স্বপ্নতরীর অপরাজেয় বাংলা

‘দেখেছিনু তোমা ঐ বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে,
বিরচিত মোর হ্দয় অবগাহনে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, হাজারও শিক্ষার্থীর আবেগ, ভালোবাসা,অনুপ্রেরণার এক কালবিজয়ী পীঠস্থান।আর এই বিশ্ববিদ্যালয় সূচনার ইতিহাস থেকে শুরু করে বর্তমানের পথচলা যেন একটি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বকারী।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি অলিগলি যেন একেকটি আন্দোলন,একেকটি সংগ্রাম,একেকটি ইতিহাস।ব্রিটিশ শাসনামল থেকে ৫২-এর ভাষা আন্দোলন,৬৬-এর ছয়দফা,৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১এর মহান মুক্তিযুদ্ধ,৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন,এক-এগারোসহ সকল প্রকার জাতীয় আন্দোলনের সূতিকাগার হচ্ছে সর্বোচ্চ এই বিদ্যাপীঠ।এসব আন্দোলন থেকে উদ্দীপনা নিতে এবং দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদেরকে স্মরণীয় করে রাখার অভিপ্রয়াসে নানাসময়ে স্থাপিত হয়েছে নানা ভাস্কর্য। আর এই ভাস্কর্যগুলো মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অপরাজেয় বাংলা।
ছোটবেলা থেকে ক্যালেন্ডার,সাধারণ জ্ঞানের বইতে ছবি দেখেছি অপরাজেয় বাংলার।অবুঝ শৈশবে কৌতূহল মনে উঁকি দেওয়াতে বাবার থেকে জানার পরে এটাই বুঝতাম অপরাজেয় বাংলা মানেই মুক্তিযুদ্ধ ।ঠিক যতবার অপরাজেয় বাংলার ছবি দেখতাম মনের অবগাহনের আবেগ সঞ্চারিত হয়ে শরীরের পশমগুলো খাঁড়া হয়ে যেত।এই আবেগ,ভালোবাসার কারণ ছিল অজানা।নানা কারণে ঢাকাতে আসা হলেও কখনো অপরাজেয় বাংলার দর্শন নেওয়া হয়ে ওঠেনি।ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন বাদ দিয়ে যখন স্বপ্ন দেখতাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্বিত শিক্ষার্থী হওয়ার সেদিনই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হয়েই অপরাজেয় বাংলার দর্শনার্থী হব। আর পাঁচজনের মতো বেদিতে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার।সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে সেটি সম্ভব হয়েছে আর আবেগতাড়িত হয়েই কোভিড-১৯এর এই অসময়েও যেন কল্পনাচক্ষু দিয়ে দর্শন করছি আমার সেই স্বপ্নচারিণী অপরাজেয় বাংলা।

অপরাজেয় বাংলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে অবস্থিত। এটি নির্মাণ করেন মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর সৈয়দ আব্দুলাহ খালিদ। অপরাজেয় বাংলা নামকরণটি করেছিলেন মুক্তিযাদ্ধা ও সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী ।

ভাস্কর্য নির্মাণের পেছনে মূলত স্বাধীনতার চেতনা কাজ করেছিল—এমনটাই মনে করতেন সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ। তিনি নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বীরশ্রেষ্ঠ হিসেবে সামরিক বাহিনীর সাত বীরকে বেছে নেওয়া হয়, তখন সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদের মনে এক ভিন্ন অনুভূতির জন্ম হয়। তিনি ভাবেন, যে কৃষকের সন্তান লাঙল ফেলে হাতে বন্দুক তুলে নিয়েছিল, যে কোনো দিন চোখে দেখেনি এমন কোনো জিনিস, তেমন একজন সাধারণ মানুষ সেই অস্ত্র দিয়েই প্রশিক্ষিত সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই করে জাতিকে স্বাধীনতার স্বাদ পাইয়ে দিল। সেই ত্যাগের কোনো মূল্যায়ন না হওয়ায় তিনি এমন কিছুর কথা ভাবতে থাকেন, যা এই মানুষদের অবদানের স্বাক্ষর বহন করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে আজ যেখানে স্বাধীনতার স্মারক ভাস্কর্য ‘অপরাজেয় বাংলা’ দাঁড়িয়ে আছে, সেই স্থানটির একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। একাত্তরের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোতে এখানেই বাংলাদেশের প্রস্তাবিত পতাকা উত্তোলন করেছিলেন তৎকালীন ছাত্রনেতারা। স্বাধীনতা পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৭৩ সালে ওই স্থানেই একটি স্মারক ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু নির্মাণ শৈলীতে ত্রুটি রয়েছে মর্মে তা ভেঙে ফেলা হয়। নতুন করে স্থানটিতে আরেকটি ভাস্কর্য নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) তৎকালীন নেতৃবৃন্দ।

সময় ১৯৭৪ সাল। যেকোনো কারণেই হোক, তখন সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদের নামটা সামনে চলে আসে। তিনি তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। এমন একটি কাজের সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন খালিদ। তিনি কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই শুধু স্মারক তৈরির খরচ হিসেবে ৫০ হাজার টাকার একটি প্রকল্পের দলিল দাখিল করেন। সিদ্ধান্ত হলো এই টাকার অর্ধেক দেবে ডাকসু, বাকি অংশ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তখন অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরী। ১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি নাগাদ কাজ শুরু হলো। কাজে শুরুর আগে খালিদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা থেকে ডেপুটেশন নিলেন। এই কাজের জন্য বাজেট ঘোষণা করা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষক এবং ডাকসু প্রতিনিধি ম হামিদকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। মাঝে কয়েকবার অর্থ সংকটের অজুহাতে কাজ বন্ধ করতে হয়েছিল। তারপর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনকের সপরিবারে নিহত হওয়ার ঘটনার পর কার্যত বন্ধই হয়ে যায় ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ। ১৯৭৭ সালে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির হাতে অর্ধসমাপ্ত ভাস্কর্যটি ক্ষতিগ্রস্তও হলো। ওই বছরের আগস্টে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে ভাস্কর্যটি থাকবে কি থাকবে না এমন বিতণ্ডা থেকে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন ছাত্ররা। এতে অন্তত ৩০ জন আহত হন। ফলে অর্ধসমাপ্ত অবস্থাতেই দীর্ঘদিন দাঁড়িয়ে থাকতে হলো অপরাজেয় বাংলাকে।

শেষ পর্যন্ত ১৯৭৯ সালে অনেক ঝড়ঝাপটা মোকাবিলা করে নির্মাণ শেষ হলো অপরাজেয় বাংলার। ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর অপরাজেয় বাংলার উদ্বোধন করলেন যুদ্ধাহত কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে ত্রিকোণাকৃতির একটি বেদি, মাটি থেকে যার উচ্চতা ১৮ ফুট। এই বেদির ওপরই স্থাপন করা হয় ভাস্কর্যটি। স্থপতি রবিউল হোসেন এই অপরাজেয় বাংলার কম্পোজিশনের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে ভাস্কর্যের পাদভূমী ও ফিগারের সমন্বয়ে একটি পিরামিডাল কম্পোজিশনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ তাঁর সহযোগী বদরুল আলম বেনুকে নিয়ে দীর্ঘ কয়েকটি বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে তৈরি করেন স্বাধীনতার এ স্মারক। প্রথম দিকে তাঁরা বারো থেকে তেরো ঘণ্টার মতো কাজ করে তিন ফুট উঁচু একটি মডেল তৈরি করেন। মডেলটি তৈরি করা হয়েছিল কাদামাটি দিয়ে। সেই তিন ফুটকে চারগুণ বড় করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ব্যবহার করলেন মাটি, বালু, কংক্রিট ও পাথর।

ভাস্কর্যের মূল উদ্দেশ্য ছিল একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি প্রতিনিধিত্বমূলক উপস্থাপন। মূলত মুক্তিযুদ্ধে সিপাহি জনতার পাশাপাশি কৃষক ও সাধারণ মানুষ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই সমানভাবে অংশ নিয়েছিলেন, তা তুলে ধরাই ছিল এর উদ্দেশ্য। সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ নিজে ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর সহযোগী বদরুল আলম বেনুও ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। এই দুই মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীনতার চেতনাকে চিরদিনের জন্য মানুষের মনে জাগরুক রাখতে রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে বাটালি চালিয়েছেন নিরলসভাবে।

শেষ পর্যন্ত তিনটি ফিগারের সমন্বয়ে তৈরি করা হয় অপরাজেয় বাংলা। মাঝখানের ফিগারটি গ্রামের এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধা, যে বাম হাতে ধরে রেখেছে একটি গ্রেনেড, আর ডান হাতে উদ্ধত রাইফেল। ওই তরুণের মডেল হলেন বদরুল আলম বেনু। এর বাম দিকের ফিগারটি থ্রি নট থ্রি রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে আছেন, যা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের প্রতিনিধিত্ব করে। এর মডেল হলেন সৈয়দ হামিদ মকসুদ ফজলে। আর ফার্স্ট এইড বক্স হাতে যে সেবাদানকারী তরুণী, তার মডেল হয়েছিলেন প্রথমে খালিদের খালাতো বোন হাসিনা আহমেদ, শেষ পর্যায়ে এসে ম হামিদের স্ত্রী ফাল্গুনী হামিদ। তিন ফুট উঁচু যে মডেল প্রথমে তৈরি করা হয়, পরে তার ওপর কংক্রিটের ঢালাই দিয়ে ভাস্কর্যের উচ্চতা বারো ফুটে উন্নীত করা হয়। এরপর শুরু হয় খোদাইয়ের কাজ। আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসে তিনটি মানুষের ফিগার।

আর এই ভাস্কর্য আমাদেরকে আজও সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে একাত্ম হওয়ার অনুপ্রেরণা জোগায় আর ভবিষ্যতেও এ ধারা অটুট থাকবে বলে আমরা প্রত্যাশা রাখি।
মুসলিমা খাতুন পান্না, পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।