উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান

এই উদ্যানের পরিবর্তনে কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছিলেন ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি আমাদের কীভাবে হলো‘। আমরা দেখলাম এক কবি বাঙময় অস্ত্র নিয়ে একাই লড়লেন, উদ্যানের বার্তা পৌঁছে দিলেন প্রতিটি প্রাণে৷ সেই ক্ষরণ আমাদের আজো মুছে যায়নি, শিশুপার্কের কথা আজও আমরা সেমিনারে, মাঠে, ময়দানে বলি। শিশুরা পাঠ্যসূচিতে আওড়ায় কীভাবে সবুজ দূর্বাদলে ডাকা মাঠে স্বাধীনতা এসেছিল, তারপর কীভাবে তা শিশুপার্ক ও দোলনায় পরিণত হয়ে গেলো।
আজ আবার ‘মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ, বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল’। দ্বিতীয়বারের মত সেদিনের সেই স্মৃতি মুছে দিতে উদ্যত হয়েছে কালো হাত৷ দূর্বাদলের জায়গা লোপাট হয়ে গেছে রেস্তোরাঁয়। যেখানে স্বাধীনতা এনেছিলো বীরেরা সেখানে এখন প্রেমিকেরা আসবে হাত ধরে, পয়সাওয়ালারা আসবে গাড়ি হাকিয়ে। জম্পেশ খাবেদাবে, হৈ-হুল্লোড়ের করে জলের বোতল চিপকে ছুঁড়বে, প্রেমিকার খোঁপার মালা ছিঁড়ে ফেলে হাতাহাতি করবে নয়তো একদল বুবুক্ষ ঘুরঘুর করবে রেস্তোরাঁর আশেপাশে আর রেস্তোরাঁ কর্মীরা দূরদূর করবে, ওরা জলজলে চোখে তাকাতেই থাকবে, প্রতিদিন। এখন মস্ত ফাঁকা উদ্যানে একদল শিক্ষার্থী, ভবঘুরে, উচ্ছন্নে যাওয়া পার্টি সোল্লাসে যে গাঁজা, আফিম, ভাং খেয়ে ধোয়া ছাড়ছে তখন তারা রেস্তোরাঁর সুন্দর পরিবেশে হাওয়া খাবে ও ধোয়া ছাড়বে। এর বেশি আর কী হবে?

বিকেলগুলো বদলে যাবে। যেমন বদলেছে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে। যে বিকেলে এসেছিলো লোহার শ্রমিক, প্রদীপ্ত যুবক, উলঙ্গ কৃষক আর পাতা কুড়ানীরা দলবেঁধে সে বিকেল এখন নুইয়ে পরেছে তন্দ্রাচ্ছন্নতার ভারে।এখনকার বিকেলে গাছের আড়ালে গাঁজা, ফেন্সিডিল, হিরোইনের মেলা বসে। এরপরে বসবে রেস্তোরাঁর অভিজাত মেলা। এখন বিকেলগুলো রেস্তোরাঁয় বসে বসে খাবে৷

