‘গ্রাম’: কেবল দু’অক্ষরের কোনো শব্দ নয়

আমি কখনোই সাঁতার জানতাম না। কলাগাছ কেটে দেয়া হত, সেটা ধরেই রোজ ভেসে থাকতাম অন্তত ঘণ্টাখানেক, আর এই পুরোটা সময় জুড়ে পুকুরঘাটে বসে থাকতেন একজন বৃদ্ধা; তাঁর চাহনির মত কোমল, তাঁর মুখের মত মায়াবী, আর তাঁর বলা গল্পের মতই সাধারণ এক অঞ্চলের দৃশ্য আমার হৃদয়ে জমা আছে; যার নাম ‘কাফিলাতলী’, আমার গ্রাম। আর সেই মানুষটি আমার দাদী, যাঁর শেকড়ে হেঁটে এই ছোট্ট জীবনে যুক্ত হয়েছে গ্রামের বাড়ি নামক সুবাশিত অধ্যায়।
এই গ্রামেই আমার জন্ম, এখানেই প্রথম গুটি গুটি পায়ে হাঁটতে শেখা, কথা বলতে শেখা, অথচ মাত্র চার বছর বয়সেই পাড়ি জমিয়েছিলাম মূল জেলা শহরে, তবুও প্রতি শুক্রবার আমরা গ্রামে যেতাম, সপ্তাহের এই একটি দিনের জন্য আমি মুখিয়ে থাকতাম৷ আর ঈদের ছুটি, পূজোর ছুটি, গরমের ছুটি, শীতের ছুটি—এইসব নানা ছুটির সময় অনেক দিন থাকা যেত। এভাবেই আমার শৈশবের আনন্দঘন দিনগুলোকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়েছে গ্রামের স্মৃতি। তাই আজও ‘গ্রাম’ শব্দটি শুনলে একটি নামকেই সবচেয়ে আপন বলে মনে হয়, ‘কাফিলাতলী’।
লোকমুখে শোনা যায়, একসময় কাফিলা গাছের প্রাচুর্য ছিল এখানে, তাই গাছের নামেই রাখা হয়েছিল গ্রামের নাম।
খুব আলাদা করে দেবার মত বিশেষ কোনো বর্ণনা নেই, বরং চিরাচরিত গ্রাম-বাংলার যে রূপ মানুষের মনে আঁকা আছে এবং শিল্প-সাহিত্যে বারবার উঠে এসেছে, তেমনি এক গ্রাম আমাদের। অনেকটা বন্দে আলী মিয়ার দেয়া সহজ, সরল বর্ণনার মতো —
‘মাঠ ভরা ধান তার জল ভরা দিঘী,
চাঁদের কিরণ লেগে করে ঝিকিমিকি।
আমগাছ, জামগাছ, বাঁশ ঝাড় যেন,
মিলে মিশে আছে ওরা আত্মীয় হেন।
সকালে সোনার রবি পূব দিকে উঠে,
পাখি ডাকে বায়ু বয় নানা ফুল ফুটে।’

ঋতুচক্রে প্রকৃতির এইসব সৌন্দর্য চক্রাকারে পাক খায়, আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাক খায় কৃষিনির্ভর গ্রামের জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাস। অবশ্য ইদানীংকালে কৃষিবিদ, ব্যাংকার, শিক্ষক, ব্যবসায়ী ও প্রবাসীসহ নানা পেশাজীবী মানুষের সংখ্যাও কম নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের প্রাক্তন ডিন ড. মো. হাবিব উল্ল্যা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহিবুল আজিজ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানিবিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মাশফিকুর সালেহীন প্রমুখ বুদ্ধিজীবীদেরও অঙ্কুরোদগম হয়েছিল এখানেই।
আমার এখনো মনে পড়ে, গরমের দিনে বিলের দিকে অনেক বাতাস পাওয়া যেত। চলে যেতাম দলবেঁধে। মহিলারা সেলাইয়ের ফোঁড়ে ফোঁড়ে গল্প বুনতেন, আমরা ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ছুটে বেড়াতাম, আর দক্ষিণা বাতাসে হেলে দুলে উঠত নারিকেল সুপারি বন।
বর্ষায় পুকুরে জাল ফেলা হতো, তার চারপাশ ঘিরে আমাদের ভাইবোনদের সে কী মাতামাতি, একটা দু’টো পোনা মাছ হাতে পেলেই সে কী আনন্দ! বৃষ্টিতে ভেজা বা কাদার মধ্যে পিচ্ছিল খেয়ে কে কত দূর যেতে পারে এসব খেলাও খুব জমত।

