যেভাবে সাপ্তাহিক ‘বেগম’এর যাত্রা শুরু হয়েছিল

‘বেগম’ পত্রিকা। বাংলা ভাষায় সচিত্র প্রথম নারী সাপ্তাহিক। নারীদের সাহিত্যে অঙ্গনে, এগিয়ে নেওয়ার জন্য এই সাপ্তাহিকের যাত্রা শুরু হয় ১৯৪৭ সালে ২০ জুলাই। কলকাতা থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটির উদ্যোগ নেন তৎকালীন সওগাত পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন। প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদিকা ছিলেন কবি বেগম সুফিয়া কামাল। সেই সময়ে দাঙ্গার কারণে কলকাতায় এক অশান্তির পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এই অশান্তি পরিবেশের মধ্যে সম্পাদক নাসির উদ্দীন নারীদের সাহিত্যচর্চার জন্য একটি আলাদা কাগজ বের করার উদ্যোগ নেন। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে কাজ করতেন মোহাম্মদ নাসির উদ্দীনের মেয়ে নূরজাহান বেগম। তখন তিনি সবে মাত্র কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন।

মেয়েদের লেখার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এই সাপ্তাহিকটি। হিন্দু এবং মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মেয়েদের মধ্যে ‘বেগম’ জাগরণ সৃষ্টি করে। প্রথম সংখ্যা ছাপা হয় ৫০০ কপি। মূল্য ছিল চার আনা। প্রচ্ছদে ছাপা হয় নারী অধিকার পথিকৃৎ বেগম রোকেয়ার ছবি।
১৯৪৮ সালে কলকাতায় প্রথম ‘ঈদসংখ্যা বেগম’ প্রকাশিত হয়। এ সংখ্যায় ৬২ জন নারী লেখকের লেখা ছাপা হয়। এর মূল্য ছিল ২ টাকা। পরে আরও একটি ঈদ সংখ্যা বের করা হয়। ধর্ম সম্পর্কে মহিলাদের জ্ঞান লাভের জন্য ১৯৪৯ সালে ছাপা হয় বেগম বিশ্বনবী সংখ্যা। এ সংখ্যায় ২৪টি প্রবন্ধ, ৪টি কবিতা, ২টি সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়। ১৯৫০ সালে পত্রিকাটিকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। ঢাকায় আসার পর ১৯৫১-৫২ থেকে আবার বেগম–এর বিশেষ ঈদসংখ্যা বের হয়। বরাবর লেখিকাদের ছবি দিয়ে ঈদসংখ্যা প্রকাশ হয় বেগম–এর। এতে লেখিকারা পরস্পরকে চিনতে পারেন।
পত্রিকাটির আলোচ্য বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল নারী জাগরণ, কুসংস্কার বিলোপ, গ্রামগঞ্জের নির্যাতিত নারীদের চিত্র, জন্মনিরোধ, পরিবার পরিকল্পনা, প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েদের জীবনবোধ থেকে লেখা চিঠি এবং বিভিন্ন মনীষীর বাণী।

পত্রিকাটি কেন্দ্র করে ১৯৫৪ সালে গড়ে ওঠে বেগম ক্লাব। এখানে বেগমের লেখকরা একত্রিত হতে সহযোগিতা করত। তাঁরা একসঙ্গে হয়ে আলাপ-আলোচনা করতেন। প্রথম দিকে মাসে একবার। পরের দিকে বছরে একবার। বেগমের অফিসে রুমে এই ব্যবস্থা করা হত। পরের দিকে বিশিষ্ট লেখিকাদের সংবর্ধনা দেওয়া শুরু করল বেগম ক্লাব। প্রথম সংবর্ধনা দেওয়া হয় কবি সুফিয়া কামালকে। শামসুন্নাহার মাহমুদ ছিলেন বেগম ক্লাবের সভানেত্রী আর সেক্রেটারি ছিলেন নূরজাহান বেগম। এই ক্লাবটি পরিচালনার জন্য ব্যয় বহন করতেন সওগাত প্রেসের আয় থেকে। কারো কাছে কোনো অনুদান বা দান নেওয়া হত না। বেগম ক্লাবের কর্মকাণ্ড চলে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত।

বেগম পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগম এক সাক্ষাৎকারে বলেন, নারীদের সৃজনশীল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলাই ছিল বেগমের উদ্দেশ্য। ‘বেগম’ পত্রিকায় গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, আলোচনা, পল্লী উন্নয়ন, মাতৃমঙ্গল, স্বাস্থ্য, সৌন্দর্যচর্চা, শিশুমঙ্গল, সেলাই, চিঠিপত্র, ছায়াছবির কথা ইত্যাদি বিষয়ে লেখা ছাপা হতো। ওই সময় নারী লেখকদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। লেখা সংগ্রহ করতে কষ্ট হতো। বিভিন্ন ইংরেজি পত্রিকা থেকে লেখা সংগ্রহ করে আমরা তা অনুবাদ করে দিতাম। ‘সওগাত’ নারীসংখ্যা করার জন্য নারীদের যে ছবি সংগ্রহ করা হয়েছিল, আমরা সেগুলো ব্যবহার করতাম। ব্লক করে ছবি ছাপাতে হতো। বেগমে লিখতেন কবি সুফিয়া কামাল, শামসুন নাহার মাহমুদ, কবি মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, হামিদা খানম, মহসীনা আলী, সাঈদা খানম, হোসনে আরা মোদাব্বের, হুসনা বানু খানম, লুলু বিলকিস বানু, মালেকা পারভীন বানু, মাজেদা খাতুন, সারা খাতুন, জাহানারা আরজু, লায়লা সামাদ, নূরজাহান মুর্শিদ, মাফরুহা চৌধুরী প্রমুখ।

প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা ‘বেগম’-এর সম্পাদক সুফিয়া কামাল সম্পাদকীয়তে লিখলেন : সুধী ব্যক্তিরা বলেন, জাতি গঠনের দায়িত্ব প্রধানত নারীসমাজের হাতে, কথাটা অনস্বীকার্য নয় এবং এই গুরুদায়িত্ব পালন করতে হলে পৃথিবীর কোনো দিক থেকেই চোখ ফিরিয়ে থাকলে আমাদের চলবে না, এ কথাও মানতে হবে। শিল্প-বিজ্ঞান থেকে আরম্ভ করে গৃহকার্য ও সন্তান পালন সর্বক্ষেত্রে আমরা সত্যিকার নারীরূপে গড়ে উঠতে চাই।
বর্তমানে বেগম মাসিক ভিত্তিতে প্রকাশিত হয়। বর্তমানে দায়িত্বে আছে নূরজাহান বেগমের জ্যেষ্ঠ কন্যা ফ্লোরা নাসরিন খান।
তথ্যসূত্র : বিবিসি বাংলা, প্রথম আলো, উইকিপিডিয়া