যুগ-প্রবর্তক রাজা রামমোহন রায় আজও সমান প্রাসঙ্গিক, পর্ব–১

২০০৪ সালে বিবিসি বাংলা একটি ‘শ্রোতা জরিপ’-এর আয়োজন করে। বিষয়টি ছিলো —সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে? তিরিশ দিনের ওপর চালানো জরিপে শ্রোতাদের ভোটে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ ২০ জনের জীবন নিয়ে বিবিসি বাংলায় বেতার অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয় ২০০৪-এর ২৬ মার্চ থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত। বিবিসি বাংলার সেই জরিপে শ্রোতাদের মনোনীত শীর্ষ ২০ জন বাঙালির তালিকায় দশম স্থানে আসেন যুগ প্রবর্তক রাজা রামমোহন রায়। মানুষের জীবন দেশ ও কাল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু দেশ ও কালের প্রভাবকে স্বীকার করেও যিনি উত্তীর্ণ হন তিনিই মহাপুরুষ। জাতিগত, ধর্মগত, ভাষাগত, সমাজগত, রাষ্ট্রগত বহু সংস্কারের বর্ম ভেদ করে বিশ্বের দরবারে মুক্ত আলোকে এসে দাঁড়ান মহামানব। কঠিন সংগ্রামের কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করে যিনি এসেছেন তিনি চিরমানব। তাঁদেরই অন্যতম রাজা রামমোহন রায়। ভারতপথিক রামমোহন রায় সনাতন সামন্ততান্ত্রিক দর্শনের যুক্তিসিদ্ধ বিরোধিতা করে ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রবক্তারূপে প্রথম আধুনিক ভারতীয় মানুষ হিসেবে স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন।
তাঁর জন্মের ২৫০ বছরে তাঁর জীবন-কথা।
মোগল সাম্রাজ্যের পতনের পর রাজনৈতিক আবর্তে বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে এবং নানা অশিক্ষা ও কুসংস্কারের চাপে সমাজের স্বাভাবিক ধারা রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। দেশভূমি তখন অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত। হতাশা, দীনতা, নৈরাজ্য বাংলার মানুষের মনে আত্মবিশ্বাস, সাহস ও ধর্মবিশ্বাস নষ্ট করেছিল। সেই অন্ধকারময় সময়েই আলোকবর্তিকার ন্যায় আবির্ভূত রামমোহন অন্ধকারাচ্ছন্ন হিন্দু সমাজে আলোক জ্বালিয়ে দিলেন। সেই সময় কুসংস্কারাচ্ছন্ন বৃহত্তর বঙ্গসমাজ ‘রে রে’ করে ওঠল। তারা তীব্রভাবে রামমোহন রায়ের বিরুদ্ধাচারণ করতে লাগল। কিন্তু বাস্তবে তিনিই মুমুর্ষ হিন্দুধর্মে প্রাণ সঞ্চার করলেন। সমগ্র হিন্দুসমাজ তথা ভারতবর্ষ এইজন্য তাঁর নিকট চির ঋণী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চারিত্রপূজা গ্রন্থে ‘রাজা রামমোহন রায় ‘ প্রবন্ধে সুন্দরভাবে রামমোহনের অবদান উল্লেখ করেছেন ,”…… কী সঙ্কট সময়েই রামমোহন জন্মিয়াছিলেন। তাঁহার একদিকে হিন্দুসমাজের ‘তটভূমি জীর্ণ’ হইয়া পড়িতেছিল, আর একদিকে বিদেশীয় সভ্যতাসাগরের প্রচণ্ড বন্যা বিদ্যুৎবেগে অগ্রসর হইতেছিল—রামমোহন রায় তাঁহার অটল মহত্বে মাঝখানে আসিয়া দাঁড়াইলেন। তিনি যে বাধ নির্মাণ করিয়া দিলেন খৃস্টীয় বিপ্লব সেখানে আসিয়া প্রতিহত হইয়া গেল। সে সময়ে তাঁহার মতো মহৎ লোক না জন্মাইলে এতদিন বঙ্গদেশে হিন্দুসমাজে এক শোচনীয় মহাপ্লাবন উপস্থিত হইত। ”
পঞ্চদশ শতাব্দিতে ইটালিতে যে নবজাগরণ হয় তা যেমন কালে কালে সমগ্র ইউরোপে পরিব্যাপ্ত হয়েছিল। অনুরূপ উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে পাশ্চাত্য শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার সংস্পর্শে এসে বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনে পুনরায় যে নতুন জাগরণ সৃষ্টি হয়, তাকেই বাংলার নবজাগরণ বলা হয়। বাংলার নবজাগরণ তেমনি ক্রমে ক্রমে সমগ্র ভারতভূমিকে প্লাবিত করেছিল। পেত্রার্ক ও বোকাচ্চিও যেমন ইটালির নবজাগরণের অগ্রদূত ছিলেন তেমনি পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত রামমোহন ছিলেন বাংলা তথা ভারতীয় নবজাগরণের অগ্রদূত। রামমোহন রায় পরিচালিত সংস্কার আন্দোলনে যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী চেতনার প্রতিফলন পড়েছিল। সামাজিক দাসবুদ্ধির হাত থেকে তিনি বাঙালিকে মুক্তি দেবার জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন। প্রচলিত সামাজিক কুসংস্কার ও গোঁড়ামির অপসারণ করে তিনি সমাজ জীবনকে কলুষ মুক্ত করতে চেয়ে ছিলেন। ধর্ম ও সমাজ সংস্কারক, রাজা রামমোহন রায় ভারতের নবজাগরণের পথিকৃৎ।
বংশ পরিচয় ও জন্ম:
সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করলেও রামমোহনের পাঁচ পুরুষের মধ্যে কাউকে কোশাকুশি নিয়ে ত্রিসন্ধ্যা করে, যজন-যাজন,অধ্যাপনা প্রভৃতি সদব্রাহ্মণোচিত কর্মে লিপ্ত হয়ে জীবিকা অর্জন ও জীবনযাপন করতে দেখিনি। সে-যুগে অনেক বাঙালিই অর্থোপার্জনের উদ্দেশ্যে মুসলমান শাসকদের রাজস্ব বিভাগে চাকুরি গ্রহণ করতেন এবং সেই চাকুরিলব্ধ অর্থে ভূসম্পত্তি কিনে নিজের গ্রামে জমিদার বা তালুকদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার চেষ্টা করতেন। রামমোহনের পূর্বপুরুষরাও এই শ্রেণিভুক্ত ছিলেন। রামমোহনের প্রপিতামহ কৃষ্ণচন্দ্র বাংলার স্বাধীন নবাব সরকারে চাকরি করে ‘রায়-রায়ান্ ‘ উপাধি পেয়েছিলেন, আসলে তাঁরা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর পিতামহ ব্রজবিনোদ আলিবর্দী খাঁর শাসনকালে বিশিষ্ট কর্মচারী ছিলেন। এঁরা ছিলেন সুরাই মেলের ব্রাহ্মণ। রামমোহনের নামে ছড়া চলিত হয়—
” সুরাই মেলের কুল,
বেটার বাড়ি খানাকুল,
ওঁ তৎসৎ বলে বেটা বানিয়েছে ইস্কুল। ”
খানাকুল এখন হুগলির অন্তর্গত। তখন জেলা ভাগ হয়নি- বর্ধমান চাকলার মধ্যে ছিল এই গ্রাম। রামমোহনের প্রপিতামহ এখানে এসে বাস করেন সর্বপ্রথম; পরে দ্বারকেশ্বর নদীর ওপারে রাধানগরে গিয়ে বসতি স্থাপন করেন। রাধানগর রামমোহনের জন্মস্থান।
পলাশীর যুদ্ধের (১৭৫৭) মাত্র ১৫ বছর পরে কলকাতা থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে হুগলির রাধানগর গ্রামে ১৭৭২( মতান্তরে ১৭৭৪) সালের ২২ মে জন্মগ্রহণ করেন রামমোহন রায়। পিতা রামকান্ত রায় এবং মা তারিণী দেবী। রামকান্ত রায় মুর্শিদাবাদ সরকারে কাজ করতেন বলে জানা যায়। কিন্তু পর-জীবনে তাঁকে নিজগ্রামে বিষয়-সম্পত্তি তত্ত্বাবধানে লিপ্ত হতে দেখা যায়। রামমোহনের মাতৃকুল ছিল গোঁড়া শাক্ত, পিতৃকুল নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব।
এ প্রসঙ্গে সুবোধ চক্রবর্তীর ভারতপথিক রামমোহন জীবনীআলেখ্যে লেখা একটি অদ্ভুত ঘটনা উল্লেখ না করে পারলাম না। রামমোহনের মাতামহ শ্যাম ভট্টাচার্য ছিলেন গোঁড়া শৈব—শিবের উপাসক। তারিণীদেবী একবার রামমোহনকে নিয়ে বাপের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলেন। রামমোহন তখন পাঁচ-ছ’বছরের বালক। একদিন শ্যাম ভট্টাচার্য শিব মন্দিরে পুজো-আচ্চা সেরে বাইরে বেরিয়ে দেখেন নাতি রামমোহন খেলায় মত্ত। দাদু আদর করে নাতিকে ঠাকুরের বেলপাতা দিলেন। খেলার ঝোঁকে ছোট্ট রামমোহন বেলপাতা মাথায় না ঠেকিয়ে মুখের ভেতরে দিয়ে চিবোতে শুরু করলেন। আর যায় কোথায়! দাদু নাতির নাস্তিক ব্যবহারে রেগে অগ্নিশর্মা। চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন। তারিণীদেবী হন্তদন্ত হয়ে বাবার সামনে হাজির। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভট্টাচার্য মহাশয় তর্জনী উঁচু করে ক্রোধে গর্জনরত অবস্থায় মেয়েকে বললেন, ‘ আমি অভিশাপ দিচ্ছি তারিণী, তোর ছেলে নির্ঘাত বিধর্মী হবে। ‘ তারিণীদেবী অনিশ্চিত বিপদের আশঙ্কায় ভেঙে মুষড়ে পড়লেন। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর মেয়ের কান্না দেখে ধর্মান্ধ ক্রুদ্ধ পিতা সান্ত্বনার সুরে মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, ” দুঃখ করিসনে মা। ব্রাহ্মণ অভিশাপ ফেরানো যায় না। কিন্তু তোর ছেলেকে আমি আশীর্বাদ করছি মা, তোর ছেলে বিদ্বান ও বুদ্ধিমান হবে। তোর ছেলে দেশে-বিদেশে রাজার সম্মান পাবে। তুই দেখে নিস আমার কথা। ” কাকতালীয় হলেও দাদুর কথা ভবিষ্যতে অক্ষরে অক্ষরে ফলেছিল।
[চলবে..]
1 thought on “যুগ-প্রবর্তক রাজা রামমোহন রায় আজও সমান প্রাসঙ্গিক, পর্ব–১”