রবীন্দ্রনাথ: মৃত্যুঞ্জয়ী কালপুরুষ

০১.
‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই/এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে,/ জীবন্ত হৃদয় মাঝে যদি স্থান পাই।’— পুষ্প-পল্লব শোভিত রৌদ্র ঝলমল পৃথিবীর মানুষের মাঝে বেঁচে থাকার এই আকুতিই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে মৃত্যুঞ্জয়ী করেছে। সুন্দর-শ্যামল ধরার বুকে তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে আছেন তাঁর সৃষ্টিরাজির ভেতর দিয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেবল একজন কবি কিংবা সাহিত্যিকই নন, তিনি ছিলেন চিন্তাশীল এবং মানবপ্রেমিক যুগন্ধর পুরুষ। তাঁর আবির্ভাবের কাল ছিল ভারতবর্ষের ক্রান্তিকাল। সমাজব্যবস্থা ছিল নানাবিধ অনাচার-অবিচার এবং কুসংস্কারে আচ্ছন্ন, দেশবাসীর জীবন ছিল পরাধীনতার জটাজালে বন্দি আর বিশ্বাবাসীর জীবন ছিল সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হিংস্র থাবায় পর্যুদস্ত। বিপদসঙ্কুল মানব জাতির মর্মবেদনা তাঁর চিত্ত-মননকে গভীরভাবে আলোড়িত করেছিল। ফলে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক ও প্রবন্ধের মাধ্যমে মানুষের চিরন্তন অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ যেমন তিনি ঘটিয়েছেন, তেমনি সেগুলোর মাধ্যমে হতাশাদীর্ণ মানুষকে শুনিয়েছেন আশার বাণী, বিপর্যস্ত মানুষকে যুগিয়েছেন সামনে চলার প্রেরণা ও শক্তি। সমকালের মতো বর্তমান কালের সঙ্কটপূর্ণ জীবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিন্তাচেতনা মানুষকে সম্বুদ্ধ করে জটিল ও সমস্যাপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে। তাঁর মৃত্যুর দীর্ঘদিন অতিক্রান্ত, তিনি বর্তমানে প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত না থাকলেও তাঁর বিচিত্রমুখী প্রতিভার অফুরন্ত সৃষ্টিপ্রাচুর্যের দান হতাশাগ্রস্ত জাতিকে দেখায় আলোর পথ। ‘আমাদের সত্তায়, আমাদের চেতনায়, আমাদের মুহুর্মুহু প্রার্থনার বোধিত অস্পষ্টতায়, নিঃশ্বাসের প্রগাঢ় চুম্বনে সংশয় উন্মোচিত চিত্তের দুয়ারে তিনি নিত্য অনির্বাণ। (জুলফিকার : ১৯৯৬, ১৯)
০২.
মৃত্যুঞ্জয়ী রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে পর্যালোচনা করতে গেলে কতকগুলো বিষয়ের উপর দৃষ্টিপাত করতে হয়। সে ক্ষেত্রে প্রথমেই আসে বিশ্বকবি হিসেবে তাঁর জীবনবোধ অর্থাৎ জীবনকে তিনি কত গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন, যা তাঁকে মৃত্যুঞ্জয়ী মহিমা দান করতে পারে এবং তাঁর সে উপলব্ধির মধ্যে শাশ্বত মানব অভিব্যক্তি কতটুকু প্রতিফলিত হয়েছে। তারপরে আসে তাঁর কাল এবং সেই কালের আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা ও প্রবণতাসমূহ এবং সেগুলোর সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততার দিক। এছাড়া আসে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা-চেতনার অন্বিষ্ট এবং সেগুলোর সঙ্গে বর্তমান ও ভাবী কালের সমস্যা-সঙ্কটের সাযুজ্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন উপনিষদীয় দর্শনে পরিস্নাত সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের সাধনায় সিদ্ধ এক নিষ্ঠাবান সাধক। সমগ্র ভারতীয় চিত্তকে তিনি হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন। নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন : ‘যে আত্মমগ্ন ধ্যানদৃষ্টি, যে পরম জ্ঞান ও প্রতিভা, যে দিব্য বৈরাগ্য এবং সর্বোপরি যে বিরাট ব্যক্তিত্ব আমাদের ভারতীয় ঋষিত্বের আদর্শকে মহীয়ান করিয়াছে, তাহার প্রত্যেকটিই রবীন্দ্রনাথের মধ্যে অল্পবিস্তর সঞ্চারিত হইয়াছে।’ (নীহাররঞ্জন : ১৩৬৯, ১)

০৩.
