গল্পকার, ঔপন্যাসিক ছাড়াও একজন অভিনয়শিল্পীও ছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়

‘কবি’ উপন্যাসটি পড়েননি এমন বাঙালি হয়তো পাওয়া যাবে না। এই উপন্যাসটিই তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাঙালি হৃদয়ে এক কিংবদন্তি ঔপন্যাসিক হিসেবে ঠাঁই পেয়েছেন। তিনি যে শুধু ঔপন্যাসিক ছিলেন এমনটা কিন্ত না! তাঁর বেশ কিছু গান আমরা গাই। বলা যেতে পারে ‘কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কান্দ কেনে’; ‘দেখে এলাম তারে স’খি দেখে এলাম তারে’ কিংবা ‘ভালোবেসে এই বুঝেছি,-সুখের সার সে চোখের জল রে।’ তাহলে আমরা বলতে পারি, তারাশঙ্কর একজন গীতিকারও ছিলেন।
৬৫টি উপন্যাস, ৫৩টি গল্পগ্রন্থ, বেশ কিছু গান লিখে ক্ষান্ত হননি তিনি। লিখেছেন ১২টি নাটক, ৪টি প্রবন্ধের বই, ৪টি আত্মজীবনী, ২টি ভ্রমণ কাহিনী, ১টি কাব্যগ্রন্থ এবং ১টি প্রহসন। এই সব আমাদের মোটামোটি সবারই জানা।
এতদিনে হয়তো অনেক জানেন, আবার অনেকই নাও জানাতে পারেন। তিনি শুধু যে লেখালেখি করেছে তা নয়, নাটকেও অভিনয় করেছেন। ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন ছিল নাট্যকার হওয়ার। সেই স্বপ্ন কিন্তু লালন পালনও করেছেন। বাঙালি ‘কবি’ পড়ে যে এতটাই মুগ্ধ হবে সেটা হয়ত বা তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় জানতেন না।
সাহিত্য ভুবনে শুরুটা কিন্তু নাটকে। নাটক লেখা মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়। তিনি ‘ইতিহাস ও সাহিত্য’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘…অভিনয় ভালো লাগে, নাটক রচনা করি। সে রচনা অবশ্য তখন solitary pride-এর সামিল আমার কাছে। মধ্যে মধ্যে জমজমাট নাট্যমঞ্চে অভিনয় করি। দেশপ্রেম, নাট্য রচনা ও অভিনয়-স্পৃহা এই তিনের সম্মিলিত ফল এক সময় দাঁড়াল একখানি পঞ্চাঙ্ক নাটক। নাম ‘মারাঠা তর্পণ’।’
‘মারাঠা তর্পণ’ নাটকটি লেখার পর তাঁর এক আত্মীয় ভারতের বীরভূমের বিশিষ্ট অভিনেতা-নাট্যকার নির্মলশিব বন্দ্যোপাধ্যায় কাছে দেন। তিনি সেটা পড়ে কলকাতার পেশাদার মঞ্চে অভিনয়ের জন্য পাঠান অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কাছে। এখানে ঘটে যায় আরেক ঘটনা। নাটকটি পেয়ে অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ভালো লাগেনি। তাই তিনি নাটকটি পাঠিয়েন দেন তার আত্মীয় কাছে। এটা জানাতে পেরে তারাশঙ্কর প্রচণ্ড আঘাত পেলেন। পাণ্ডুলিপি হাতে পেয়ে আগুনে পুড়ে ছাঁই করে দিলেন। এরপর সরে গেলে নাট্যকার হওয়ার স্বপ্ন থেকে। লিখতে শুরু করলেন গল্প। মনোযোগ দিলেন উপন্যাস লেখায়। যা পাঠক পড়ে মুগ্ধ হতে লাগে। তিনিও বাংলা সাহিত্যের আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে জ্বলতে থাকে। তারপরও কেন জানি অশান্তি বিরাজ করত। ছোটবেলার সে স্বপ্ন তাকে যেন তাড়া করে বেড়ায়।
