বঙ্গবন্ধুর বইয়ে বঙ্গমাতা

কিছু কিছু মানুষ পৃথিবীতে আসেন, রেখে যান পদচিহ্ন। নিরাভরণ জীবন আর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তাদের জীবনটা হয় মহামূল্যবান। এই জীবনের প্রতি ধাপে থাকে সংগ্রাম আর যুদ্ধ। সেই যুদ্ধ করে যিনি টিকে থাকতে পারেন তিনিই হয়ে যান অনুকরনীয়। ঠিক তেমনি একজন মানুষ মাত্র ৪৪ বছরের জন্য পৃথিবীতে এসেছিলেন। যে সময়ে একজন কিশোরী ঘুরে বেড়াবে মাঠে ঘাঠে। দুরন্তপনায় থাকবে ব্যস্ত। সেসময়ে বিয়ের মালা পরেছিলেন। বাইগার নদীর তীর ঘেঁষে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন বেগম ফজিলাতুন্নেসা। তিনি বাঙালির বঙ্গমাতা। বঙ্গবন্ধুর রেণু। ‘রেণু’শব্দের অর্থ ‘উদার’। ঠিক যেন নামের সঙ্গে মিলে যায় তাঁর জীবন। গ্রামে কোনো মেয়ে এসএসসি উর্ত্তীণ হলো, তাঁকে ঢাকায় এসে পড়াতে হবে, তারপর লেখাপড়া শেষ করে বিয়ে দিতে হবে । সবই যেন ছিল তাঁর নখদর্পনে। শচীন দেববর্মন, জগন্ময় মিত্রের গান, সুন্দর করে পান সাজানো, লুচি ভেঁজে পরিবারের সবাইকে খাওয়ানো সবই যেন তাঁর জীবনের একটি অংশ। এই মানুষটি ছায়ার মত বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে বঙ্গবন্ধুকে নীরবে সমর্থন দিয়েছেন। কখনো সংকটকালে পরামর্শক হিসেবে হাজির হয়েছেন। ছেলেমেয়েদের নিপুণভাবে দেখভাল করা। এ যেন দশভুজা এক নারী। যাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। বঙ্গবন্ধু তাঁর লিখিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ে বেশ কয়েকবার উল্লেখ করেছেন। আজ মহীয়সী বঙ্গমাতার ৯১তম জন্মদিনে সেই বিষয়গুলো তুলে ধরছি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’
অসমাপ্ত আত্মজীবনীর সাত পৃষ্ঠায় বেগম মুজিবের আগমণ একজন বধূ হিসেবে, যাঁর নাম রেণু। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন,‘একটা ঘটনা লেখা দরকার, নিশ্চয়ই অনেকে আশ্চর্য হবেন। আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বার বা তের বছর হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাবার পরে ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন,‘তোমার বড় ছেলের সাথে আমার এক নাতনীর বিবাহ দিতে হবে। কারণ, আমি সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাব’। রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরব্বীর হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিষ্ট্রি করে ফেলা হলো। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধ হয় তিনবছর হবে। রেণুর যখন পাঁচ বছর বয়স, তখন তার মা মারা যান। একমাত্র রইল তার দাদা। দাদাও রেণুর সাত বছর বয়সে মারা যান। তারপর সে আমার মা’র কাছে চলে আসে। আমার ভাইবোনদের সাথেই রেণু বড় হয়। রেণুর বড় বোনের ও আমার আর এক চাচাতো ভাইয়ের সাথে বিবাহ হয়। রেণু আমার শশুড়বাড়িতে থাকল, কারণ আমার ও রেণুর বাড়ির দরকার নেই। রেণুদের ঘর আমাদের ঘর পাশাপশি ছিল, মধ্যে মাত্র দুই হাত ব্যবধান। অন্যান্য ঘটনা আমার জীবনের ঘটনার মধ্যেই পাওয়া যাবে।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী; ৭-৮)।

