আত্মাহুতি দিবসে স্মরণ করি ক্ষুদিরামের জীবন দর্শন

ক্ষুদিরামের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা হচ্ছে। ছবি: সংগৃহীত
প্রতিবছর আমরা ১১ আগস্ট বিপ্লবী ক্ষুদিরামের প্রতিকৃতিতে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা ভক্তিতে দেশপ্রেমের উদ্বেলিত হয়ে বিনম্র চিত্তে পালন করি তাঁর আত্মাহুতি দিবস। আমরা বড় বড় গালভরা, নৈতিকতা, দেশাত্মবোধ জাগানিয়া, সংগ্রামী মনোভাবের বুলি আওড়াতে থাকি সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সংবাদপত্র টেলিভিশনের পর্দায়। একটি প্রশ্ন আমাদের বিবেক চেতনায়, জাগ্রত মননে অহর্নিশ ঘুরপাক খেতে থাকে আমরা কি পেরেছি বিপ্লবী স্বাধীনতা সংগ্রামী, শহীদ, মহান নেতা মহাপুরুষদের জীবন দর্শন, ভাবনা সাধনাকে চলার পথের পাথেয় করতে। এক কথাই বললে না আমরা সেখান থেকে শত যোজন দূরে রয়ে গেছে। আমাদের চলাফেরা, জীবনযাত্রায় রয়ে গেছে বিস্তর ফারাক।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের মধ্যে জন্মেছে সাম্প্রদায়িকতার আগাছা। প্রতিমুহূর্তে ভেঙে দিচ্ছে সম্প্রীতি, ঐক্য, সংহতি, সুস্থতার চিরায়ত বাতাবরণ। রাজনীতির বিভাজনে সৃষ্টি হয়েছে আমাদের মধ্যে বিভেদের প্রাচীর। সময় এসেছে আমাদের নতুন করে ভাবতে, শিখতে, সে ক্ষেত্রে বীর শহীদ, বিপ্লবীদের জীবন দর্শন আমাদের আবারও মনুষ্যত্বের পূর্ণ বাঁধনে জুটতে পারে। তাই আসুন আমরা সবাই মিলেমিশে একাকার হয়ে দেশাত্মবোধের নিবেদিত টানে মনুষ্য চেতনায় উদ্বেলিত হয়ে জীবনের চলার পথে মিলিয়ে দয় তাদের দেখানো মিলনের পথ।

এবারে একটু চোখ ফেরানো যাক, সেই সময়ের বাংলার বিক্ষুব্ধ প্রেক্ষাপটে। ব্রিটিশ সরকার বিভাজনের নীতির বাস্তবায়নে ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয়। গোটা বাংলা বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য তীব্র আন্দোলন, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ আছড়ে পড়ল উত্তাল ঢেউয়ের মতো। এ সময়েই কলকাতার যুগান্তরে মেদিনীপুর থেকে একটি বিপ্লবীদের দল কর্মী হিসেবে যোগ দিতে আসেন। আর সেই দলের কনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন ক্ষুদিরাম বসু। ছোটবেলা থেকেই চরম দুরন্ত বেপরোয়া, জেদি প্রকৃতির ক্ষুদিরাম বিপ্লবী চেতনার ছোঁয়া পেয়ে হ্যাঁ ধারণা লাভে এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে উঠলেন। তখন থেকেই তারমধ্যে ব্রিটিশ শাসকের প্রতি তীব্র ঘৃণা, বিদ্বেষ, প্রতিশোধ স্পৃহা প্রচণ্ডভাবে জমতে থাকল। তাঁর কিছুটা নমুনা পাওয়া যায় বিপ্লবী হেমচন্দ্র কানুনগোর সঙ্গে ক্ষুদিরামের প্রথম সাক্ষাতের ঘটনায়।ক্ষুদিরামের বয়স তখন তের-চৌদ্দ। একদিন হেমচন্দ্র কানুনগো মেদিনীপুরের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর মোটর গাড়ি আটকালেন ক্ষুদিরাম। হেমচন্দ্র কে বললেন “আমাকে একটা রিভলবার দিতে হবে।”অচেনা অজানা একটা অবোধ বালকের এই অনভিপ্রেত প্রশ্নের আবদারে স্বভাবত বিস্মিত হয়ে হেমচন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, “তুই রিভলবার দিয়ে কী করবি?” জবাবে শুনলেন, “সাহেব মারব।” হেমচন্দ্র সেদিন তাকে ধমক দিলেও বাচ্চা ছেলের বুকে মুক্তির আগুন, বিপ্লবের বারুদ দেখে অভিভূত হয়েছিলেন। সেই থেকেই তিনি ক্ষুদিরামের মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন জ্বলন্ত দেশ প্রেম, বিপ্লবী চেতনা। সেখানে একটি প্রশ্ন ব্রিটিশ শাসনের শৃংখল থেকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা। ক্ষুদিরাম বসু, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক অমর নাম। দেশের স্বাধীনতার জন্য ফাঁসির মঞ্চে যারা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে প্রথম বিপ্লবী ছিলেন তিনি।