একবার কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তারাশঙ্করের উপন্যাস রাইকমল পড়ে বিস্মৃত হলেন। কবি শিশির ভাদুড়িকে এই উপন্যাস থেকে নাটক করার সুপারিশ করেন। শিশির ভাদুড়িও ভালো নাটক খুঁজছে। কবিগুরু সুপারিশে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে অনুরোধ করলে শিশিরকুমার ভাদুড়ি। সেই অনুরোধ লিখেও ফেলেন তিনি। অপেক্ষা মঞ্চায়িত করা। এরমধ্যে শুরু হলে নানা টানাপড়া। শেষমেষ ‘রাইকমল’ মঞ্চস্থ হলো না। এরপর ‘রঙমহল’-এ তারাশঙ্করের ‘দুই পুরুষ’ নাটকটি গৃহীত হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে নাটকও মঞ্চে হলো না।
নাটকে যেন সব বাধা। একের পর এক বাধাপ্রাপ্ত হয়েও ভালোবাসা জিনিস কি সহজে ভুলা যায়। তাই তো তিনি কবিতে লিখেছেন- ‘এই খেদ মোর মনে/ ভালোবেসে মিটল না আশা কুলাল না এ জীবন।’
বাধা অতিক্রম করে ১৯৪১ সালের ১২ জুলাই তারাশঙ্করে লেখা ‘কালিন্দী’ নাটকটি অবশেষে নাট্যনিকেতন মঞ্চস্থ করেন। জেনে ভালো লাগবে, এই নাটকটিতে সংগীত ও সুর দেন আমাদের প্রাণের কবি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
বাধা অতিক্রম করে ১৯৪১ সালের ১২ জুলাই তারাশঙ্করে লেখা ‘কালিন্দী’ নাটকটি অবশেষে নাট্যনিকেতন মঞ্চস্থ করেন। জেনে ভালো লাগবে, এই নাটকটিতে সংগীত ও সুর দেন আমাদের প্রাণের কবি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
কিন্তু তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাহুর দশা যে যাচ্ছে না। ২৭ রজনীর পর নাটকটি প্রদর্শন না করার জন্য মামলা হয়। তারপর নাটকের প্রদর্শন বন্ধ হয়ে যায়।
জেদ ধরে গেলেন তারাশঙ্করের। নাটকের জগতে নিজের জায়গাটা পাকাপোক্ত করতেই হবে। পরের বছর, ১৯৪২ সালের ১৮ মে ‘নাট্যভারতী’ তারাশঙ্করের ‘দুই পুরুষ’ মঞ্চে নিয়ে আসে। নুটু ও রানির চরিত্রে অভিনয় করেন যথাক্রমে ছবি বিশ্বাস ও প্রভা দেবী। চল্লিশ থেকে ষাটের দশকের প্রায় শেষ পর্যন্ত ‘পথের ডাক’, ‘বিংশ শতাব্দী’, ‘দ্বীপান্তর’, ‘যুগ বিপ্লব’, ‘কবি’, ‘কালরাত্রি’, ‘সংঘাত’, ‘আরোগ্য নিকেতন’ ইত্যাদি নাটক অভিনীত হতে থাকে ‘নাট্যনিকেতন’, ‘রঙমহল’, ‘স্টার’, ‘বিশ্বরূপা’ ইত্যাদি বিখ্যাত নাট্যমঞ্চে।
মানুষ নাটক দেখে মুগ্ধ হয়। ছড়িয়ে পড়ে পুরো বাংলা জুড়ে। হাজার হাজার মানুষের মুখে তারাশঙ্করে নাটকের সংলাপ। প্রশংসার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্য সমালোচকদের কাছে সমালোচনাও কম হয়নি। ‘বিংশ শতাব্দী’ ও ‘পথের ডাক’ নাটক দু’টি ভিন্ন ছিল। তিনি বেশি ভাগ নাটক তাঁর গল্প ও উপন্যাস থেকে লেখাও ‘যুগবিপ্লব’ ও ‘দ্বীপান্তর’ নাটক দু’টি সরাসরি নাটক হিসেবেই লিখেছিলেন।
অজিতকুমার ঘোষ তারাশঙ্করের গ্রন্থের ভূমিকা লিখতে গিয়ে লেখেন, ‘নাটকের ক্ষেত্রে তাঁর পদচারণা যেন সতর্ক ও দ্বিধাজড়িত। এ যেন তাঁর ব্যস্ত কথাসাহিত্যিক জীবনের ফাঁকে ফাঁকে অবকাশ-বিলাস।’
তারাশঙ্করের নাটকের প্রতি ছিল আজীবন ভালোবাসা। ১২টি নাটকে লিখেছেন, নাটকের জন্য সংগ্রাম করেছেন, অনেক বাধাপ্রাপ্ত হয়েছেন, তবুও কিন্তু তিনি সেই বাসনা ছাড়েননি। অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। ঠিক একেভাবে অভিনয়ের করার ক্ষেত্রেও।
বীরভূমের লাভপুরের অতুলশিব মঞ্চে তিনি অনেক নাটকে অভিনয় করেন। ‘সীতা’ নাটকে সীতার চরিত্রে অভিনয় করে জন-সমাদৃত হয়েছিলেন। এ ছাড়াও ‘গৃহলক্ষ্মী’ নাটকে মেজবৌ, ‘প্রতাপাদিত্য’ নাটকে কল্যাণী, ‘চাঁদবিবি’ নাটকে মরিয়ম, ‘বঙ্গলক্ষ্মী’ নাটকে বিনোদিনীর চরিত্রেও তিনি দক্ষতার সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন।
তারাশঙ্করের সময় একজন অভিনেতাকে কখনো নারীর অভিনয়ে করতে হতো। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়কে নারী ও পুরুষ চরিত্রের অভিনয় করেন। তা ব্যাপক প্রশংসিত হয়। ‘কর্ণার্জুন’, ‘চিরকুমার সভা’, ‘বশীকরণ’, ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ ইত্যাদি নাটকে তিনি পুরুষ চরিত্রে অভিনয় করেন। এ ছাড়া ‘পার্থসারথি’, ‘পোষ্যপুত্র’, ‘প্রফুল্ল’, ‘মন্ত্রশক্তি’, ‘সরমা’ ইত্যাদি নাটকেও তিনি অভিনয় করেছিলেন।
তাঁর অধিকাংশ বীরভূমের লাভপুরের অতুলশিবের মঞ্চস্থ হলেও কলকাতায় এক বারই মঞ্চে ‘বশীকরণ’ নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল। ‘আমার সাহিত্যজীবন’ আত্মজীবনী বইয়ে তারাশঙ্কর লিখেছেন, ‘আজ বলি আমার সাহিত্যিক জীবনে এই রঙ্গমঞ্চের সাহায্য পরিমাণে সামান্য হলেও দুঃসময়ের পাওনা হিসাবে অসামান্য। সেদিন রঙ্গমঞ্চের এই সাহায্য না পেলে সাধনার অকৃত্রিম নিষ্ঠা সত্ত্বেও আমার জীবনে এ সাফল্য অর্জন সম্ভবপর হত না।’
গল্প, উপন্যাস চেয়ে নাটকের প্রতি ছিল তাঁর অপরিসীম ভালোবাসা। ছোটবেলা সেই ভালোবাসাকে খোঁজার, পাওয়ার আশায় ছিল ব্যাকুল। তাই তো তার আত্মজীবনীতে বলেন রঙ্গমঞ্চের সাহায্য না পেলে হয়ত জীবনের সার্থক হত না।
তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, ‘আমার সাহিত্যজীবন’ আত্মজীবনী লেখক তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়, আনন্দবাজার
আবু সাঈদ : কবি, লেখক, গবেষক ও সংগঠক