটি ব্যাকরণও রচনা করেন। তাঁর পূর্বে বাংলা ভাষায় দর্শন, সাহিত্য, ধর্ম, ইতিহাস নিয়ে কোনও গ্রন্থাদি রচিত হয় নি ।
1 thought on “যুগ-প্রবর্তক রাজা রামমোহন রায় আজও সমান প্রাসঙ্গিক, পর্ব–৩”