ভারতবর্ষকে স্বাধীন করতে ক্ষুদিরাম বসুর এই আত্মত্যাগ আজও অনুপ্রেরণা যোগায় এবং উৎসাহিত করে দেশপ্রেমের অগ্নিমন্ত্রে শপথ নিতে। তৎকালীন বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ও স্বদেশী আন্দোলনের কর্মীদের প্রয়োজনভিত্তিক কঠোর সাজা ও দমননীতির কারণে কলকাতার প্রধান প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড বাঙালিদের অত্যন্ত ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন। যুগান্তর বিপ্লবীদল ১৯০৮ সালে তাঁকে হত্যার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং প্রফুল্ল চাকী ক্ষুদিরামের উপরে দায়িত্ব পড়ে। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ কিংসফোর্ডকে কলকাতা থেকে দূরে মুজাফ্ফরপুরে সেশন জাজ হিসেবে বদলি করে দিয়েছিলেন। দুই যুবক ৩০ এপ্রিল স্থানীয় ইউরোপীয় ক্লাবের গেটের কাছে একটি গাছের আড়ালে অতর্কিত আক্রমণের জন্য ওত পেতে থাকেন। কিন্তু কিংসফোর্ডের গাড়ির মতো অন্য একটি গাড়িতে ভুলবশত বোমা মারলে গাড়ির ভেতরে একজন ইংরেজ মহিলা ও তাঁর মেয়ে মারা যান। এ ঘটনার পর ক্ষুদিরাম ওয়ানি রেলস্টেশনে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। তিনি বোমা নিক্ষেপের সমস্ত দায়িত্ব নিজের উপর নিয়ে নেন। কিন্তু অপর কোনো সহযোগীর পরিচয় দিতে বা কোনো গোপন তথ্য প্রকাশ করতে রাজি হননি। তাঁকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য অনুসারে মুজফ্ফরপুর কারাগারে ১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট।ক্ষুদিরাম নির্ভয়ে হাসতে হাসতে উঠে গেলেন ফাঁসির মঞ্চে। কৃতকর্মের জন্য তার বিন্দুমাত্র অনুশোচনা হলো না। আর হবেই বা কেন, তিনি তো স্বাধীনতার জন্য, দেশকে শত্রুমুক্ত করার জন্য কাজ করেছেন। আর এ জন্যই তো ক্ষুদিরাম বসু মরে গিয়েও বেঁচে রয়েছেন আমাদের মাঝে। বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল।ইতিহাসের পাতা উল্টিয়ে ৭৫তম স্বাধীনতা বর্ষে দাঁড়িয়ে জেনে নেওয়া যাক ভারতবর্ষের কনিষ্ঠতম শহীদ ক্ষুদিরাম বসুর জীবনী সম্পর্কে।প্রস্তুত ১৫ ফুট উঁচু ফাঁসির মঞ্চ। ফাঁসি হওয়ার আগের দিন অর্থাৎ ১০ অগাস্ট মেদিনীপুরের নির্ভীক সন্তান ক্ষুদিরাম বসু আইনজীবী সতীশচন্দ্র চক্রবর্তীকে বলেছিলেন, ‘রাজপুত নারীরা যেমন নির্ভয়ে আগুনে ঝাঁপ দিয়া জওহর ব্রত পালন করিত, আমিও তেমন নির্ভয়ে দেশের জন্য প্রাণ দিব। আগামীকাল আমি ফাঁসির আগে চতুর্ভুজার প্রসাদ খাইয়া বধ্যভূমিতে যাইতে চাই।’ এরপর ফাঁসির মঞ্চে উপস্থিত হলে তাঁর গলায় ফাঁসির দড়ি পরানো মাত্রই জল্লাদকে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন “ফাঁসির দড়িতে মোম দেওয়া হয় কেন?”— এটাই তাঁর শেষ কথা, যা শুনে চমকে গিয়েছিল জল্লাদও। এমন কী ফাঁসির ঠিক আগে শেষ ইচ্ছা হিসেবে তিনি বলেছিলেন, ব্রিটিশ সরকারের অনুমতি পেলে তিনি তাঁর বোমা বানানোর শিক্ষা ভারতবর্ষের অন্যান্য যুবকদেরও শিখিয়ে যেতে চান।
ক্ষুদিরামের মৃত্যু হয়েছে আজ এক শতাব্দীরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। এই নামটি আমাদের কাছে এখনো বিপ্লবের প্রতীক হয়ে আছে। ক্ষুদিরাম যুগে যুগে আমাদের অনুপ্রেরণা দিয়ে আসছেন মুক্তির স্বপ্ন দেখতে, অন্যায়ের প্রতিরোধ করতে। অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ রুখে দাঁড়াতে, দেশকে প্রানের থেকে বেশি ভালোবাসতে গেলে, সত্যনিষ্ঠা, আদর্শকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে গেলে, বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ, উদ্বেলিত, জারিত হতে গেলে আমাদের প্রত্যেকের মনেই দামাল ছেলে ক্ষুদিরামের জীবন দর্শন, আত্মত্যাগ, বিদ্রোহী ভাবনার বীজ বপন করতেই হবে। বর্তমানে চারিদিকে যখন সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা, বিদ্বেষ ভেদাভেদ, বিভাজনের দুর্বিষহ রাজনীতি, তৎসহ করোনা সংক্রমনে বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত বাঙালি তথা ভারতীয়রা ঠিক সেই সময়ে ক্ষুদিরামের আত্মোৎসর্গ, আত্মবলিদান, প্রগাঢ় ও দেশাত্মবোধ আমাদের উত্তরণের পথ দেখাবে।
১১৪তম আত্মাহুতি দিবসে বিপ্লবী ক্ষুদিরামের প্রতি রইল শ্রদ্ধা ভক্তি প্রণাম।
পাভেল আমান : হরিহর পাড়া,মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
আরও পড়ুন :হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়ি বরণ করেছিলেন বিপ্লবী ক্ষুদিরাম