আবার শীতের সকালে দাদী ভাপা পিঠা বানাতেন, তাঁর চারপাশে সবাই ঘিরে বসে থাকতাম। চলত গরম গরম পিঠা খাওয়া আর আগুন পোহানো। আমার দাদা ছিলেন প্যারালাইজড। আমরা বাড়ি গেলেই প্রথম সাক্ষাতে তিনি অঝোরে কাঁদতেন। তাঁর সুস্থ অবস্থার কোন স্মৃতি আমার মনে নেই, তবে শুনেছি যৌবনে তিনি অনেক তেজদীপ্ত মানুষ ছিলেন। যাইহোক, সকালের মৃদু রোদ উঠলেই তাঁকে রোদে পিঠ ফিরিয়ে বসিয়ে দেয়া হত; হাত নেড়ে নেড়ে কতকিছুই যে বলতেন আমার দাদাজান, সেসবের কিছুই বোঝা যেত না!
আরেকটি বিষয় না বললেই নয়, তা হলো গ্রামের খাবার। দাদীর হাতে কাঁঠালের বিচির ভর্তা ও পান্তা ভাত অথবা চালের গুঁড়ার রুটি ও গরুর মাংস ভুনার স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে৷ আসলে মাটির চুলায় ধোঁয়া তুলে যে রান্না হয় তার স্বাদের কাছে আর বাকিসব নস্যি। অবশ্য রান্নার উপকরণগুলোও ছিল একেবারে নিজস্ব, এই যেমন, প্রতিবছর উঠত খেতের ধান, গোয়ালে ছিল গরু, পুকুর ভরা মাছ, খড় ভর্তি রোজ পাওয়া যেত পালা হাঁস-মুরগির ডিম। আমি নিজে কখনো ঢেঁকি দেখিনি, কিন্তু দাদীর কাছে শুনেছি ঢেঁকিতে ধান ভানা, চিঁড়া দোকা আর চাল গুঁড়ো করার গল্প। রাতের রান্না শেষে আগুন নিভিয়ে ফেলার পর মাটির চুলায় ভেতরের গণগণে ছাইয়ের ভেতর ফেলে যে মিষ্টি আলু পোড়ানো হত, তা ছিল আমার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ।
গ্রামের দুই কোণে দু’টো বাজার বসে। বড়টি হল ‘কাফিলাতলী বাজার’, প্রতি বুধ ও শনিবারে বসে। এই কাফিলাতলী বাজারেই বটগাছের তলে নববর্ষের বিশাল উৎসব হয় প্রতিবছর, আবার প্রতি ঈদেও বসে ঈদের হাট। প্রায় ৮৫ শতাংশ মুসলমান আর প্রায় ১৫ শতাংশ সনাতন ধর্মাবলম্বী উভয়েই শান্তিতে সহাবস্থান করে; আর ভাগ করে নেয় উৎসবের আমেজ৷

ঈদের ছুটিতে চাচারা, ভাই-বোনেরা সবাই বাড়ি আসত। একসঙ্গে এত মানুষ পাত পেড়ে খাওয়া আর এক বিছানায় গাদাগাদি করে ঘুমানো; সবাই একত্র হলে ঈদের আগেই যেন ঈদের আমেজ শুরু হয়ে যেত। এরপর সবাই দলবেঁধে ঈদের চাঁদ দেখা, বাজির শব্দ, দু’হাত ভরে মেহেদি পরা, আর রাতভর ঘুমঘোরে সেই মেহেদি নিজের ও ভাইবোনদের গালে-মুখে লেপ্টে দেয়া এবং সকালে চোখ খুলেই কার হাতে কতটা রঙ হল তা দেখা, তারপর গোসল করে ঈদের সেমাই আর নাস্তা খেয়ে আমরা বোনেরা সাজতে বসতাম আর ভাইয়েরা যেত নামাজে; ভাইয়েরা ফিরলে সবাই একত্রে যেতাম ঈদের বাজারে, সেখান থেকে সারা গ্রাম-বন-জঙ্গল সব চষে বেড়িয়ে, পাশের দুই গ্রামে দুই ফুপুর সঙ্গে দেখা করে বেলা পড়লে তবেই ফিরতাম। এইসব দিন এত আশ্চর্য সুন্দর ছিল, হারিয়ে গেছে ভাবতেই বুকটা কেমন ফাঁকা হয়ে যায়!
আরেকটি যে ছোট বাজার আছে তার নাম ‘মন্ডলতলী’, এটি প্রতি বৃহস্পতি ও রবিবারে বসে। এই মন্ডলতলী বাজার ও গ্রামের একমাত্র প্রাইমারি স্কুলেই প্রথম এসেছিল টেলিভিশন। বাবার কাছে শুনেছি, এর আগে এই বাজারের কাছেই বাংলাবাজার নামক স্থানে আমার পূর্বপুরুষের দান করা জমিতেই প্রতিদিন সন্ধ্যায় ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’, ‘ভিখারির ছেলে’ ইত্যাদি নাটক অথবা ‘রহিম-রুপবান’, ‘সাগর বাদশাহ’, ‘গুণাইবিবি’ ইত্যাদি যাত্রাপালার রিহার্সাল ও মঞ্চায়ন হত। তারও আগে গ্রামে পুঁথিপাঠ হত, দাদীর কাছে শুনেছি সেসব, ‘কমলার বনবাস’, ‘বেহুলা-লক্ষ্মীন্দর’ ইত্যাদি সব দুঃখের কাহিনি বলতে বলতে তিনি নিজেই কেঁদে ফেলতেন।
একসময় কাঁচারী ঘরে ছেলে মেয়েরা আরবি পড়ত, এখনো সেইসব পরিত্যক্ত কাঁচারি ঘরের কিছু কিছু রয়ে গেছে। এছাড়া একটি পুরাতন জমিদার বাড়ি আছে; সেটি অবশ্য বর্তমানে একজন প্রয়াত চেয়ারম্যানের পরিবার বসতবাড়ি হিসেবে ব্যবহার করছে।

আমাদের গ্রামের মানুষেরা বেশ সাহসী আর লড়াকু ধরনের। অনেক বছর আগে এক নারীর একাই সাতজন ডাকাতের সঙ্গে লড়াই করে তাদের কাবু করার কাহিনি শোনা যায়। সেইসময় এইদিকের গ্রামে গ্রামে রটে গিয়েছিল এক শ্লোক,
‘সাবাশ বালিকা, চমৎকার,
সাত ডাকাত, এক সর্দার।’
সেই নারী ছিলেন আমার বড়মা, দাদী খুব গর্বের সঙ্গে তাঁর মায়ের গল্প করতেন।