আমরা অনেকেই জানি না ‘চিপকো আন্দোলন’ এর কথা। চিপকো অর্থ ‘আলিঙ্গন’। এই সেদিনের কথা। ১৯৭৩ সালের এপ্রিল। ভারতের উত্তরখন্ডের হিমালয় পর্বতের আলোকানন্দ উপত্যকার চামোলি অঞ্চলের একটি ছোট্ট গ্রাম মন্ডল। বিদেশি ক্রিয়া সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক কোম্পানির গাছ কাটার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল গ্রামের সাধারণ জনগণ। এই গ্রামের সমাজকর্মী চন্ডী প্রসাদ ভট্ট গ্রামের সাধারণ নারীদের সঙ্গে নিয়ে বনের গাছ আলিঙ্গন করে ধরে রাখার মাধ্যমে এই অভিনব প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তারা ঘন্টার পর ঘন্টা এক একটা গাছকে আলিঙ্গন করে দাঁড়িয়ে থাকতেন। এই আন্দোলন সহসাই ছড়িয়ে পড়ে৷ সর্বস্তরের নারীরা এসে যোগ দেয় এই আন্দোলনে। পরবর্তীতে এই প্রতিবাদ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। তাদের এই অহিংস আন্দোলনের ফলে বেঁচে যায় হাজার হাজার বৃক্ষ।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্ক, চন্দ্রিমা উদ্যানের মত ঐতিহাসিক স্থানগুলো দেশের ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বলা বাহুল্য, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে ঢাকার ফুসফুস বলে অভিহিত করা হয়। ঐতিহাসিক স্থানগুলো দেশ, প্রজন্ম ও স্বাধীনতার জন্য অক্ষুণ্ণ রাখার কোনো বিকল্পই নেই। রেস্তোরাঁ ও পার্কিং এর বদলে জায়গাগুলো সংরক্ষণের দাবিদার।
আর বৃক্ষ? এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও যদি বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা ও আমাদের করণীয় নিয়ে এরকম খামখেয়ালিপনার আধিপত্য থাকে তাহলে বুঝতে হবে বৃক্ষ নিধনের সাথে সংশ্লিষ্টরা বৃক্ষ নিধনের নামে প্রাণ নিধন করছে। জগদীশ কুমারের মতে, ‘গাছ কাটা যেনো আপনার নখ কাটা নয়, গাছ কাটা আপনার শ্বাস কাটানো’। আর তারা জেনেবুঝে দেশের মানুষের শ্বাস কাটতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশ দূষিত ও বাস অযোগ্য দেশগুলোর একেবারেই শীর্ষে তা আমাদের কারো অজানা নয়। অন্যান্য কিছু দেশ বাংলাদেশের অভিবাসী, শিক্ষার্থী ও কর্মীদের জন্য অভিগমন থেকে শুরু করে সবকিছু বন্ধ ঘোষণা করেছে। ছোটবেলায় প্যারিসের এক ভ্রমণ গদ্যে পড়েছিলাম ‘বাঙালি ঘুমকাতুরে, অলস ও ভোজনবিলাসি জাতি’। তখন সেই ছোট্ট মনে অজান্তেই দেশমাতৃকার জন্য ভালোবাসা অনুভব করি৷ মন খারাপ হয়েছিলো এই ভ্রমণ কাহিনি পড়ে। আমি জানি না, সেই লেখক এখন ভ্রমণ কাহিনি লিখলে বাঙালি নিয়ে কি লিখতেন!

খাদ্যরসিক জাতির খাদ্যই মনন ও সংস্কৃতি চর্চার আঁধার৷ অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘ কোথাও গেলে আগে দেখতে হবে সে জাতি কী খায় আর কী পড়ে’। আমরা পড়াশোনার বারান্দাতেও যাই না, খাদ্যের ম-ম গন্ধে বেহুঁশ হয়ে থাকি।
চিপকো আন্দোলন সফল হয়েছিলো। এই দেশের কোন আন্দোলন সফল হয় আর কোন আন্দোলন মাঠে মারা যায় তা জনগণকে বুঝিয়ে বলার মত কিছু নেই। তাই বলছি, শুধু সরকার আর সরকারী কাজের দিকে না তাকিয়ে আমাদের সামাজিক ও ব্যক্তি উদ্যোগ বেশি বেশি গ্রহণ করতে হবে। যে গাছ আপনি কাটছেন শুধুমাত্র সে গাছটি থেকেই আপনার অক্সিজেন সরবরাহ হতো। গাছ কাটার আগে নিজের অক্সিজেন সরবরাহের উৎস নিশ্চিত করুন।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বৃক্ষ নিধন একটি আদর্শ হোক এই মুহূর্ত থেকে আমাদের৷ সুন্দরবন উজাড় হয়ে যাচ্ছে দ্রুত, আগুনে পুড়ে যাচ্ছে বিভিন্ন বন। মিথেন গ্যাসের প্রকোপ বাড়ছে, লু হাওয়ায় ফসলি জমি বিনষ্ট হচ্ছে। তাপমাত্রার বৃদ্ধি, বছর জুড়ে অনাবৃষ্টি। আজ থেকে আসুন একটি করে গাছ লাগাই, সবুজময় করি সৃষ্টি।
ভেতরের কষ্ট জগদীশের মতোই। ভালো লাগল। ছবিগুলোর ঠিকঠাক সংযুক্তি পাঠকে আরও দৃশ্যমান করেছে। অভিনন্দন, লেখক।
ধন্যবাদ পাঠক, আমার মনোঃকষ্ট বুঝেছেন। এই কষ্টটা এই গাছ কাটা এই অপরিমেয় ক্ষতি তো আমাদের সবার। তাই চেষ্টা করেছি যদি বৃক্ষ কর্তন বন্ধও না করা যায়, আমরা যেনো অন্তত গাছ লাগানো বাড়াই।
গাছ কাটা বন্ধ করুন, আসুন আরো গাছ লাগাই।
ব্যক্তি ও সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে বেশি বেশি।