বড় অবহেলায় পড়ে আছে ইতিহাস সাক্ষী পলাশীপ্রান্তর

স্কুলজীবনে পাঠ্যবইয়ে পলাশীর যুদ্ধ পড়েছি। শ্রেণিকক্ষে যখন আমাদের শ্রদ্ধেয় ইতিহাসের শিক্ষক পলাশীর যুদ্ধের কাহিনি পড়াতেন তখন আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতাম। বর্ণনা দিতে দিতে স্যার দেখতাম কখনো রেগে যেতেন, কখনো চুপ করে যেতেন, পরক্ষণেই দেখতাম স্যারের চোখের কোণে জল। অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করতেন, ‘বণিকের মানদণ্ড পোহালে শর্বরী, দেখা দিল রাজদণ্ড রূপে’। তখন থেকেই মনের খাঁজে সেই ইচ্ছেটা লুকিয়ে ছিল পলাশীর আম্রপ্রান্তরে সময় সুযোগ পেলে যাব।
আমাদের বাড়ি থেকে খুব বেশি দূরে নয় এই ঐতিহাসিক স্থান। নদিয়া জেলার বাংলাদেশ ঘেঁষে সীমান্ত এলাকায় আমাদের বাড়ি। একই জেলায় অন্য প্রান্তে পলাশী। বড়দিনের ছুটিতে কয়েকজন বন্ধু মিলে চললাম পলাশী। বাসে করে। দু’ঘন্টার পথ। পলাশী স্টেশনে পৌঁছে এক চা দোকানির পরামর্শে ভ্যান রিকশায় চাপলাম পলাশীর ব্যাটলফিল্ড দেখব বলে। দূরত্ব অনধিক তিন কিলোমিটার। মফস্বলের পিচের রাস্তা, দুই পাশে দোকানপাট, বাড়ি-ঘর। এ রাস্তা গিয়ে উঠেছে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে। গন্তব্যের কাছাকাছি এসে রিকশা ডানে ছোট রাস্তায় মোড় নিল। অল্প কিছু দূর যেতেই বুঝলাম পৌঁছে গেছি। কারণ রাস্তা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে মনুমেন্ট। ভেতর এক কেয়ার আছেন। তাঁর সান্নিধ্যে যেতেই তিনি আঙুল উঁচু করে অদূরে কিছু একটা দেখিয়ে দিলেন। আমরা হাঁটতে লাগলাম আগাছায় পরিপূর্ণ মাঠ দিয়ে। বেশ কিছুক্ষণ পর পৌঁছালাম স্মৃতিসৌধের সামনে। না কোন চাকচিক্য নেই। চারিদিকে ঝোপঝাড়। মনে বড়োই কষ্ট হলো। ইতিহাস দাঁড়িয়ে আছি একগুচ্ছ অবহেলা ও উদাসীনতার মাঝে।
ইংরেজরা পলাশী যুদ্ধজয়ের প্রথম স্মারক স্থাপন করে ১৮৩৩ সালে। লর্ড কার্জনের সময় দ্বিতীয় স্মারক স্থাপন করা হয় ১৯০৯ সালে, যা এখন আর নেই, ভাগীরথী নদীতে বিলীন হয়েছে। পরে স্থাপন করা হয়েছে সাদাসিধে একটি মনুমেন্ট। মূল মনুমেন্টের বাইরে এক মানুষ সমান পিলারের উপরে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলার একটি ব্রোঞ্জ মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। চারিদিকে জঙ্গল। হ্যাঁ, জঙ্গলের ভেতর থেকে একটি কামান উঁকি দিয়ে জানান দিচ্ছে ঐতিহাসিক ২৩ জুনের বেদনাক্লান্ত কালো দিনের কথা।

আবার সামনের দিকে হেঁটে বাঁধের ওপর দাঁড়ালাম। এটা বন্যানিরোধ বাঁধ এবং রাস্তাও, ডানে অদূরে আছে একটি চিনিকল, তাই রাস্তার নাম সুগার মিল রোড। খৈতান গ্রুপের, তারা মিল স্থাপনের সময় স্থানের নাম খৈতান নগর রাখার চেষ্টা নিয়েছিল পলাশীর বদলে। স্থানীয় জনগণ ও বুদ্ধিজীবীদের আপত্তির মুখে নাম বদলাতে পারেনি। চিনিকলে এখন অবশ্য আর চিনি বের হয় না। বাঁধের প্রায় চার-পাঁচ ফুট নিচে কৃষিক্ষেত, সামনে-ডানে এবং বামেও কৃষিক্ষেত, অদূরেই ভাগীরথী নদী বহমান। সামনে বামে আখক্ষেত, ডানে কৃষক জমি চাষ করছেন। নদীর কাছে কোমর সমান উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা তিনটি স্মৃতিস্তম্ভ। পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের কামানের গোলায় নিহত সেনাপতি মীরমদন, মোহনলালের জামাই বাহাদুর আলী খাঁ এবং নোয়াই সিং হাজারী। আমাদের বামে ও ম্যাপের দক্ষিণে বেশ দূরে পলাশী গ্রাম। এখানে ছিল অজস্র পলাশ গাছ, হয়তো সেই কারণে স্থানটির নাম হয় পলাশী। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সামনে ও ডানে বামের কৃষিক্ষেত, বহমান ভাগীরথীর দিকে বিষণ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে মানশ্চক্ষে দেখতে থাকি সেদিনের পলাশী যুদ্ধক্ষেত্র।
পলাশীর গ্রামের সামনে ১ হাজার ২০০ গজ দূরে নাটোরের রানী ভবানীর লাখো বা লক্ষভাগ আমবাগান ছিল একসময়। এখন সমব্যবধানে সারি সারি কিশোরী আম গাছ। নতুন লাগনো হয়েছে। হয়তো আগামী বছর ডালে ডালে আম হাতছানি দেবে। চারদিক মাটির বাঁধ বা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। লক্ষভাগের উত্তর-পশ্চিমে ১৫০ গজ দূরে ভাগীরথী নদী। চারদিকে মাটির বাঁধের প্রাচীর এবং আমগাছের ঘন ডালপালার কারণে ইংরেজদের যুদ্ধ শিবিরটি আত্মরক্ষার জন্য ভালো কাজ দিয়েছিল সেদিন। এখন আমবাগানে একটাও আমগাছ নেই। শেষ আমগাছের মূল গুঁড়িটি যুদ্ধজয়ের স্মতিচিহ্ন হিসেবে ইংরেজরা লন্ডনে নিয়ে গেছে ১৮৭৯ সালে। সম্ভবত এখনো প্রদর্শিত হচ্ছে ইংল্যান্ডে কোনো জাদুঘরে।
আমবাগানের সামনে ২০০ গজ দূরে ইটের তৈরি এবং সুদৃঢ় প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ‘পলাশী হাউজ’ নামে সিরাজের একটি শিকারগৃহ ছিল। ক্লাইভ আমবাগানে অবস্থান নিয়ে এ শিকারগৃহটি অধিকার করে। উঁচু ছাদে উঠে দেখেন, এখান থেকে সামনের যুদ্ধ ক্ষেত্রটি দেখা ও চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখার চমৎকার সুযোগ। পেছনে অনেক দূরে গ্রাম, বাম দিকে নদী এবং মাটির প্রাচীর দিয়ে ঘেরা আমবাগানটি লর্ড বরার্ট ক্লাইভের কাছে যুদ্ধশিবিরের নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বিবেচিত হয়। শিকারগৃহ থেকে ৪০০ গজ উত্তরে এবং ভাগীরথী নদীর কাছে একটি বড় দীঘি এবং এর ১০০ গজ উত্তরে ছিল ছোট একটি পুষ্করিণী, এ দুই জলাশয়ই ছিল উঁচু মাটির বাঁধ দিয়ে ঘেরা। বাঁধের উপর দাঁড়িয়ে মনে পড়ে গেল স্কুল জীবনে স্যারের সেই ক্লাসের কথা। নজরুলের কবিতা স্যারের উদ্দাত্ত কণ্ঠে–ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর! সেই বিশ্বাসঘাতকদের ইতিহাসের কাহিনি আমাদের সকলের জানা।

শহুরে জীবনের একঘেয়েমি , দূষিত বাতাস, যানজট আর কোলাহল থেকে ছুটি নিয়ে পলাশী এলে আপনি উপহার পাবেন গ্রাম্য জীবনের সরলতা আর নৈঃশব্দ্য। পলাশী মনুমেন্টের নিচে দাঁড়িয়ে আপনি স্মরণ করতে পারেন ইতিহাসের দিক পরিবর্তনকারী সেই অধ্যায়কে। মীরমদন, মোহনলালের সমাধিক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ভাগীরথী বুক থেকে উঠে আসা কোনো বাতাস হয়তো ফিসফিস করে বলে যাবে তাঁদের আত্মত্যাগের কথা। ভাগীরথীর দুদিকের ঘন সবুজ বনানী আর বিভিন্ন ছোটছোট জনপদ আপনাকে মুগ্ধ করবেই।
কিন্তু একটাই আক্ষেপ ভারতের ইতিহাসের বাঁকের সাক্ষী পলাশী প্রান্তর বড়ো অবহেলায় পড়ে আছে । ইতিহাসকে আমরা যত্ন করতে ভুলে গিয়েছি। নদিয়া-মুর্শিদাবাদের একেবারে সীমান্তে ভাগীরথী নদীর পাড়ে এই পলাশীর আমবাগানেই হয়েছিল সিরাজ ও ক্লাইভের যুদ্ধ। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজের পরাজয় হয়েছিল কিছু বিশ্বাসঘাতকের ষড়যন্ত্রে। কিন্তু সে তো ১৭৫৭ সালের ২৩ জুনের কথা। আজ ২৬৪ বছর পরে এবং স্বাধীনতার ৭৫ বছরের দোরগোড়ায় সেই পলাশীর প্রান্তর কেন পড়ে আছে অবহেলায়, সেটা বোঝা দায়। মুর্শিদাবাদের হাজারদুয়ারীতে বহু কিছু আছে। কিন্তু এখানে কেন কিছুই নেই? এটিকে সাজিয়ে তোলা যেতে পারে। তাহলে মানুষ জানতে পারে পলাশীকে। দেখতে পারে পলাশীকে। নইলে এভাবেই একদিন মানুষের স্মৃতির বাইরে চলে যাবে অবহেলার পলাশী, ঐতিহাসিক পলাশীর যুদ্ধক্ষেত্র। দেশপ্রেমিক বীর সেনানী মীরমদন, মোহনলালদের স্মৃতিসৌধ।
দীপক সাহা : লেখক, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত