বিশ্ব আলোকচিত্র দিবস ও আমাদের ড্যাডি

আত্মপ্রতিকৃতি (১৯৫১) : গোলাম কাসেম ড্যাডি/দৃক
এক
গোলাম কাসেম ড্যাডি (১৮৯৪-১৯৯৮) যখন ক্যামেরা হাতে নেন তখন অবিভক্ত ভারতের মুসলমান সমাজে ছবি তোলা নিয়ে নানা রকম সংস্কার ছিল। ধর্মীয় সংস্কারের কারণে মানুষ ছবি তুলতে ভয় পেত। আর ফটোগ্রাফি করা তো অনেক দূরের ব্যাপার। এই রকম একটা বিরূপ সময়ে মাত্র ১৮ বছরের এক তরুণ ক্যামেরা হাতে নিয়ে তৎকালীন সমাজব্যবস্থার ট্যাবু ভাঙেন। মুসলমান সমাজের চাপা পড়া ইতিহাসকে ক্যামেরায় বন্দি করে মানুষের নজরে আনেন। গোটা বিশ শতকের সমাজচিত্র ফ্রেমবন্দি হয়ে আছে তাঁর ক্যামেরায়। পশ্চাৎপদ সমাজ আর উপনিবেশ রাজনীতির বিপরীতে তাঁর ছবিগুলো বাঙালি মুসলমান সমাজের আধুনিক হয়ে ওঠার এক অবিনাশী দলিল। ড্যাডির ছবি দেখলে বোঝা যায়, কেমন ছিল বাঙালি মুসলমান সমাজের সাংস্কৃতিক বিকাশের পথ। একটা প্রগতিশীল সমাজ নির্মাণে ড্যাডির ভূমিকা ছিল একজন দুঃসাহসী নাবিকের মতো।
শতাব্দীকাল আগে এনসাইন বক্স ক্যামেরায় ছবি তোলা শুরু করেন ড্যাডি। কিন্তু এনসাইনের শক্তি ও ক্ষমতা ছিল অত্যন্ত সীমিত। একটিই অ্যাপারচার আর দুটি শাটার। অ্যাপারচার ১৪। শাটারের একটি টাইম আরেকটি ইনস্ট্যান্টেনিয়াস। টাইম মানে হচ্ছে যতক্ষণ খুশি শাটার খোলা রাখা যায়। আর ইনস্ট্যান্টেনিয়াস মানে ২০। আরো সহজ করে বললে এক সেকেন্ডের ২০ ভাগের এক ভাগ। টাইমে দিয়ে টেবিলের ওপর বা অন্য কিছুর ওপর রেখে ছবি তুলতে বেশ ঝামেলা। কখনো বেশি এক্সপোজার হয়, কখনো কম। স্লো শাটারের কারণে হাত একটু নড়ে গেলেই ছবি ঝাপসা হয়ে যায়। আর যার ছবি তোলা হতো তাকেও স্থির হয়ে বসে থাকতে হয়। ল্যান্ডস্কেপ বা প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি তুলতে হলে কোথাও ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে দম বন্ধ করে শাটার চাপতে হয়। এতসব যান্ত্রিক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও প্রবল উদ্যমে গ্লাস প্লেট নেগেটিভে ছবি তুলতে থাকেন ড্যাডি।
তখন চার থেকে ছয় আনায় পাওয়া যেত ছয়টি গ্লাস প্লেট নেগেটিভ। এই ছয়টি গ্লাস প্লেট নেগেটিভের মধ্যে দুটি শার্প ছবি পেলেই আনন্দে লাফিয়ে উঠতেন ড্যাডি। মাঝে মাঝে ছবি খারাপ হলে বা না হলে মন খারাপ হতো। তখন তাঁর বড় ভাই গোলাম কাদের তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলতেন, ‘আবার চেষ্টা করো। নতুন গ্লাস প্লেট কেনার জন্য তিনি ড্যাডিকে পয়সা দিতেন। ফটোগ্রাফির ব্যাপারে সব রকমের উৎসাহ দিতেন। ড্যাডির গল্প লেখার প্রেরণাও তাঁর এই ভাই।

দুই