এই হলো রেণু’র জীবন। অপর আর এক স্মৃতিকথায় দেখা যায়, ‘রেণু কয়েকদিন আমাকে খুব সেবা করল। যদি ও আমাদের বিবাহ হয়েছে ছোটবেলায়। ১৯৪২ সালে আমাদের ফুলশয্যা হয়’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী: ২১)। বঙ্গবন্ধু যখন কলেজে ভর্তি হলেন, তখন থেকেই ফজিলাতুন্নেসা মানসিক সাহায্য প্রদান করেছেন। ‘আব্বা, মা, ভাইবোনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রেণুর ঘরে এলাম বিদায় নিতে। দেখি কিছু টাকা হাতে করে দাড়িঁয়ে আছে। ‘অমঙ্গল অশ্রুজল’ বোধ হয় অনেক কষ্টে বন্ধ করে রেখেছে। বলল,‘একবার কলকাতা দেখলে আর আসতে চাওনা। এবার কলেজ ছুটি হলেই বাড়ি এসো (অসমাপ্ত আত্মজীবনী: ৬১)। বঙ্গবন্ধু ইসলামিয়া কলেজে যখন পড়তে গেলেন। কলেজ প্রিন্সিপাল ডেকে বললেন, তুমি কলকাতা শহরে থাকতে পারবে না। অতঃপর তিনি শহরের বাইরে উল্টোডাঙ্গাতে তার বোনের বাড়িতে থাকলেন। বঙ্গবন্ধু যেন নিরবচ্ছিন্নভাবে লেখাপড়া করতে পারেন এজন্য তাঁকে উৎসাহ দেবার লক্ষ্যে তিনি উল্টোডাঙ্গা গিয়েছেন। এই স্মৃতিকথাটিতে তারই প্রমাণ পাওয়া যায়, ‘কিছুদিন পর রেণু ও কলকাতায় এসে হাজির। রেণুর ধারণা, পরীক্ষার সময় কাছে আমার কাছে থাকলে আমি নিশ্চয়ই পাস করব। বিএ পরীক্ষা দিয়ে পাস করলাম।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী:৭২)।

‘টাকা পয়সা নাও থাকতে পারে। টাকার দরকার হলে লিখতে বলেছিল। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী:১১৮)। নীরবে নিভৃতে বঙ্গবন্ধুর পাশে তিনি সৌভাগ্যের প্রতীক হয়ে ছিলেন। মাঝে মাঝে তাঁর অভিমানের বাঁধ ভেঙে যেত। কিন্তু কিছুই প্রকাশ করতেন না। ‘রেণু বলল,‘এভাবে তোমার কতকাল চলবে’। আমি বুঝতে পারলাম, যখন আমি ওর কাছে এলাম। রেণু আড়াল থেকে সব কথা শুনছিল। রেণু খুব কষ্ট করত, কিন্তু কিছুই বলত না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্যে টাকা পয়সা জোগাড় করে রাখত যাতে আমার কষ্ট না হয় (অসমাপ্ত আত্মজীবনী:১২৬)’।

‘লাহোর থেকে রেণুকে চিঠি দিয়েছিলাম, বোধ হয় পেয়ে থাকবে।’ ‘লাহোর থেকে ফিরে নিশ্চয়ই একবার বাড়িতে আসব। রেণু তো নিশ্চয়ই পথ চেয়ে বসে আছে। সে তো নীরবে সকল কষ্ট সহ্য করে,কিন্তু কিছু বলে না। কিছু বলে না বা বলতে চায়না, সেইজন্য আমার আর ও বেশী ব্যথা লাগে (অসমাপ্ত আত্মজীবনী: ১৪৫-১৪৬)।
‘গোপালগঞ্জ গিয়ে দেখি থানার ঘাটে আমাদের নৌকা। আব্বা,মা,রেণু,হাচিনা ও কামালকে নিয়ে হাজির। ঘাটেই দেখা হয়ে গেল (অসমাপ্ত আত্মজীবনী: ১৮৩)।

ধৈর্যশীল রেণু বাচ্চাগুলোকে নিয়ে একাই দিনাতিপাত করেছেন। অপেক্ষা করেছেন কখন বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে ফিরবেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল শান্ত নদীর মতো বয়ে যাওয়া স্রোত, মাঝে মাঝে সেই স্রোত খরস্রোতা হয়ে যেত। এই স্মৃতিকথাটুকু তাই প্রমাণ করে। ‘রেণু আমাকে যখন একাকী পেল,বলল, ‘জেলে থাকো আপত্তি নেই, তবে স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখ। তোমাকে দেখে আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেছে। তোমার বোঝা উচিত আমার দুনিয়ায় কেউ নাই। ছোটবেলায় বাবা-মা মারা গেছেন, আমার কেউই নাই। তোমার কিছু হলে বাঁচব কি করে?” কেঁদেই ফেলল। আমি রেণুকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, তাতে ফল হয় উল্টা। আরও কাঁদতে শুরু করল।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী: ১৯১)।
রেণু মাঝে মাঝে রাগতস্বরে অভিমান নিয়ে কথা বলতেন। ‘কেন তুমি অনশন করতে গিয়েছিলে? এদের কি দয়া মায়া আছে? আমাদের কার ও কথাও তোমার মনে ছিল না? কিছু একটা হলে কি উপায় হত? আমি এই দুইটা দুধের বাচ্চা নিয়ে কি করে বাঁচতাম? হাচিনা, কামালের অবস্থা কি হত? তুমি বলবা,খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট তো হত না? মানুষ কি শুধু খাওয়া পরা নিয়েই বেঁচে থাকতে চায়? আর মরে গেলে দেশের কাজই বা কিভাবে করতা?” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী: ২০৭)।
কতটুকু দেশপ্রেমিক হলে এমন প্রশ্নবানে জর্জরিত করতে পারেন বঙ্গবন্ধুকে। একসময় রেণু চিরচেনা গ্রাম ছেড়ে সন্তানদের নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। ভাড়া থাকেন ঢাকার বিভিন্ন স্থানে। এই স্মৃতিকথা থেকে তাই জানা যায়,‘রেণু ঢাকায় এসেও শান্তিতে বাস করতে পারেননি। ‘আমি সন্ধ্যার দিকে ঢাকায় ফিরে এলাম। বাসায় যেয়ে দেখি রেণু ছেলেমেয়ে নিয়ে গতকাল ঢাকায় এসেছে। সে এখন ঢাকায়ই থাকবে’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী: ২৬২)।

‘কারাগারের রোজনামচা’য় বঙ্গমাতা
‘আমার স্ত্রীও তখন নতুন ঢাকায় এসেছে। বাংলাদেশ ভাগ হওয়ার পূর্বে যদিও কলিকাতা গিয়াছে, কয়েকবার আমাকে দেখতে, কিন্তু ঢাকায় সে একবারে নতুন; সকলকে ভাল করে জানেও না। মহাবিপদে পড়লো। সরকার হুকুম দিয়েছে ১৪ দিনের মধ্যে বাড়ি ছাড়তে। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে মহাবিপদেই পড়ল আমার স্ত্রী’ (কারাগারের রোজনামচা:১২০)।
তাও হাল ছেড়ে দেননি রেণু। একসময় রেণু বড় মেয়ের বিয়ের জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। রেণু দেখা করতে এসেছিল। রেহানার জ্বর, আসে নাই। রাসেল জ্ব্র নিয়ে এসেছিল। হাচিনার বিবাহের প্রস্তাব এসছে। রেণু ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। (কারাগারের রোজনামচা: ১৯৪)।