সত্য ও সুন্দরের সাধনা এবং কল্যাণের প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁর জীবনের মূল ব্রত। তাঁর সমস্ত সাহিত্যের মধ্যে এই চেতনার পরিস্ফুটন পরিদৃষ্ট হয়। রবীন্দ্রনাথ ‘প্রধানত কবি’— সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন ও ধর্মীয় জীবনবোধের দীপ্তি রবীন্দ্র-প্রতিভায় প্রজ্জ্বলিত হলেও কবি হিসেবেই তিনি বিশ্বজোড়া খ্যাতি পেয়েছেন। ইংরেজি সমালোচনা সাহিত্যে কবিকে বলা হয় ‘ঝববৎ;’ আর প্রাচ্য পুরাণে কবি শব্দের অর্থ ‘সত্যদ্রষ্টা’। ভবিষ্যতের সম্ভাবনা কবির অন্তর্দৃষ্টিতে বিধৃত হয়, তাঁর চিত্ত-মুকুরে আছড়ে পড়ে শাশ্বত মানবের জীবন-সংবেদ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় আমরা লক্ষ করি শাশ্বত মানবের জীবন অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ। ‘প্রাণশক্তির এত প্রাচুর্য, আবেগের এত গভীরতা, রোমান্টিক মানসের এভাবে কল্পস্বর্গপরিক্রমা—বিশ্বের সঙ্গে বিশ্বাতিতের, সীমার সঙ্গে অসীমের, খন্ডের সঙ্গে পূর্ণের এই মিলনলীলা কোন যুগের কোন একজন কবির মধ্যে পাওয়া যায় না। (অসিতকুমার : ২০০৫, ৪৬৯) তাঁর কবিভাবনা এবং সৌন্দর্যবোধ সেকালের গন্ডি অতিক্রম করে সর্বকালের মানুষের মনে আবেদন সৃষ্টি করে। অশোক সেন জানাচ্ছেন : “তাঁহার প্রতিভার প্রতি স্বীকৃতি দেওয়া হইয়াছে পৃথিবীর সর্বদেশে, তাঁহার সাহিত্য সর্বকালের এবং তাহার প্রধান পরিচয় বলিতে এই বুঝি যে তিনি ‘বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ।” তিনি উচ্চারণ করেছিলেন :
মানবের সুখে-দুঃখে গাঁথিয়া সঙ্গীত
যদি গো রচিতে পারি অমর আলয়।
মানবপ্রেমই রবীন্দ্রনাথের চিন্তা ও সৃষ্টিকে পরিবর্তিত, পরিবর্ধিত ও পরিশোধিত করেছে বারংবার। বিশ্বজগতাশ্রয়ী চলমান মানবপ্রেমই তাঁর সর্বাস্তিবাদী ধর্মবিশ্বাসের মূল উৎস (আকরম : ১৩৮৮, ৩৭) মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না ও প্রেম-বিরহের সঙ্গে একাত্ম হয়েছেন তিনি। পৃথিবীর আলো-বাতাস-রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ অসাধারণ কাব্যিক ব্যঞ্জনায় উপস্থাপিত হয়েছে তাঁর সাহিত্যে। জগতের প্রতিটি বিষয় ও বস্তুকে অসম্ভব সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে সেগুলোকে মোহনীয় কাব্য সুষমায় সুষমিত করে তুলেছেন তিনি। পারিপার্শ্বিক জগতের কোন কিছুই তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে যায় নি। প্রাত্যহিক সংসারের অতি সাধারণ বিষয় রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে অসাধারণভাবে ধরা দিয়েছে :
যাহা কিছু হেরি চোখে কিছু তুচ্ছ নয়.
সকলি দুর্লভ বলে আজি মনে হয়।
দুর্লভ এ ধরণীর লেশতম স্থান,
দুর্লভ এ ধরণীর ব্যর্থতম প্রাণ।
জগতের আলো-বাতাস, প্রকৃতি-মানুষ, সমাজ-সংসার সবকিছুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রাণের সম্পর্ক বিদ্যমান। জগৎকে ভালবাসেন বলে জীবনের প্রতি তাঁর হৃদয়ের এত টান। ‘বলাকা’ কাব্যের একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন :
ভালবাসিয়াছি এই জগতের আলো
জীবনেরে তাই বাসি ভাল।

০৪.
