‘বাংলা দেশ’ গানটি যেভাবে সৃষ্টি হয়েছিল

বিদেশের মাটিতে যে কনসার্ট বিশ্বকে মাতিয়েছিল। মানুষের মুখে মুখে যে শব্দটি উচ্চারিত হয়েছিল তা হলে-‘বাংলা দেশে, বাংলা দেশ, বাংলা দেশ’। মুক্তিকামী মানুষের পাশে দাঁড়ানো, সহযোগিতার হাতটুকু বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য অনবদ্য সেই কনসার্টের আজ সু্বর্ণজয়ন্তী। ১৯৭১ সাল, ১ আগস্ট, রোববার। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের মেডিসন স্কয়ার গার্ডেনে অনুষ্ঠানটি হয় দুনিয়া কাঁপানো প্রথম চ্যারিটি কনসার্ট। মুক্তিকামী মানুষের আর্তনাদ, হত্যার পর হত্যা, অসহ্য নির্যাতনের পর নির্যাতন, ভেসে যাওয়া মানুষের রক্তের স্রোত। সেই সব আর্তনাদের কথা শুনে চুপ থাকতে পারেননি কিংবদন্তি সেতারবাদক রবিশঙ্কর ও সাড়া জাগানো ব্যান্ড দল দ্য বিটলসের অন্যতম সদস্য জর্জ হ্যারিসন।
তরুণপ্রজন্ম কতটুকু জানে, তা আমার সঠিক জানা নেই। তবে, এতটুকু আঁচ করতে পারি, ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ নামটা হয়ত শুনেছে। কিন্তু অধিকাংশই জানে না এর নেপথ্যের কাহিনি। কয়েকটি পর্বে ভাগ করলে হয়ত পুরো বিষয়টি জানো সম্ভব হতে পারে, আবার অপূর্ণ থাকতে পারে। চোখ গেল ক্যালেন্ডার দিকে। ১৯৭১ সাল, ভয়াবহ সময়। মানুষের জীবন বিপন্ন । কোথায় যাবে? কেউ বুঝতে ওঠেতে পারছিল না। ঠিক পঞ্চাশ বছরে, ২০২১ সালের ১ আগস্ট, রোববার। মানুষ ছুটছে ক্ষুধার যন্ত্রণায় গ্রাম থেকে শহরে। ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছে ট্রাকে কিংবা লঞ্চে। ভয় নেই করোনার, ভয় নেই মৃত্যুর। মানুষ ছুটছে নির্ভীক এক পথিকের মত। যাক, ফিরে আসি- কনসার্ট ফর বাংলাদেশে। জেনে নেই কিভাবে সৃষ্টি হয়েছিল অমর ‘বাংলা দেশ’ গানখানি।

বন্ধু রবিশঙ্করের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান দ্য বিটলসের জর্জ হ্যারিসন। শুরু হয়ে যায় আয়োজনে নানা প্রস্তুতি। পোস্টার, টিকিট, গানদলের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ, মঞ্চ ইত্যাদি। গানটি রিলিজ হয় জুলাই মাসের ২৮ তারিখে। জর্জ হ্যারিসন গা্নটি রচনা, সুর ও কণ্ঠ দেন।
গানটি শুরু হয় ‘আমার বন্ধু এসেছিল,/ তার চোখ দুটি ছিল বিষণ্নতার প্রতিমূর্তি,/ তার কথাগুলো কেবল মিশেছিল/মৃতপ্রায় তার দেশকে বাঁচানোর আর্তি।’..
এখানে বন্ধু বলতে হ্যারিসন বুঝিয়েছেন সেতারবাদক রবিশঙ্করকে।পুরো গানটিতে তিনি কী অসাধারণ ভাবে বাংলাদেশকে তুলে ধরেছেন। এত আবেগ,এত ভালোবেসে। হয়তো এরজন্য বিশ্বের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো হয়ে ওঠা প্রথম চ্যারিটি সংগীত। যাকে বলা হয়,‘সংগীতের ইতিহাসের অন্যতম নিবিড় সামাজিক বক্তব্য’।

