যুগ-প্রবর্তক রাজা রামমোহন রায় আজও সমান প্রাসঙ্গিক, পর্ব–২

রামমোহনের শিক্ষা
গ্রামের পাঠশালাতে বাল্যশিক্ষা শেষ হলে মেধাবী রামমোহনকে অল্প বয়সেই পড়াশোনা করতে পাঠানো হয় ভারতের পূর্বাঞ্চলে পাটনা শহরে। পাটনা সেসময় ছিল সরকারি অর্থকরি বিদ্যা আরবি ও ফারসি ভাষা শিক্ষার পীঠস্থান। এই ভাষা দুটিতেই পাণ্ডিত্য অর্জন করে রামমোহন আরবি ভাষায় লেখা ইউক্লিড ও এরিস্টটলের লেখা ধর্মগ্রন্থ সমূহ পাঠ করতে শুরু করলেন। এই দুই পণ্ডিত ব্যক্তির যুক্তি ও তত্ত্বপূর্ণ আলোচনা পাঠ করে তাঁর প্রখর বুদ্ধি মার্জিত ও তীক্ষ্ণতর হলো। নানা যুক্তিতর্ক দিয়ে বিভিন্ন ব্যবস্থা প্রচলিত নিয়ম কানুনকে বিচার করার একটা অদম্য স্পৃহা তাঁর অন্তরের অন্তরতম কোণে জেগে উঠলো। এই অতি অল্প বয়সেই কোরাণ পাঠ করে তিনি ইসলামের মূল কথা হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হন। ফারসি ভাষায় সুফিদের লেখা ধর্মতত্ত্বমূলক গ্রন্থাদিও তিনি এক এক করে পাঠ করে ফেললেন কিছু দিনের মধ্যেই। তাছাড়া তিনি হাফিজ, তাব্রিজ, রুমী প্রভৃতি খ্যাতনামা সুফি কবিদের অনেক কবিতা পাঠ করেন। এঁদের লেখা অনেক কবিতা তাঁর কণ্ঠস্থ ছিল। পরে সংস্কৃত ভাষার শিক্ষা আরও পোক্ত করতে এবং হিন্দু ধর্মশিক্ষা করতে তিনি যান বেনারসে। এখানেই উপনিষদ ও মীমাংসাশাস্ত্রের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়।
শোনা যায় তিনি নিম্নলিখিত দশটি ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করে নিজের ও অপরের জ্ঞানার্জনে পথ সুগম করেন—আরবি, ফারসি, সংস্কৃত, বাংলা, ইংরেজি, ঊর্দু, গ্রীক, ল্যাটিন, হিব্রু ও ফরাসী। তিনি অনুধাবন করছিলেন, পারস্যের সুফি ধর্মমতের সঙ্গে বেদান্তের মতের মিল রয়েছে, যেন একই সূত্রে বাঁধা। তিনি ২৪ বছর বয়সে ইংরেজি ভাষা শিখতে শুরু করেন এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে খুবই সুদক্ষভাবে ইংরেজি ভাষা ব্যবহারে পটু হয়ে ওঠেন। তাঁর ইংরেজি শিক্ষালাভের পিছনে যাঁর অবদান ছিল তিনি হলেন এক সহৃদয় ইংরেজ ভদ্রলোক, ‘ডিগবী’ সাহেব। ডিগিবী সাহেবের কথায় পরে আসছি। ইংরেজি ভাষায় জ্ঞানার্জন করে তিনি খ্রিস্টানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বাইবেল অধ্যয়ন করেন। রামমোহন বঙ্গদেশে ইংরেজি শিক্ষার একজন আদি প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ইসলাম ও খ্রিস্ট ধর্ম আলোচনা করে এই সত্যই উপলব্ধি করলেন যে, উভয় ধর্মই ‘ একেশ্বরবাদে ‘ বিশ্বাসী। কিন্তু যত মতবাদ ও বিধি নিষেধ এসে জড়ো হয়েছে হিন্দু ধর্মে। হিন্দু ধর্মের পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে তাঁর মন অধিকতর বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
বেদ, বাইবেল, কোরান, পুরাণ, উপনিষদ, গীতা, ভাগবত, জেন্দাবেস্তা, ত্রিপিটক ইত্যাদি সকল ধর্মশাস্ত্র গভীর মনোনিবেশ সহকারে অধ্যয়নের পর রামমোহন এই সত্যে উপনীত হয়েছিলেন যে সকল ধর্মই মূলত এক। একই ঈশ্বরে বিশ্বাস সকল ধর্মের মূল কথা। সামাজিক ও ধর্মীয় আচার আচরণ ও বাধা নিষেধের কোনো মূল্য নেই। সকল ধর্মের মূলগত ঐক্যের সুর হৃদয়ে উপলব্ধি করেছিলেন। প্রতীক ধর্মানুষ্ঠান মানুষকে জাতিভেদের ও পরস্পর বিরোধের শিকার করে তোলে তাও তিনি সম্যকরূপে অনুধাবন করেন। এর ফলে, একদিকে যেমন তিনি একেশ্বরবাদের দিকে ঝুঁকেছিলেন, অন্যদিকে তেমনি এটাও উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে হিন্দু ধর্ম যদি তার নিজস্ব গোঁড়ামিকে বর্জন করতে না পারে, এবং কূপমণ্ডুক মানসিকতাকে অতিক্রম করে যদি বিশাল জগতের সঙ্গে নিজেদের মিলিয়ে নিতে না পারে, তাহলে হিন্দু ধর্ম ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়বে। সব ধর্মের প্রকৃত সত্য সবাইকে জানানোর জন্যই নানা ভাষায় বই লিখতে শুরু করেন রামমোহন রায়। ১৮০৪ সালে একেশ্বরবাদ নিয়ে আরবি ও ফারসি ভাষায় রামমোহন রায়ের প্রথম বইটি প্রকাশিত হয় তুহফাত-উল-মুয়াহহিদিন নামে। ফারসি ভাষায় লেখা এই বইয়ের মুখবন্ধ ছিল আরবিতে লেখা।
শুধু হিন্দু, মুসলিম ও খ্রিস্টান ধর্মই নয় বৌদ্ধধর্ম জানতে রামমোহন বৌদ্ধ ধর্মের পীঠস্থান তিব্বতেও গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়েও তিনি অবাক হয়ে গেলেন। ধর্মের নামে স্বেচ্ছাচার। দেবতার দোহাই দিয়ে ব্যক্তি পুজোর প্রাধান্য। ধর্মান্ধ সহজ-সরল জনগণের কাছে দেবতার আসন গ্রহণ করেছে লামারা। বৌদ্ধধর্মালম্বী যাজক বা পুরোহিত, তিব্বতীদের ভাষায় বলা হয় লামা। লামারাই সর্বেসর্বা। স্বার্থানেষী লামাদের একাধিপত্য তিনি বন্ধ করতে মনস্থ করলেন। সাধারণ তিব্বতিদের বোঝাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু হিতে বিপরীত হল। স্বার্থে আঘাত লাগলে লামারা গেল খেপে । রামমোহনের জীবন সংশয় দেখা দিল। অবশেষে স্থানীয় এক করুণাময়ী নারী কৌশলে রামমোহনকে লামাদের চোখে ধূলো দিয়ে তিব্বত থেকে সরিয়ে দিলেন। বাল্যকাল থেকেই রামমোহন স্ত্রীজাতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা অন্তরে পোষণ করতেন। এ ঘটনার পর থেকে তাঁর মনে স্ত্রীজাতির প্রতি শ্রদ্ধা আরও গভীরতর হলো। নারী জাতির প্রতি তাঁর মনোভাব পরবর্তীকালে তাঁর প্রতিটি কাজের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে।
রামমোহনের কর্মজীবন
১৮০১ খ্রিস্টাব্দে রামমোহন কলকাতায় পা রাখেন। কর্মবহুল জীবনে তিনি মাত্র নয় বছর চাকরি করেছিলেন। দু’বছরেরও কম সময় তিনি কাজ করেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মী হিসাবে। সে সময়টা খুব সম্ভবত ১৮০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। পরবর্তীতে সাত বছরেরও বেশি সময় তিনি দেওয়ানের কাজ করেন সদা প্রফুল্ল কর্মঠ ইংরেজ ডিগবী সাহেবের অধীনে। এঁর কথা আগেই উল্লেখ করেছি। ১৮১৪ সালে কলকাতায় রামমোহন দুটি বাড়ি কেনেন— একটি চৌরঙ্গি পাড়ায়, অন্যটি মানিকতলায়। দুটি বাড়িই সাহেবদের কাছ থেকে কেনা। পরবর্তীতে হিন্দু ধর্মের আচার ও পৌত্তলিকতা নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে বাবা মার সঙ্গে তাঁর তীব্র বিরোধ বাঁধে এবং বাবা তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করে দিলে রামমোহন কলকাতায় পাকাপাকিভাবে চলে আসেন ১৮১৫ সালে। কলকাতায় আসার পরেই তাঁর অভ্যন্তরের সঞ্চিত আগুন প্রজ্জ্বলিত হতে আরম্ভ করে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, রামমোহনের পরিপূর্ণ ধর্ম ও কর্ম-জীবন মাত্র আঠারো বছরের, ১৮১৫ সাল থেকে ১৮৩৩ সাল পর্যন্ত। অর্থাৎ চল্লিশ বছর কেটে যাবার পর তাঁকে ধর্ম ও সমাজ নিয়ে চর্চা ও আন্দোলনে পূর্ণরূপে ঝাঁপাতে দেখি। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে ‘ রামমোহন রায়ের জীবনী ‘ প্রবন্ধে বলেছেন – “…… চল্লিশ-পার বয়সটা মানুষের পরিপক্ক বা matured জীবনই বলব। হজরত মহম্মদ এই বয়সে তাঁর বিশ্ব-ধর্মপ্রচার-কার্য আরম্ভ করেন। কিন্তু মনের maturity বয়স-নিরপেক্ষ; তার প্রমাণ যীশুখ্রিষ্ট, শঙ্করাচার্য, ডিরোজিও, কীটস, বিবেকানন্দের জীবন — চল্লিশ বছর না পৌঁছতেই এঁদের তিরোধান হয়। ”
দীপক সাহা : শিক্ষক ও লেখক, ভারত