ড্যাডি শুধু কিংবদন্তি আলোকচিত্রীই ছিলেন না, ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক অগ্রগণ্য দিকপাল। বিশ শতকের প্রথম দিকে মুসলমান সাহিত্যিকদের যে লম্বা তালিকা, তার গ্রাফের ওপরের দিকে ছিলেন গোলাম কাসেম ড্যাডি। তিনি ছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১) ও কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)-এর সমসাময়িক লেখক। কিন্তু এসব কাহিনি এ কালের পাঠক কিংবা সাহিত্যকর্মীদের কাছে কী কারণে অজানা, তা ভাবলে বিস্ময় লাগে। অবশ্য এ কথা ঠিক যে, ড্যাডি ছিলেন আত্মকুণ্ঠ ও প্রচারবিমুখ মানুষ। তিনি লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ট্রেনিং ক্যাম্পে বসে ড্যাডি যখন লিখতে শুরু করেন তখন মুসলমান সমাজে পর্দানসীন নারীদের গল্প-উপন্যাসের উপজীব্য বিষয় করা নিষিদ্ধ ছিল। ধর্মীয় বিবেচনায় এটাকে পাপ হিসেবেই গণ্য করা হতো। সেই রকম একটা অন্ধকার সমাজের প্রথাগত নিয়মের বিরুদ্ধে কলম ধরেন ড্যাডি। ঘরবন্দি নারীদের সাবলীলভাবে উপস্থাপন করেন তাঁর লেখনীতে। গল্প-সাহিত্যে তারা স্থান পান কেন্দ্রীয় কিংবা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে। এসব করেই ড্যাডি থেমে যান না। ক্যামেরায় ফ্রেমবন্দি করেন তাদের জীবনের গল্প। বৈরী সমাজব্যবস্থার ভেতর বিপরীত স্রোতে পথ চলতে গিয়ে তাঁকে কতটা কাঠখড় পোহাতে হয়েছে কে জানে! তবে এতটুকু বুঝতে বাকি নেই যে, আধুনিক সমাজ বিনির্মাণে তাঁর কলম ও ক্যামেরা কতটা শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছিল। এসব কারণেই তিনি শিল্প ও সাহিত্যমহলে উজ্জ্বল জ্যোতি হয়ে ওঠেন।
ড্যাডির জীবনকাল দুটি শতাব্দীকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। ১০৪ বছরের দীর্ঘ জীবন তিনি উৎসর্গ করেছেন আলোকচিত্র ও সাহিত্য সাধনা কর্মে। খুব সাধারণ যাপনের মধ্যেও যে বর্ণাঢ্য জীবন বয়ে নেয়া যায় তা সাহিত্য আর আলোকচিত্রের বোদ্ধাদের দেখিয়েছিলেন তিনি। ড্যাডির প্রকাশভঙ্গি আজীবন ছিল তাঁর রুচি আর ভারসাম্যবোধের বিশ্বস্ত বাহক। এসব কারণে পূর্ব বাংলার আলোকচিত্রীদের অভিভাবকত্বের দায়িত্বও আপনা থেকেই যেন গিয়ে বর্তেছিল তাঁর ওপর। তিনি তো শুধু কিংবদন্তি আলোকচিত্রী আর সফল গল্পকারই ছিলেন না, ছিলেন আলোকচিত্রীদের শিক্ষক, সংগঠক আর সমাজের বিবেক। দীর্ঘ আলোকচিত্র জীবনে তাঁর যে ত্যাগের মহিমা সে কারণেই বোধহয় তিনি আলোকচিত্রীদের পথিকৃৎ হয়ে উঠেছিলেন। হয়ে উঠেছিলেন সবার ‘ড্যাডি’। অবিভক্ত বাংলায় আলোকচিত্রের ক্রমবিকাশের ধারায় তিনি যে পথ তৈরি করেছেন সেই পথ ধরেই আমরা এখন হাঁটছি। তাই তিনি আমাদের প্রণম্য; আমাদের পথপ্রদর্শক।
তিন
সম্পূর্ণ নিজের প্রচেষ্টায় ফটোগ্রাফি শিখেছিলেন ড্যাডি। অন্যকে যেন তাঁর মতো কষ্ট করে শিখতে না হয় এর জন্য গত শতকের তিনের দশকের শেষদিকে তিনি মাসিক সওগাত পত্রিকায় ফটোগ্রাফি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখতে শুরু করেন। চার বছর ধরে ছাপা হয় সেসব প্রবন্ধ। দেশ ভাগের সময় ড্যাডি রাজশাহীর ডিস্ট্রিক রেজিস্ট্রার থাকাকালে তাঁকে দেখে বেশ কয়েকজন তরুণ ফটোগ্রাফির প্রতি আকৃষ্ট হন। সরকারি বাসভবনে বসেই তিনি তাঁদের আলোকচিত্রের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন।
