বিক্রির মিথস্ক্রিয়াতে যত যুদ্ধ : বারবি বনাম অ্যাভেঞ্জার্স অ্যাকশন ফিগার

অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে রামপুরার একটি দোকানে দেখলাম অ্যাভেঞ্জারসের অ্যাকশন ফিগার। হাল্ক, ক্যাপ্টেন আমেরিকা, স্পাইডারম্যান এবং থানোস। এই দোকানে মূলত মেয়েদের কসমেটিক্স, খেলনা পুতুল আর সাজ সজ্জার জিনিস পাওয়া যায়। আমার চুল যখন বড় ছিল তখন এই দোকান থেকে কয়েকবার চুল বাধার ব্যান্ড কিনেছিলাম। এখন পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় অভ্যাসবশত উঁকি মারি। অ্যাভেঞ্জার্সের অ্যাকশন ফিগার দেখে দাড়াঁলাম। ছোটবেলায় ব্যাটম্যান সুপারম্যানের অ্যাকশন ফিগার দিয়ে খেলেছি। তখন এগুলোকে বলতাম রোবট। বড় হয়ে জেনেছিলাম এগুলোকে বলে অ্যাকশন ফিগার।
অ্যাভেঞ্জার্সের অ্যাকশন ফিগারগুলোর মধ্যে আমার পছন্দ হয়েছিল নীল রঙ এর ক্যাপ্টেন আমেরিকা। আমি সেটা হাতে নিয়ে দেখছিলাম। একই সময় মায়ের হাত ধরে বেনি করা একটা বাচ্চা তার মতোই বেণী করা একটা বারবি ডল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল। আমি ক্যাপ্টেন আমেরিকাকে হাতে নিতেই সে লিপস্টিক দেখতে থাকা তার মায়ের কাছে আবদার ধরলো সেও ক্যাপ্টেন আমেরিকা কিনবে। মা তাকে বলে হাতে সে পুতুলটার নিয়েছে সেটাই কিনতে। পুতুলটার সঙ্গে চিরুণীও আছে। পুতুলের চুলও আচড়ে দেয়া যাবে।
বারবির চিরুনির কথা শুনে খেয়াল হলো ক্যাপ্টেন আমেরিকার একটা ঢাল থাকার কথা ছিল। দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম। দোকানদার বলে ‘খুঁইজা দেখি’। অবশেষে মেয়েদের চুরির বৈয়াম থেকে ক্যাপ্টেন আমেরিকার ঢাল উদ্ধার হলো। আমি এরমধ্যে দেখে নিলাম আর কার কার কি কি আছে। স্পাইডারম্যানের জন্য প্লাস্টিকের জাল আছে, থানোসের হাতে তার গ্লাভসটিও ঢুকিয়ে দেয়া আছে, আর হাল্ক এর পরনেও প্যান্ট আছে। কারটুনে দেখেছি হাল্ক রেগে গেলে তার জামা কাপড় সব ছিড়ে গেলেও প্যান্ট কখনো ছিঁড়ে না যেখানে সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক অবস্থাতেই অনেক সময় প্যান্ট ছিঁড়ে যায়। হয়তো হাল্ক প্যান্টেরও সুপার পাওয়ার আছে। ক্যাপ্টেন আমিরকার ঢালটা পেয়েই তার হাতের সাথে চাপ দিতে ক্লিক করে আটকে গেল। দারুণ! এই পুরো দৃশ্যটা বাচ্চাটা গাল ফুলিয়ে দেখলো। সে হাল্কের মতোই ফুসছে। বোঝাই যাচ্ছে যে সে বারবির চিরুনি চায় না, ক্যাপ্টেন আমেরিকার ঢাল চায়। তাই আবার আবদার ধরে মায়ের কাছে। এবার মা ভালো করে বোঝায় যে বোঝায় এসব খেলনা দিয়ে খেলে ছেলে বাবুরা। আঙ্কেলের (আমি) বাসায় ছেলে বাবু থাকায় আঙ্কেল এসব কিনছে। গুড গার্লরা খেলে বারবি দিয়ে।