‘১৪ তারিখে রেণু বিশেষ অনুমতি নিয়ে দেখা করতে এসেছে। ঈদের জন্য এই অনুমতি দিয়েছে।’ (কারাগারের রোজনামচা:২০৩)।’
কারাগারের বঙ্গবন্ধুর জন্য নিয়মিত খাবার পাঠাতেন রেণু। ‘যথারীতি রবিবার সকাল থেকে খিচুড়ি পাকের জোগাড়ে আত্মনিয়োগ করা হলো। রেণু কিছু ডিম ও পাঠাইয়াছে।’ (কারাগারের রোজনামচা:২৩৫)।
বই দুটি লেখার প্রেক্ষাপট
বঙ্গবন্ধুর ‘রেণু’ একজন রাজনৈতিক প্রজ্ঞাসম্পন্ন দূরদর্শী নারী ছিলেন বলেই তাঁর স্মৃতিকথা লেখার জন্য খাতা তুলে দিতেন। নইলে কালের গর্ভে হারিয়ে যেত কত অজানা ইতিহাস। এই স্মৃতিকথাটি তারই উদাহরণ, ‘আমার সহধর্মিনী একদিন জেলগেটে বসে বলল, ‘বসেই তো আছো, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী (অসমাপ্ত আত্মজীবনী:২)। কারাগারের রোজনামচা’র উপক্রমনিকায় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা লিখেন, ‘আমার মা আমাকে বললেন,‘একবার যেতে পারলে আর কিছু না হোক তোর আব্বার লেখা খাতাগুলো যেভাবে পারিস নিয়ে আসিস।’ খাতাগুলো মার ঘরে কোথায় রাখা আছে তাও বলে দিলেন। আব্বার লেখা এই খাতার উদ্ধার আমার মায়ের প্রেরণা ও অনুরোধের ফসল। আমার আব্বা যতবার জেলে যেতেন মা খাতা, কলম দিতেন লেখার জন্য। বার বার তাগাদা দিতেন। আমার আব্বা যখন জেল থেকে মুক্তি পেতেন মা সোজা জেল গেটে যেতেন, আব্বাকে আনতে আর আব্বার লেখাগুলো যেন আসে তা নিশ্চিত করতেন। সেগুলি অতি যত সংরক্ষণ করতেন’ (কারাগারের রোজনামচা: ৮-৯)। বঙ্গমাতার জন্যই আজ এ দুটি বই থেকে খুঁজে পাই বাংলাদেশ সৃষ্টির নানা ইতিহাস। নইলে ঢাকা পড়ে যেত কত শত কথা অজানা কাহিনী।

মহিয়সী এই নারী ২২ শে শ্রাবণ, ১৫ আগষ্ট ১৯৭৫ সালে ঘাতকের গুলিতে প্রাণ হারান। বনানী গোরস্থানে তিনি নীরবে শায়িত হয়ে আছেন। কবি মু.জালাল উদ্দিন নলুয়া বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ৯১তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ‘বঙ্গমাতা’ স্মরণে তাঁর কবিতা দিয়ে লেখাটি শেষ করব।

‘পুতুল খেলার বয়সে হলে তুমি ঘরনী
তোমাকে ধন্য ধন্য করে আজ এই ধরনী। শান্তির ঘরে কারাগার দেখেছো বারবার
দিশারী অগ্নিতেজে দুর্বার রাহবার। অমানিশার কালিমা নাশি সত্যের খোঁজে
শোষকের পতন চাহি মুক্ত ভাষা বুঝে। সংগ্রামী মহা সারথীর দুর্জয়ে অগ্নিশপথে
সাহস যোগাও সতত ছোট আলোর রথে। কত ঈদ, কত পার্বন কতোনা শুভদিন
মুক্তি কামনায় সারথী কারাগারে অন্তরীণ। ঘরের চেয়ে মাতৃভূমি প্রিয়, অনেক বড়ো
বঞ্চিত জনতার কান্না হৃদয়ে আছে জড়ো। শিকল ভাঙ্গার গানে দিশারী অহরহ জাগে
ফুল ফোটায় ঘরনী তাঁর সংসার বাগে। ডানা মেলে মুক্ত বলাকা
রক্তে ভিজে পতাকা
অম্লান তুমি বঙ্গমাতা
আছো হৃদয়ে আঁকা। ’
ড. জেবউননেছা : অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ক পরিষদ