অবসরগ্রহণের পর ঢাকায় আসেন। পূর্ব বাংলার রাজধানী হলেও ঢাকা তখন ছিল মফস্বল শহরের মতো। ১৯৫১ সালে ড্যাডি ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেন ট্রপিক্যাল ইনস্টিটিউট অব ফটোগ্রাফি। এটিই এই বঙ্গের প্রথম ফটোগ্রাফিক ইনস্টিটিউট বলে জানা যায়। তৎকালীন সমাজে নানা সীমাবদ্ধতার কারণে ১৯৫৩ সালেই ইনস্টিটিউটটি বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৫৫ সালে বারডেমের প্রতিষ্ঠাতা ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম, অবসরপ্রাপ্ত ডিস্ট্রিক রেজিস্ট্রার গোলাম কাসেম ড্যাডি, তৎকালীন আর্ট কলেজের ছাত্র সুজা হায়দার, কলেজছাত্র মওদুদ আহমদ (পরবর্তী সময়ে রাজনীতিবিদ), রহিম নেওয়াজ (পরবর্তীকালে সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে জহির রায়হানের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন), চৌধুরী লুৎফর রহমান, মাহবুব-উজ-জামান, প্রেস ফটোগ্রাফার মোশাররফ হোসেন লাল প্রমুখ মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ইস্ট পাকিস্তান ফটোগ্রাফার্স অ্যাসোসিয়েশন। ড্যাডি ছিলেন এই সংগঠনের সহসভাপতি। ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম আর সুজা হায়দার ছিলেন যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক [সূত্র : অনুপম হায়াত রচিত প্রবন্ধ – আলোকচিত্র (১৮৪০-১৯৭০), চারু ও কারুকলা, সম্পাদক : লালা রুখ সেলিম, প্রকাশকাল : ডিসেম্বর ২০০৭, প্রকাশক : বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি]।
১৯৬২ সালে ঢাকার ৭৩ নম্বর ইন্দিরা রোডের নিজ বাড়িতে ড্যাডি প্রতিষ্ঠা করেন ক্যামেরা রিক্রিয়েশন ক্লাব। এই প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তিনি এ দেশের অনেক তরুণের মনে ফটোগ্রাফির বীজ বুনতে শুরু করেন। কিন্তু তখন বাংলায় লেখা বইয়ের খুব অভাব ছিল। এই অভাববোধ থেকে ড্যাডি বই লেখায় মনোনিবেশ করেন।
চার
ফটোগ্রাফি নিয়ে তিনটি বই লেখেন ড্যাডি। বইগুলো এখন ইতিহাসের আকর। আলোকচিত্রী আর গবেষকদের আরাধনার উপাত্ত। তাঁর দুর্লভ ও দুষ্প্রাপ্য বইগুলো এ কালের আলোকচিত্রী আর সমাজ সচেতন মানুষের কাছেও দিশারির মতো। কিন্তু বইগুলো পাওয়া খুব দুরূহ।
১৯৬৪ সালের আগস্ট মাসে ‘ক্যামেরা’ নামে ড্যাডির একটা ফটোগ্রাফিবিষয়ক বই প্রকাশিত হয়। বইটি যখন ছাপা হয় তখন তাঁর বয়স সত্তর বছর। দেশ ভাগের পর এপার বাংলা থেকে প্রকাশিত এটিই বাংলায় লেখা ফটোগ্রাফিবিষয়ক প্রথম বই বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়।
ড্যাডির লেখা দ্বিতীয় বই ‘এক নজরে ফটোগ্রাফি’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালের জুলাই মাসে। বইটি ক্যামেরা রিক্রিয়েশন ক্লাবের পক্ষ থেকে প্রকাশিত হয়। ড্যাডি ব্যক্তিগতভাবে বইটির ব্যয়ভার বহন করেন বলে জানা যায়। ৪০ পৃষ্ঠার এই বইয়ে ফটোগ্রাফির ১৯টি বিষয় নিয়ে আলোকপাত করা হয়।
ড্যাডির লেখা তৃতীয় বই ‘সহজ আলোকচিত্রণ’ প্রকাশিত হয় ২০০২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর। বইটি পাঠশালা ও দৃক যৌথভাবে প্রকাশ করে। আলোকচিত্রের মতো একটি বিশাল বিষয়ের আদ্যোপান্ত ড্যাডি মাত্র ছয়টি অধ্যায়ের মধ্যে সামাল দিয়েছেন।
পাঁচ
দীর্ঘ ৮৬ বছর ফটোগ্রাফি জীবনে প্রায় শত ক্যামেরা ব্যবহার করেছেন ড্যাডি। প্লেট ক্যামেরার পর কোডাক, আগফা, ফকলান্ডার, জাইস আইকন ক্যামেরা ব্যবহার করেছেন তিনি। লাইকা আর রোবট ক্যামেরা ব্যবহার করেছেন দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের সময়ই। শেষের দিকে ইয়াসিকা, অলিম্পাস, মিনোলটা, ক্যানন প্রভৃতি ব্যবহার করেছেন। তাঁর সর্বশেষ ক্যামেরা হলো পেনটেক্স কে-১০০০।
দিনের আলোয় ছবি তুলতে পছন্দ করতেন ড্যাডি। নিতান্ত ঠেকে না গেলে ফ্লাশ ব্যবহার করতেন না। পোর্ট্রেট তোলার জন্য ইনডোর-আউটডোর সব রকম আলো ব্যবহার করতেন। ভালো পোর্ট্রেট পাওয়ার জন্য বড় অ্যাপারচারের লেন্স ব্যবহার করতেন। বেশি স্পিডের ফিল্ম ব্যবহার করতে চাইতেন না। রঙিন ফিল্মে আগ্রহ ছিল না। তিনি মনে করতেন, রঙিন ফিল্মে আসল জিনিসটা আসে না। সাদা-কালোতে যেটা পাওয়া যায় রঙিনে তা পাওয়া যায় না।
ফটোগ্রাফিকে আর্ট বলেই মনে করতেন তিনি। একজন চিত্রকরকে যেমন ছবির কম্পোজিশনের দিক খেয়াল করে ছবি আঁকতে হয়, তেমনি একজন আলোকচিত্রীকেও তার বুদ্ধি ও জ্ঞান খরচ করে ক্যামেরার সাহায্যে সেই রকম ছবি ধরতে হয়। তিনি মনে করতেন, এ বিষয়ে ফটোগ্রাফারদের কৃতিত্ব আরো বেশি। কেননা চিত্রশিল্পী ইচ্ছামতো তুলির সাহায্যে ছবির রূপ দিতে পারেন। কিন্তু আলোকচিত্রশিল্পীকে ক্যামেরার সামনে যা থাকে তা গুছিয়ে এক নিমিষে ছবি সৃষ্টি করতে হয়।
ড্যাডি নিজেই তাঁর ফিল্ম ডেভেলপ করতেন। নিজের বানানো এনলার্জারে ছবি প্রিন্ট করতেন। একেবারে শেষ বয়সেও তিনি ডার্করুমে ঢুকে ছবি প্রিন্ট করতেন। প্রিন্ট করতে তাঁর ক্লান্তি লাগত না। ভালো ছবি প্রিন্ট করতে পারলে গুনগুন করে গান গেয়ে উঠতেন।
অনেকে তাঁকে বলতেন, ‘আপনি যে সারা জীবন ফটোগ্রাফি করলেন এতে আপনার লাভ কী হলো?’ ড্যাডি বলতেন, ‘এদিক থেকে দেখলে ফটোগ্রাফি করে পয়সাকড়ি কিছুই হয়নি, বরং আর্থিক ক্ষতিই বেশি হয়েছে। কিন্তু ফটোগ্রাফি আমাকে যা দিয়েছে চাকরি কোনোদিন তা দিতে পারত না। আমার জীবনে ছবি না থাকলে, ফটোগ্রাফি না থাকলে এত বড় বড় মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব হতো না। এত মানুষের ভালোবাসা, খাতির-যত্ন পাওয়া যেত না। এই যে এত মানুষের সঙ্গে পরিচয়, সৌহার্দ্য লাভ; এটি সামান্য ব্যাপার নয়।’
সাহাদাত পারভেজ : আলোকচিত্রী ও গবেষক
১৯ জুলাই ২০২১