আমি বুঝতে পারলাম এই বাচ্চাটি আর আমি একই ধরনির সামাজিক বিভাজনের স্বীকার হচ্ছি। সে মেয়ে বাচ্চা তাই তাকে পুতুলই কিনতে হবে। আর আমি অ্যাকশন ফিগার কিনলে ধরে নিতে হবে আমার বাসায় থাকা কোন ছেলে বাবুর জন্য কিনছি। আমার মনের মধ্যে কোন বাবু থেকে থাকলেও তার কোন সামাজিক স্বীকৃতি নেই। আমারও জেদ চাপল। পুরো সেট কিনে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলাম। দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম ‘কত জানি দাম বলেছিলেন’? দোকানদারেরও যেন অ্যাভেঞ্জার্সের মতো কোনো সুপারপাওয়ার আছে। সে বুঝে ফেলেছি আমি কি চাই। পালটা প্রশ্ন করল “সেট নিবেন? সেট নিলে কমায় রাখব। আপনি আমার পুরান কাস্টমার”। আমার মনের বাবুর কোন সামাজিক স্বীকৃ্তি না থাকলেও দোকানদারের স্মরণশক্তির স্বীকৃ্তি দেয়াই লাগে। তার মনে আছে আমি চুলের ব্যান্ড কিনতে আসতাম। দাম নির্ধারিত হল। আমি মানিবাগ থেকে টাকা বের করছিলাম। এমন সময় বাচ্চার মা নিজের বাছাই করা লিপস্টিক আর মেয়ের জন্য বারবি মিলিয়ে একটি দাম বলো। দোকানদার বুঝিয়ে বললো, লিপস্টিক আর বাড়বি এক সেট নয় তাই বিবেচনা করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে থানোস, স্পাইডারম্যান, হাল্ক আর ক্যাপ্টেন আমেরিকা অ্যাভেঞ্জার্সের এক সেট। দোকানদারের ভাষায় ‘চাইর পুতলা এক লগে’। এই দোকানদারের আরেকবার ভক্ত হলাম। খেলনা নিয়ে তিনি কোন জেন্ডার সংবেদনশীল শব্দ ব্যবহার করেননি। তার কাছে বারবিও পুতলা, অ্যাভেঞ্জার্সের অ্যাকশন ফিগারও পুতলা।
শুধু অ্যাভেঞ্জার্সের ছবিতেই যে যুদ্ধ থাকে তা নয়, একটি সাধারণ দোকানের বিক্রিয় মিথস্ক্রিয়াতেও অনেক যুদ্ধ থাকে। ক্রেতা বিক্রেতার মধ্যে যুদ্ধ, একই দোকানে এক ক্রেতার সঙ্গে পার্শ্ববর্তীর ক্রেতার যুদ্ধ, ক্রয়–বিক্রয়ের সঙ্গে যুক্ত সামাজিক স্বীকৃতিগুলোর যুদ্ধ, এবং সর্বোপরি অ্যাভেঞ্জার্সের সঙ্গে বারবি ডলের যুদ্ধ কিংবা স্টেরিওটাইপগুলোর সঙ্গে বা বাঁধাধরা মানসিকতার সঙ্গে অ্যাভেঞ্জার্স ও বারবি ডলের সম্মিলিতি যুদ্ধ। এতসব যুদ্ধের মাঝে আমিও যুদ্ধজয়ের মতো করেই অ্যাকশন ফিগারগুলো কিনে নিচ্ছি। কিন্তু গাল ফুলিয়ে রাখা একটা গুড গার্লের সামনে দিয়ে চার চারটে ব্যাটাছেলের পুতুল কিনে নিয়ে যাওয়াটা কেমন দেখায়? আমি তাই কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা বের করে অনেকটা চোরের মত আড়াল করে অ্যাভেঞ্জার্স অ্যাকশন ফিগার সেটের প্যাকেটটি ব্যাগে ভরলাম। বিক্রির এই যুদ্ধে ক্রেতার সকল যুদ্ধজয়ই বুঝি এক ধরনের পরাজয় যদিও তার ক্রয়কৃত পণ্যরা তাকে বোঝাবার চেষ্টা করে তার যুদ্ধজয় হয়েছে। তার কারণেই হয়তো মনে হচ্ছে অ্যাভেঞ্জার্সদের সঙ্গে নিয়ে আমি যেন কোনো যুদ্ধজয়ের মিশন শেষ করেছি। প্যাকেটটি ব্যাগে ভরার সময় খেয়াল করে নিলাম প্যাকেটে ক্যাপ্টেন আমেরিকার ঢাল আছে কিনা নতুবা আবার কোন সেফটি পিনের বৈয়ম থেকে ঢাল বের করতে হবে। কিন্তু ব্যগের চেন লাগাতে গেলাম ভুলে। তাই কাধে আবার ঝুলাবার সময়েই ব্যাগ থেকে অ্যাভেঞ্জার্সের প্যাকেট নিচে পড়ে গেল। এদিকে ক্যাপ্টেন আমেরিকার ঢাল যাচাই করার পর প্যাকেটটাও ঠিক মত বন্ধ করা হয় নাই। ফলে প্যাকেটের সর্বকোনায় থেকে থাকা থানোস গেল ছিটকে। থানোসকে খুঁজতে থাকি আমি রাস্তায়। অ্যাভেঞ্জার্স সিনেমায় থানোস অনেক শক্তিশালী হলেও ঢাকার রাস্তায় পথচারীদের ভিড়ে এই থানোস বেশিক্ষণ টিকতে পারবে না। ওদিকে বারবিরও রফা হয়ে গিয়েছে। বাচ্চাটি অনিচ্ছা নিয়ে বারবির প্যাকেট ধরে ছিল। তার পায়ের সামনেই ওটাকে দেখতে পেয়ে তুলে নিলো। থানোস! ছিটকে ওখানে চলে গিয়েছে। তার এক হাতে বারবি আরেক হাতে থানোস। এ যেন সকল বিভেদের মাঝে এক সামাজিক সাম্যবস্থা। আমাকে সে থানোসটি বাড়িয়ে দিল। এই থানোস সে কখনোই চায় নি, তার আকর্ষণ ছিল ঢালসহ ক্যাপ্টেন আমেরিকা নিয়ে যা আরও হাজারটা আকর্ষণের মত এখন প্যাকেটবন্দী। আমি থানোসকে আমার হাতে নিয়ে তাকে বললাম ‘থ্যাঙ্ক ইউ’। বাচ্চাটি কিছু বলল না। চুপ করে রইল। তার মা চিল্লাচ্ছে ‘আঙ্কেলকে ওয়েলকাম বলো, ওয়েলকাম বলো’।
আমি অ্যাভেঞ্জার্স নিয়ে অ্যাভেঞ্জার্স এর মত বাসায় ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম অনেকগুলো স্টেরিওটাইপ ভাঙার সাক্ষী হলাম। যেমন একটি বাচ্চা মেয়ের পুতুলের বদলে কথিত ছেলেদের খেলনা প্রতি আগ্রহ, আমার এই বুড়ো বয়সে খেলনা ক্রয় করলাম, এবং বাচ্চাটি বারবির মালিকিন হবার পরেই তার দ্বারা মহাপরাক্রমশালী থানোসের উদ্ধার হওয়া। কিন্তু সব স্টেরিওটাইপ ভাঙল কি? আমার কি তাহলে ঐ বাচ্চাটার হাতের বারবি পুতুলটাই ক্রয় করা উচিত ছিল নিজের জন্য?