লক্ষ্মীপুর জেলার, সদর উপজেলার প্রথম মুক্তিযুদ্ধও শুরু হয় আমাদের গ্রামে, ১৯৭১সালের মে মাসে। পাশ্ববর্তী উত্তরের ‘মিরগঞ্জ’ ও দক্ষিণের ‘কাজিরদীঘির পাড়ে’ ছিল মিলিটারি ক্যাম্প, দু’ক্যাম্পের মধ্যবর্তী কাফিলাতলী তাই সয়েছে নির্মম অত্যাচার, আবার গড়েছে অত্র অঞ্চলের প্রথম প্রতিরোধও৷ সেই মে মাসেই তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, পাঁচজন আহত হন, তিনজন সাধারণ মানুষের প্রাণ যায়, আর পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকারসহ মরে ৫০ জন, অন্তত ১০০ ঘরবাড়ি আগুনে পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়। আমার এক দাদু (বাবার চাচা) আবুল কালাম, পরেশ চন্দ্র দেবনাথ, খোকন চন্দ্র দেবনাথ প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধারা সেইসময় ব্যাপক সাহসিকতার পরিচয় দেয়। মন্ডলতলী বাজারে আজও আছে এক পরিবারের একমাত্র যক্ষের ধন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ইসমাইল এর সমাধি। মুক্তিযুদ্ধের সেই সময়টাতে আমার অন্তঃসত্ত্বা দাদী পালিয়ে বেড়িয়ে, কত আতঙ্কে আর ভোগান্তিতে দিন কাটিয়েছেন সেসব গল্পও করতেন৷
এখন বড় হয়েছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি৷ ব্যস্ততা বেড়েছে; গ্রামে এখন কম যাওয়া হয়। মেঠো পথ এখন পিচঢালা পথ হয়েছে, ছোট ছোট ঘর আর উঠোন মিলিয়ে বড় বড় বিল্ডিং উঠেছে, বাঁশ-কাঠের পুকুরঘাট এখন পাকা হয়েছে, হারিকেন- কুপির পাঠ চুকিয়ে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ- মোবাইলফোন- টেলিভিশন- ফ্রিজ সবই এসেছে; এসব ভালো খবর, উন্নয়ণের খবর কিন্তু কোথায় যেন একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে মানুষে মানুষে, কী করে যেন আত্মকেন্দ্রিকতা ঢুকে পড়েছে সুঁচ হয়ে, ‘আমাদের’ শব্দটা ভেঙে গিয়ে কেমন যেন ‘আমার’ কিংবা ‘তোমার’ হিসাব নিকাশ ঢুকে পড়েছে।

তবুও ক্ষয়ে সয়ে যতটুকু আছে বাকি,
তার দিকেই স্নেহতৃষ্ণায় চেয়ে থাকি।
তাই এখনো নাড়ীর টানে ছুটে যাই সুপ্রাচীন মমতার আহ্বানে,
এখনো বিলের ধারে গিয়ে দাঁড়ালে দক্ষিণা বাতাস গায়ে লাগে,
খেতের আইল ধরে ধরে হেঁটে বেড়ায় স্মৃতিরা।

দাদার পর আমার গল্প বলা দাদীও জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার শূন্য করে দিয়ে চলে গেছেন, ভিটা ছেড়ে বাংলাবাজারের কবরস্থানে আবার জোড় বেঁধেছেন তারা। ছয়জন কাকার তিনজনই একে একে চলে গেছেন না ফেরার দেশে! এইসব ভাবতে বড় হয়রান লাগে, কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!
মাহাজাবিন সাওদা জাহান : শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
‘আমার প্রিয় গ্রাম’ নিয়ে লিখুন
আপনি আপনার প্রিয় গ্রামকে নিয়ে আমাদের কাছে লিখুন। সঙ্গে পাঠাবেন গ্রামের একাধিক ছবি ও আপনার পরিচতি। সর্বনিম্ম ৩০০ শব্দে লিখে ফেলুন আপনার গ্রামের যা যা আছে, বেড়ে ওঠা, গ্রামকে নিয়ে স্মৃতি, স্বপ্ন, গ্রামে মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, ইতিহাস-ঐতিহ্য স্থাপনাসহ নানা বিষয়— এই সব নিয়ে চটজলদি লিখে আমাদের ইমেইল করুন। ইমেইল : boicharita@gmail.com