জর্জ হ্যারিসনের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ আই মি মাইন-এ লিখেছেন, ‘গীতিকার হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে নয়, মূলত গান লিখেছি মন থেকে কিছু প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে। আমি মনে করি, কিছু লেখক আছেন, যাঁদের কাছে তাঁদের অনুভূতি কিংবা অভিজ্ঞতার বর্ণনাটা যথেষ্ট নয়। তাঁদের কাছে এটা একটা শৈল্পিক কর্ম। যেসব ভারতীয় সংগীত এখন আমরা শুনছি, তা সরাসরি সংগীতজ্ঞের আবেগকে বহন করে। সেজন্য গীত রচনা আমার কাছে ওই মূহুর্তের, ওই সময়ের সেই আবেগকে ছাপিয়ে ওঠার একটা মাধ্যম।’
জর্জ হ্যারিসনের লেখা, সুর ও কণ্ঠ দেওয়া ‘বাংলা দেশ’ গানটি ২৮ জুলাই ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেসের ‘দ্য রেকর্ড প্ল্যান্ট’ বিখ্যাত স্টুডিওতে রের্কড করা হয়। অনুষ্ঠান শুরুর তিন দিন আগে থেকে এটা প্রচারিত হতে লাগে। ১ আগস্ট, দুপুর আড়াই শুরু হওয়া এই কনসার্টের শেষ গানটি যখন ৪০ হাজার ( দুপুর আড়াইটা ও রাত ৮টা দুই মিলে) মানুষের মাঝে বেজে ওঠল, তখনেই সৃষ্টি হলে এক অনবদ্য ইতিহাস। যা বাংলাদেশকে চিনল পুরো বিশ্ব। জনমত গঠন অসামান্য ভূমিকা রাখলেন। রবিশঙ্কর বলেন, It was such a unique thing. Everybody was so moved and touched. It had a special feeling apart from just a performance. Overnight everybody knew the name of bangaladesh all over the world.

২০০৫ সালে জাতিসংঘের কফি আনান বলেন,‘গানটির মধ্যে যে হৃদয়গ্রামী বক্তব্য ওঠে এসেছে, তা বাংলাদেশের সংকট সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে মানুষকে সম্পর্শ করেছে।’
জর্জ হ্যারিসনের ‘বাংলা দেশ’ গানটি নিচে তুলে ধরা হলো-
My friend came to me
With sadness in his eyes
He told me that he wanted help
Before his country dies
Although I couldn’t feel the pain
I knew I had to try
Now I’m asking all of you
To help us save some lives
Bangladesh, Bangladesh
Where so many people are dying fast
And it sure looks like a mess
I’ve never seen such distress
Now won’t you lend your hand and understand?
Relieve the people of Bangladesh
Bangladesh, Bangladesh
Such a great disaster, I don’t understand
But it sure looks like a mess
I’ve never known such distress
Now please don’t turn away
I want to hear you say
Relieve the people of Bangladesh
Relieve Bangladesh
Bangladesh, Bangladesh
Now it may seem so far from where we all are
It’s something we can’t neglect
It’s something I can’t neglect
Now won’t you give some bread to get the starving fed?
We’ve got to relieve Bangladesh
Relieve the people of Bangladesh
We’ve got to relieve Bangladesh
Relieve the people of Bangladesh

বন্ধু আমার এল একদিন
চোখভরা তার ধু ধু হাহাকার
বলল কেবল সহায়তা চাই
বাঁচাতে হবে যে দেশটাকে তার
বেদনা যদি বা না-ও থাকে তবু
জানি আমি, কিছু করতেই হবে
সকলের কাছে মিনতি জানাই আজ আমি তাই
কয়েকটি প্রাণ এসো না বাঁচাই
বাংলা দেশ, বাংলা দেশ
দেখছি সেখানে সকলই ধ্বস্ত
কত শত প্রাণ মরে নিঃশেষ
দেখিনি এমন বেদনা অশেষ
তোমরা সবাই দুহাত বাড়াও আর বুঝে নাও
মানুষগুলোকে সহায়তা দাও
বাংলা দেশ, বাংলা দেশ
দেখিনি কখনো এত দুর্যোগ
দেখছি সেখানে সকলই ধ্বস্ত
দেখিনি কখনো এত দুর্ভোগ
দোহাই তোমরা ফিরিও না মুখ, বলো এই কথা
মানুষগুলোকে দেব সহায়তা
বাংলা দেশ, বাংলা দেশ
মনে হবে সে তো কোন সীমানায়, আমরা কোথায়
কী করে বা একে ছুড়ে দিই ফেলে
এত যে বেদনা রাখি দূরে ঠেলে
দেবে না তোমরা ক্ষুধিতকে রুটি সামান্য দুটি
মানুষগুলোকে সহায়তা দাও
(বাংলা দেশ গানটি অনুবাদ করেছেন কবি সাজ্জাদ শরিফ)
আবু সাঈদ : কবি, লেখক, সংগঠক ও সম্পাদক