ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, বাঙলার জনসাধারণ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তৎকালীন বাঙলার মুসলিম প্রভাবশালী গোষ্ঠীদের সম্পর্কে ইতিহাসের আলোকে আমার ব্যক্তিগত মতামত

১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ১০০ বছর পূর্ণ হলো। এই শতবার্ষিকী উদযাপনের সন্ধিক্ষণে একটি বিতর্ক প্রায়ই চোঁখে পড়ছে। দেখছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। এগুলো দৃষ্টিতে আসার পর আমার নিজের কিছু মতামত পোষণ করতে ইচ্ছা হচ্ছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে রাজনৈতিক গুণে বিচারনা করে সাহিত্যিক গুণে বিচার করাই যুক্তি সঙ্গত। তিনি সাহিত্যিক; রাজনীতিবিদ বা Policy Maker না। তিনি বাংলা ভাষায় সাহিত্য সাধনা করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি পূর্ববাঙলার সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেন এবং একটি উচুস্থানে নিয়ে গেছেন যেটা পূর্ব বাঙলার কোনো মুসলিম এলিট করতে পারেনি। তৎকালীন বাঙলাতে হিন্দু এবং মুসলিম সমাজ থাকলেও সবাই বাংলা ভাষাভাষী মানুষ ছিলেন এবং বাঙলা বঙ্গভঙ্গের পূর্বে কখনো খণ্ডিত ছিলো না। আমার যামনে হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেকে বাংলা ভাষার কবি বা নিজেকে বাঙলার একটা অংশ মনে করতেন। তিনি কখনো বাঙালী হিন্দু হিসেবে সমগ্র বাঙলা থেকে নিজেকে আলাদা করে ভেবেছেন বলে মনে হয় না ঠিক যেমনটি পূর্ব বাংলার মুসলমান এলিটরা করেছে। এরকম যদি ভেবেই থাকতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাহলে তার সাহিত্য হয়তো সংস্কৃত ভাষাতেই রচিত হতো ঠিক যেমন পূর্ব বাঙলার মুসলমান এলিটরা উর্দু ভাষার চর্চা করতো।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ব্যাক্তিগত মতামত কি ছিলো জানি না। তবে, সে সময় জ্ঞানচর্চায় বাঙলার হিন্দুসমাজ এগিয়ে ছিলো, মুসলিম সমাজ পিছিয়ে ছিলো। বেশির ভাগ বুদ্ধিজীবী ছিলেন হিন্দুধর্মাবলম্বী এবং তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের প্রতিষ্ঠা হওয়াকে তখন সমর্থন করেননি। সাহিত্য মনষ্ক তার ক্ষেত্রেও বাঙলার হিন্দু সমাজ এগিয়েছিলো। বাঙলার বিখ্যাত কবি এবং সাহিত্যিকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন কাজী নজরুল ইসলাম, কবি জসীম উদ্দীন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বিশ্ব কবির বীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমূখ। কিন্তু, তাদের লেখায় সাহিত্য কর্ম মুসলামান সমজের থেকে বাঙলার হিন্দু সমাজে বেশি চর্চা করা হয়েছে।
বাঙলার ‘হিন্দু সমাজ’ এবং ‘মুসলমান সমাজ’ নামে দুটো ব্যাপার লেখায় উঠে আসছে। একটু সংক্ষিপ্ত ঐতিহাসিক পটভূমি তুলে ধরি। পূর্ব বাংলায় যেজন সাধারণের বসবাস ছিলো তারা ছিলো দরিদ্র এবং শিক্ষা হতে বঞ্চিত। এই অঞ্চলের উৎপাদন ব্যবস্থা ছিলো কৃষি নির্ভর। এই অঞ্চলের অর্থনীতি বা উৎপাদন ব্যাবস্থা আর্যদের শাসনামলে যেমন ছিলো মুসলমান এবং ব্রিটিশ শাসনামলেও তাই ছিলো। এই অঞ্চলের মানুষ কখনোই স্বাধীন ছিলো না। এক সময় আর্যরা শাসন করেছে, এক সময় তুর্কি এবং পারস্যের মুসলমান, এক সময় ব্রিটিশ এবং সর্বশেষ পাকিস্তানিরা। বাঙলায় সমাজ ব্যবস্থা ছিলো দুটো, একটা মুসলিম এবং একটা হিন্দু। মুসলিমদের মধ্যে একটি এলিট শ্রেণী ছিলো এবং হিন্দুদের মধ্যেও এলিট শ্রেণী ছিলো। ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর যে মুসলমান এলিট শ্রেণি কয়েকশ বছর শাসন করে আসছিল তারা বড় একটি ধাক্কা খায়। হিন্দু সমাজের ব্রাহ্মণশ্রেণি এক সময় মুসলমান শাসকদের শাসন কার্য পরিচালনায় সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে। এবং ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর ব্রিটিশদের সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে। যার ফলে মুসলমান এলিট শ্রেণি যেভাবে তলা নিতে চলে যায় সেভাবে ব্রাহ্মণশ্রেণিকে তলিয়ে যেতে দেখা যায় নি। মুসলমান এলিটদের এভাবে ক্ষমতা খর্ব হওয়ার কারণ হিসেবে ধরে নেওয়া যায় জনসাধারণের থেকে তাদের বিচ্ছিন্নতা, জনসাধারণ কি চায় তা অনুধাবন না করতে পারা। এর ফলেই হয়তো ব্রিটিশদের হাতে পরাজিত হয়ে পরাজিত মুসলমান এলিট শ্রেণিত ৎক্ষণাৎ জন সাধারণের অংশগ্রহণে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। এর থেকে অনুমেয় যে মুসলমান সমাজের উচুস্তরের এলিটদের সাথে নিচুস্তরের দরিদ্র্য এবং শিক্ষাবঞ্চিত জনসাধারণের একটি বিচ্ছিন্নতা বিরাজমান ছিলো। অন্যদিকে ব্রাহ্মণশ্রেণি বৃটিশদের থেকে কিভাবে সুযোগ সুবিধা নিতে হয় সেটা আয়ত্ব করেছে এবং নিজেদের সামাজিক এবং আর্থিক অবস্থান শক্ত করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় পূর্ব বাঙলার মুসলমান সমাজের একটি সমস্যা ছিল যেটা নিয়ে খুব কমই কথা বলতে শুনা যায়। পূর্ব বাঙলার যে উচুশ্রেণির ক্ষমতাবান মুসলমানরা সমর্থন করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা হওয়াকে, তারা সংস্কৃতি, রুচি, চিন্তা-চেতনা এবং আচরণগত দিক থেকে পূর্ববাংলার সাধারণ মানুষের থেকে পুরোই আলাদা ছিলেন
ঢাকা বিশববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় পূর্ব বাঙলার মুসলমান সমাজের একটি সমস্যা ছিল যেটা নিয়ে খুব কমই কথা বলতে শুনা যায়। পূর্ব বাঙলার যে উচুশ্রেণির ক্ষমতাবান মুসলমানরা সমর্থন করেছিলেন ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা হওয়াকে, তারা সংস্কৃতি, রুচি, চিন্তা-চেতনা এবং আচরণগত দিক থেকে পূর্ববাংলার সাধারণ মানুষের থেকে পুরোই আলাদা ছিলেন। পূর্ব বাঙলার দরিদ্র মুসলিম সমাজ এবং প্রভাবশালী মুসলিম এলিটদের মধ্যে একটা দূরত্ব বাঙলায় মুসলিমশাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে সব সময়ই ছিলো, ব্রিটিশ শাসনামলেও ছিলো। তারা সামজিকভাবে একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন।

বাঙলার এলিট মুসলমানরা কয়েকশ বছর ধরে ফার্সিভাষাকে দাপ্তরিক ভাষা এবং শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ব্যাবহার করেছে। ব্রিটিশ আমলে তারা আরবী এবং ফার্সি ভাষা কেমনে করতো জান্নাতে যাওয়ার ভাষা। তারা চেষ্টা করেছে আরবী হরফে বাংলা লিখতে।