জীবনের প্রতি গভীর ভালবাসার কারণে মানুষকে তিনি অকৃত্রিম ভালবাসার বন্ধনে জড়িয়েছেন। শত পৈশাচিকতা দেখে তিনি শেষ পর্যন্তও মানুষের প্রতি বিশ্বাস অটুট রেখেছেন। তাঁর সুগভীর আস্থা জন্মেছিল যে: ‘মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ’। তাই মানুষের উপর বিশ্বাস ও আস্থা রেখে উচ্চারণ করেছেন : ‘জয় হোক মানুষের/ওই নবজাতকের, ওই চিরজীবিতের।’
স্বীয় উপলব্ধিকে তিনি সর্বত্র প্রকাশ করেছেন। সমালোচক বলেছেন : ‘কাব্যে সংগীতে-গল্পে-নাট্যে উপন্যাসে তিনি যেমন করিয়া আপনার অভিজ্ঞতার আবেগকে প্রকাশ করিয়াছেন, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কর্মপ্রচেষ্টায়, শিক্ষাদান ও প্রচারে, তত্ত্বজিজ্ঞাসা ও ব্যাখ্যায়, অধ্যাত্মবোধ এবং তাহার প্রকাশেও তিনি তেমন করিয়াই নিজেকে ব্যক্ত করিয়াছেন (নীহাররঞ্জন : ১৩৬৯, ১) তিনি সমকালীন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংঘাতপূর্ণ পরিবেশে বিপর্যস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। কেবল বক্তৃতা বিবৃতি আর সাহিত্য সাধনা দ্বারা নয়, তিনি প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন নানা আন্দোলন-সংগ্রামে। কোন রাজনৈতিক দলের প্রতি অন্ধ আনুগত্য না থাকলেও তিনি ভারতবর্ষের পরাধীনতা এবং ইংরেজ শাসনের নির্মমতা দেখে ব্যথিত হয়েছিলেন। স্বাধীনতার আশায় আশান্বিত হয়ে লিখেছিলেন : ‘ভাগ্যচক্রের পরিবর্তনের দ্বারা একদিন না একদিন ইংরেজকে এই ভারতবর্ষ ত্যাগ করে যেতে হবে।’ তিনি ফ্যাসিবাদী শক্তির নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে তিনি ‘নাইট’ উপাধি প্রত্যাখান করেছিলেন। সবসময় তিনি মানুষের মনুষ্যত্বের বিকাশ কামনা করেছেন। প্রকৃত মনুষ্যত্ব দ্বারাই যে জাতির প্রকৃত মুক্তি আসতে পারে সে সম্পর্কে ‘কালান্তর’ গ্রন্থে লিখেছেন : ‘সমস্ত জাতিকে মুক্তির পথে যে আমন্ত্রণ সে তো কোন বাহ্য প্রক্রিয়ার অন্ধ পুনরাবৃত্তির আমন্ত্রণ হতে পারে না। তার জন্য আবশ্যক পূর্ণ মনুষ্যত্বের।’ এ উক্তি যথার্থ। কেননা, মনুষ্যত্ব আর সামাজিক-নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ ছাড়া প্রকৃতপক্ষে কোন জাতি ও মানবের কল্যাণ সম্ভব নয়।

জাতীয় জীবনের নানা সঙ্কট রবীন্দ্রনাথকে ভাবিয়ে তুলেছিল। একারণে তিনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন নি। তৎকালীন ভারতের জাতীয় জীবনের অন্যতম প্রধান সমস্যা হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব তাঁকে মর্মযাতনা দিয়েছে। এ সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি বিভিন্নভাবে চিন্তা করেছেন। জীবনে ধর্মের প্রয়োজনকে তিনি কখনোই অস্বীকার করেন নি। সেজন্য লিখেছেন : ‘ধর্ম আমাদের পক্ষে সর্বশ্রেষ্ঠ আবশ্যক সন্দেহ নাই; কিন্তু সেই জন্যই তাহাকে নিজের উপযোগী করিয়া লইতে গেলেই তাহার সেই শ্রেষ্ঠ আবশ্যকতাই নষ্ট হইয়া যায়। কিন্তু এমনই আমাদের দুর্ভাগ্য যে, সেই ধর্মকেই মানুষ সংসারের সর্বাপেক্ষা জটিলতার দ্বারা আকীর্ণ করিয়া তুলিয়াছে।’ তৎকালীন সমাজে ধর্মান্ধতার প্রকট রূপ দেখে তিনি বলেছিলেন : ‘ধর্ম কারার প্রাচীরে বজ্র হানো/এ অভাগা দেশে জ্ঞানের আলোক আনো।’ ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানের জন্য রবীন্দ্রনাথ সবাইকে জ্ঞানচর্চা ও সত্য সাধনা দ্বারা সঙ্কীর্ণ মানসিকতার পরিবর্তন করতে বলেছিলেন। ইউরোপের মানুষের মতো সত্য ও জ্ঞান সাধনার দ্বারা সঙ্কীর্ণ চিন্তাচেতনাকে মন থেকে মুছে ফেলতে পারলেই সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান হবে বলে রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন : ‘এ সমস্যার সমাধান হবে মনের পরিবর্তনে যুগের পরিবর্তনে। ইউরোপ সত্য সাধনা ও জ্ঞানের ব্যাপ্তির ভিতর দিয়ে যেমন করে মধ্যযুুগের ভিতর দিয়ে আধুনিক যুগে এসে পৌঁছেছে। হিন্দুকে মুসলমানকেও তেমনি গন্ডির বাইরে যাত্রা করতে হবে।’
কেবল জাতীয় জীবন নয়, আন্তর্জাতিক তথা বৈশ্বিক পরিমন্ডলের নানান সঙ্কট সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ অবহিত ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তান্ডবলীলা এবং ফ্যাসিবাদী শক্তির পৈশাচিকতা দেখে তিনি বেদনা-ভারাক্রান্ত হয়েছিলেন। যুদ্ধের বিভীষিকা আর শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর নিষ্ঠুরতা দেখে তিনি ইউরোপের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন। জীবনের পলে পলে অশান্তির ঘূর্ণি দেখে লিখেছিলেন :

দুঃখেরে দেখেছি নিত্য, পাপেরে দেখেছি নানা ছলে,
অশান্তির ঘূর্ণি দেখি জীবনের স্রোতে পলে পলে,
মৃত্যু করে লুকোচুরি
সমস্ত পৃথিবী জুড়ি
ভেসে যায় তারা সরে যায়
জীবনেরে করে যায় ক্ষণিক বিদ্রƒপ।
যুদ্ধকালীন এবং যুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপীয় বর্বরতার প্রতি অভিসম্পাত করে তিনি লিখেছেন : ‘যুদ্ধ পরবর্তীকালীন য়ূরোপের বর্বর নির্দয়তা যখন আজ এমন নির্লজ্জভাবে চারদিকে উদঘাটিত হতে থাকল তখন এই কথাই বারবার মনে আসে কোথায় রইল মানুষের সেই দরবার যেখানে মানুষের শেষ আপিল পৌঁছবে আজ।…দুর্গতি যতই উদ্ধতভাবে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠুক, তবুও তাকে মাথা তুলে বিচার করতে পারি, ঘোষণা করতে পারি, তুমি অশ্রদ্ধেয়, অভিসম্পাত দিয়ে বলতে পারি বিনিপাত।’

জাতির কল্যাণ সাধনে রবীন্দ্রনাথ বহুমাত্রিক চিন্তার অভিনিবেশ ঘটিয়েছেন। তিনি অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন যে, শিক্ষা ছাড়া জাতির ভাগ্যোন্নয়ন সম্ভব নয়। শিক্ষার ব্যাপারে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন চিন্তা তাঁকে মৃত্যুঞ্জয়ী করেছে। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে স্বাধীন পাঠের উপর তিনি গুরুত্বারোপ করেছেন। বাঙালির শিক্ষা ব্যবস্থার বড় ত্রুটি হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন আনন্দহীন শিক্ষাকে। তিনি বলেছেন : ‘বাল্যকাল হইতে আমাদের শিক্ষার সহিত আনন্দ নাই।’ এই আনন্দহীন শিক্ষা বাস্তব জীবনে কোন উপকারে আসে না। ত্রটিপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থার অসারতা দূর করার জন্য তিনি লিখেছেন : ‘আমাদের এই শিক্ষার সহিত জীবনের সামঞ্জস্য সাধনই এখনকার দিনের সর্বপ্রধান মনোযোগের বিষয় হইয়া দাঁড়াইয়াছে।’ তিনি মাতৃভাষাকে শিক্ষার বাহন করে তোলার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। কারণ মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধস্বরূপ। বিদেশি ভাষায় শিক্ষাগ্রহণ করলে জ্ঞানের স্বাভাবিক বিকাশ ঘটে না। তাছাড়া দেশের উন্নতির ক্ষেত্রেও বিশেষ অবদান রাখা যায় না। জাপানের মানুষ মাতৃভাষায় মাধ্যমে শিক্ষালাভ ও জ্ঞান সাধনা করে উন্নতির চরম শিখরে উঠতে পেরেছে। তবে তিনি অন্য ভাষাকে উপেক্ষা করতে বলেন নি। তিনি বাঙালি সন্তানদের ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে বলেছেন : ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বাংলা ভাষার ধারা যদি গঙ্গা-যমুনার মতো মিলিয়ে যায় তবে বাঙালি শিক্ষার্থীর পক্ষে এটা একটা তীর্থস্থান হইবে।’ রবীন্দ্রনাথের এই শিক্ষাচিন্তা একালের বাঙালির জন্যও অপরিহার্য।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বিশ্বমানবের কল্যাণব্রতী এক মনীষী। তাঁর সাহিত্য ‘সর্বাপেক্ষা সার্বজনীন ও প্রাদেশিকতাদোষবর্জিত।’ জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, সম্প্রদায় ও দেশ-কালের সকল সঙ্কীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে তিনি মানব মহিমার জয়গান করেছেন। সমাজ অভ্যন্তরের নানা শ্রেণীর মানুষের কল্যাণের জন্য চিন্তা-ভাবনা করেছেন। সেজন্য সমাজের অর্ধাংশের উপেক্ষার দ্বারা যে কিছুতেই জাতি বা রাষ্ট্রের মঙ্গল হতে পারে না, তা সর্বদাই বলেছেন। যুগ যুগ ধরে অবহেলিত ও উপেক্ষিত নারী সমাজের কল্যাণ মনে-প্রাণে চেয়েছেন। সাহিত্যের পরতে পরতে তিনি নারীর আত্মজাগরণের বাণী শুনিয়েছেন। তাঁর ‘চিত্রাঙ্গদা’ কাব্যনাটক, ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্প এবং ‘সরলা’ ও ‘সাধারণ মেয়ে’ কবিতায় সর্বকালের অবহেলিত নারী আত্মজাগরণের পথ খুঁজে পায়।

সাম্প্রতিক কালের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যা-সঙ্কট মোকাবেলায় রবীন্দ্রচিন্তা ও সাহিত্য নানাভাবে প্রেরণা দিতে পারে। ব্যক্তিমানুষের নানা দুর্ভোগ, সামাজিক-নৈতিক এবং মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে তাঁর চিন্তা বিশেষভাবে সহায়ক হতে পারে। সাম্প্রতিক বিশ্বের বিভিন্ন সঙ্কট, জাতিতে জাতিতে হানাহানি, পুঁজিবাদী শক্তির উৎকট শোষণ, শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত অশুভ তৎপরতায় রবীন্দ্রনাথের কল্যাণমুখী ও শান্তিকামী চিন্তা করতে পারে সঞ্জীবনী সুধার কাজ।
রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে আছেন তাঁর সমকাল এবং পরবর্তীকালের কবি-সাহিত্যিকদের উপর প্রভাব বিস্তার করে। কবিতা, গল্প, নাটক, প্রবন্ধ, উপন্যাস, সাহিত্য সমালোচনা—এক কথায় সাহিত্যের প্রায় সকল শাখাতেই তাঁর প্রভাব বিদ্যমান। শুধু তাই নয়, তিনি বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর শক্তি ও খ্যাতি দান করেছেন, সাহিত্যকে আধুনিকতার শিখরে উঠার শক্তিও তিনিই দান করেছেন। ড. সুকুমার সেন মন্তব্য করেছেন : ‘ভরসা করি এখন একথা কেহই অস্বীকার করিবেন না যে বাঙ্গালায় আধুনিক সাহিত্যের বীজ রবীন্দ্রনাথের দ্বারাই উপ্ত হইয়াছিল’। (সুকুমার : ১৯৯৯, ১) তিনি এও বলেছেন : ‘রবীন্দ্রনাথের মতো কোন একটি সর্বশক্তিমান কবি, লেখক ও শিল্পী অন্য কোন ভাষায় আবির্ভূত হয় নাই।’