উদাহরণ স্বরূপ, সেসব এলিট মুসলমানরা বাংলা কেমনে করতো বাঙলারমূর্খ জনসাধারণের মুখের ভাষা। তারা নিজেরা সব সময় ঘরে বাইরে উর্দুচর্চা করতো। ফার্সি ভাষা এবং ভারতীয় ভাষাগুলোর মিশ্রণে উর্দু ভাষা গঠিত। বাঙলার এলিট মুসলমানরা কয়েকশ বছর ধরে ফার্সিভাষাকে দাপ্তরিক ভাষা এবং শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে ব্যাবহার করেছে। ব্রিটিশ আমলে তারা আরবী এবং ফার্সি ভাষা কেমনে করতো জান্নাতে যাওয়ার ভাষা। তারা চেষ্টা করেছে আরবী হরফে বাংলা লিখতে। এটা করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। তারপর চেষ্টা করেছে বাংলাভাষার মধ্যে আরবী ফার্সি শব্দ ঢোকানোর। এতেও তারা পুরোপুরি সফলতা পায়নি। বাংলা ভাষাকে পুরোপুরি সরানো যায়নি। এসব কর্মকাণ্ড তাদেরকে বাংলাভাষা এবং সংস্কৃতি থেকে দূরে সরিয়েছে। কিন্তু, দরিদ্র এবং নিরক্ষর পূর্ব বাঙলার জনসাধারণের উপর তাদের একটা কর্তৃত্ত্ব বজায় ছিলো।

আমি মনে করি যে সব এলিট মুসলমানরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকে সমর্থন করেছিল তাদের খুব বেশি মাথায় তোলার প্রয়োজননেই। তারা নিজেদের স্বার্থে, হিন্দুদের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতেই সমর্থন করেছিলো। সে সব মুসলমান এলিটরা তাদের ক্ষমতা হারানোর শঙ্কায়ভীত ছিলেন। এমন কি তারা ১৯৪৭ সালের আগে পাকিস্তান আন্দোলনেরও কোনো তীব্র বিরোধীতা করেনি। তারা সে সময় হিন্দু এবং মুসলমানের জন্য পৃথক রাষ্ট্রের ধারণা নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ফলে একটা ভিন্ন পরিবর্তন আসবে যা হয়তো সেই মুসলিম এলিটরা প্রতিষ্ঠার সময় অনুমান করতে পারেনি। তাদের হয়তো ধারণা ছিলো বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রী এলিটদের আদর্শে বিকষিত হবে, বাংলা ভাষার চর্চার পরিবর্তে উর্দু গ্রহণ করবে এবং দরিদ্র জনসাধারণের থেকে দূরত্ব বজায় রাখবে। কিন্তু, এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর এই দেশে একটি সচেতন মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে ওঠে। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রত্যেকটি বিপ্লব বাসামাজিক সংস্কারে মধ্যবিত্তশ্রেণি গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। একটি শিক্ষিত এবং সচেতনজন গোষ্ঠী তৈরি হওয়ার ফলে পূর্ব বাঙলা পূর্ব পাকিস্তান হওয়ার পর বিভিন্ন আন্দোলন হতে শুরু করে। প্রথমটি ছিলো বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন। তারপর যতগুলো আন্দোলন হয়েছে সেগুলো কিন্তু সামাজিক পরিবর্তন বা জাগরণের ফলাফল ছিলো বলেই ধরে নেওয়া যায়। সর্বশেষটি ছিলো স্বাধীনতার লড়াই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রত্যেকটি আন্দোলনে এবং সামাজিক পরিবর্তনে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দেয়।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা যারা করেছিল তারা সহানুভূতি পাওয়ার তালিকায় সবার পিছনে থাকবে। তালিকা থেকে ছুঁড়ে ফেলবো না। কারণ, তারাও জ্ঞানী ছিলেন। কিন্তু, যারা সমর্থন করেছিলেন তারাও কিন্তু পুরোপুরি সমর্থন পাওয়ার যোগ্য না। কারণ, তাদের উদ্দেশ্যের চরিত্র বা ধরন হয়তো ভিন্ন ছিলো। পূর্ব বাঙলার মুসলমান এলিট এবং দরিদ্র নিরক্ষর মুসলমান জনসাধারণের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, চিন্তা-চেতনার মধ্যে মিল থাকলে বাঙলা এবং উপমহাদেশের ইতিহাসটা অন্যরকম হতে পারত হয়তো।
শাকিল আহসান শুভ, পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়