রেনেসর্ঁাসের ভাবধারা তাঁর মধ্যে প্রবাহিত ছিল। তিনি একদিকে যেমন ঐতিহ্যকে স্বীকার করেছেন অন্যদিকে তেমনি আধুনিকতাকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। বিষ্ণু দে বলেছেন : ‘বস্তুত রবীন্দ্রনাথই আমাদের দেশে শিল্পসাহিত্যে তো বটেই, দেশের সমস্ত সংস্কৃতি, মানসজীবন ও কর্মের আধুনিকতার আদি ও মৌলিক দৃষ্টান্ত।’ (বিষ্ণু : ১৯৭৫, ৩) এ কথা বললে বোধ করি একটুও অত্যুক্তি হয় না যে, আধুনিক মনীষী রবীন্দ্রনাথ সকল যুগের লেখকদের প্রেরণা দিয়ে এবং তাঁদের উপর প্রভাব বিস্তার করে চিরঞ্জীব হয়ে আছেন। সমালোচক জানাচ্ছেন : ‘রবীন্দ্রনাথ সমকালীন লেখকদের প্রভাবিত করেছেন। পরবর্তী লেখকদের উপরেও তাঁর প্রভাবের পরিমাণ সুগভীর। সাম্প্রতিক যে লেখকগোষ্ঠী রবীন্দ্র-পরিমন্ডল থেকে স্বতন্ত্র পথ ধরেছেন, কিন্তু তাঁরাও নানাদিক থেকে রবীন্দ্রনাথের দ্বারা ভেতরে ভেতরে প্রভাবিত না হয়ে পারেন নি।’ (ক্ষেত্রগুপ্ত : ২০০০, ৩৮০)
আমাদের শিল্পচেতনা, পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাাতিক জীবনের সর্বত্র মৃত্যুঞ্জয়ী রবীন্দ্রনাথের আবেদন সুদূরপ্রসারী। ‘পরমসূক্ষ্ম সামঞ্জস্যচেতনা, চলমানতাবোধ, সর্বাস্তিবাদী ধর্মবিশ্বাস, বিশ্বজাগতিকতা, সমগ্রতাবোধ ও মানবপ্রেম রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিক্ষমপ্রজ্ঞার মৌল উৎস (আকরম : ১৩৮৮, ৩৫৯) তিনি ছিলেন ‘এক বিশাল কর্মযজ্ঞের নায়ক। (মযহারুল : ১৯৮৬, ভূমিকা) ‘কীর্তিমানের মৃত্যু নেই’ কথাটি তাঁর ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য। তাঁর মহৎ প্রতিভার অফুরন্ত সৃষ্টিপ্রাচুর্যের দান কোন ব্যক্তি বিশেষের সম্পত্তি নয়, তা সকল কালের সকল মানুষের সম্পদ। তাঁর জীবনবোধ এবং দূরদর্শী চিন্তা সব যুগের জন্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। তিনি বাঙালির হৃদয়ে চিরঞ্জীব হয়ে আছেন। তিনি বলেছিলেন – ‘আমি তোমাদেরই লোক’। সকল প্রকার সুখে-দুঃখে-সন্তাপে মৃত্যুঞ্জয়ী কালপুরুষ রবীন্দ্রনাথ আমাদেরই লোক হয়ে থাকবেন।
গ্রন্থপঞ্জি
- জুলফিকার মতিন, “তিনি আমাদেরই লোক”, ‘কবিতার দেশ’, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৬
- নীহাররঞ্জন রায়, রবীন্দ্র সাহিত্যের ভূমিকা, নিউ এজ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, পঞ্চম সংস্করণ, কলকাতা, ১৩৬৯
- অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত, মডার্ন বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, নতুন সংস্করণ, কলকাতা, ২০০৫
- সৈয়দ আকরম হোসেন, রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস:চেতনালোক ও শিল্পলোক,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৩৮৮
- সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, পঞ্চম খন্ড, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, প্রথম আনন্দ সংস্করণ, কলকাতা, ১৯৯৯
- বিষ্ণু দে, রবীন্দ্রনাথ ও শিল্পসাহিত্যে আধুনিকতার সমস্যা, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, ঢাকা, ১১৯৭৫
- ক্ষেত্রগুপ্ত,বাংলা সাহিত্যের সমগ্র ইতিহাস,জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন,ঢাকা,২০০০
- মযহারুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ : কবি কথাশিল্পী এবং কর্মযোগী, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৮
ড. এম আব্দুল আলীম : সাবেক ডিন, কলা অনুষদ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি।