আমার প্রিয় আদাম ‘নাঙ্গেল পাড়া’

আদাম বললে মনের ভিতরে অভাবনীয়, অফুরন্ত ভালোলাগা কাজ করে। আপনারা হয়তো ভাবছেন যে, ‘আদাম’ আবার কি শব্দ! তাই না? একদম ঠিক তাই,আদাম শব্দের অর্থ হলো গ্রাম। আমরা (চাকমা’রা) গ্রামকেই আদাম বলি।
আমাদের সবারই গ্রাম থাকে। আলাদা -আলাদা গ্রামে রয়েছে আলাদা বৈশিষ্ট্য। মানব সৃষ্টির সূচনা থেকেই মানব সভ্যতার উৎপত্তি। ধর্মীয় বিধিবিধান, ভৌগলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক পরিবেশ ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে মানব সভ্যতা গড়ে ওঠে।
আমাদের আদামের নাম নাঙ্গেল পাড়া। রাঙামাটি জেলার ৪৫ কি.মি উত্তরে নানিয়ারচর উপজেলার বুড়িঘাট ইউনিয়নের চেঙ্গি নদীর ধারে আদামটি অবস্থিত। আবার এ চেঙ্গি নদীর পানি মিশেশে কাপ্তাই লেকে।১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ দেওয়া হয়। কাপ্তাই লেক বাংলাদেশে, এমন কি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম মানবসৃষ্ট স্বাদুপানির হ্রদ। প্রধানত জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এর সৃষ্টি হলেও, এ জলাধারে প্রচুর পরিমাণে মিঠাপানির মাছ চাষ হয়। নৌবিহার, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও কৃষি আবাদ ইত্যাদিতেও এর অবদান উল্লেখযোগ্য। পার্বত্য চট্টগ্রামের কাপ্তাইয়ের কর্ণফুলি নদীতে বাঁধ দেওয়ার কারণে জলাধারটি গড়ে ওঠে। মূল লেকের আয়তন প্রায় ১,৭২২ বর্গ কিমি, তবে আশপাশের আরও প্রায় ৭৭৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকাও প্লাবিত হয়েছে। মূলত রাঙ্গামাটি জেলাতেই জলাধারটি সীমিত যার অন্তর্ভুক্ত উপজেলাসমূহ হচ্ছে রাঙ্গামাটি সদর, কাপ্তাই, নানিয়ারচর, লংগদু, বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি।

ধারণা করা হয় অন্ত্য মধ্যযুগে (১৫০০-১৮০০) আমাদের গ্রামের উৎপত্তি। সেই সময়কার গ্রামটি কাপ্তাই লেকে তলিয়ে যাওয়ার কারণে তখনকার গ্রামবাসীরা উঁচু পাহাড়ে নামেহং নামক স্থানে বসতি গড়ে তোলে।বিবর্তনের স্রোতধারায় নামটিকে বিকৃত করে নাম দেওয়া হয়েছে নাঙ্গেল পাড়া। আমরা যারা পাহাড়ে বাস করি একমাত্র তারাই অনুভব করি চাপিয়ে দেওয়া নামের কষ্ট। নামেহং মূলত পাহাড় থেকে বেয়ে আসা ঝিরি’র নাম হলো এটি যা চেঙ্গির পানিতে মিশেশে। আমাদের আদামটি ছবির মতোই চমৎকার কারণ প্রকৃতির সুবিশাল মোনের (পর্বতের) পাদদেশে চেঙ্গি নদীর গাঁ ঘেষে মোনের পাদদেশে অবস্থিত। আদামে মোট ১০৭ পরিবারের বসবাস। লোকসংখ্যা ৫০০। আদামে একটি বৌদ্ধ মন্দির আছে যা ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৯৭ সালে একটি ইউনিসেফ সহযোগিতায় বিদ্যালয় আছে, যেটি ১৯৯৯ সাল থেকে কমিউনিটি ক্লিনিকের আওতায় স্বাস্থ্যসেবাও প্রদান করে আসছে। তবে বিদ্যালয়টিতে শুধুমাত্র ৩-৫ বছর বয়সী শিশুদের পাঠদান করানো হয়।

জনপদের লোকেরা মূলত জুমচাষের উপর নির্ভরশীল, জুমে ধান, আদা, হলুদ ইত্যাদির চাষ করা হয়, নারীরাও গৃহস্থালি কাজের ফাঁকে শাক-সবজি চাষ করে, কোমড় তাঁতও বুনন করে পাশাপাশি আনারস, কলা, জাম্বুরা ইত্যাদি বাগান করে তবে নদীতে মাছ আহরণ করে অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করে তবে সবাই স্ব-শিক্ষিত। বয়োবৃদ্ধরাও চাকমা হরফে(বর্ণমালা) এবং ইংরেজি পড়তে জানে কারণ পাকিস্তান আমলে লেখাপড়া করেছে।
চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ২৫-২৭ একরের মতো তবে সব জমি ভাসমান। ধানের তেমন ভালো ফলন হয়না আর ফলন হলেও বর্ষাকালে সব জমি পানিতে তলিয়ে যায়। কাপ্তাই লেকে মাছ আহরণ করে অথবা বর্গাচাষ করে বছরের ধান সঞ্চিত করে রাখে। এমনও দিন আসে, পাকা ধানের জমি চোখের পলকেই পানি ডুবিয়ে নিয়ে চলে যায়। তবুও হাসিমুখে প্রকৃতির সাথে লড়াই করে মূলত দিনাতিপাত করছে আদামবাসী।তবে গ্রীষ্মকালে পানি শুকিয়ে গেলে যাতায়াত কষ্টকর হয়। চেঙ্গির গতিপথ তখন পাল্টে যায়। চৈত্র মাসের তপ্তরৌদ্র চেঙ্গিকে নিষ্ক্রিয় করার প্রাণপণ চেষ্টা চালায়। মানুষজন নৌকা, বোট দিয়ে চলাচল করে। আমাদের আদামে কোনো হাট বসে না হাট-বাজারের জন্য উপজেলায়, নৌপথে যেতে হয়। উপজেলা থেকে আমাদের আদামের দূরত্ব নৌপথে ৬ কিলোমিটার তবে স্থলপথে ১৪ মাইলেরও বেশি হবে। আদামে ৩টি দোকান আছে। তবে ফল/ফলাদি বিক্রির মৌসুম হলে জেলা শহরে প্রতিদিন ৪৩ কিলোমিটার বোট নিয়ে পাড়ি জমায় বিক্রির জন্য।

ছোটবেলায় দাদুর মুখে শুনেছি আবহমানকাল থেকেই এক আদামের মানুষের সাথে আরেক আদামের সখ্যতা অনেক। অনেকেই নাকি এমনও বলেন যে, অমুক আদামের লোকেরা খুবই অতিথিপরায়ণ। যুগ-যুগান্তর ধরে চলে আসা রীতি, আতিথেয়তা এখনো বিদ্যমান। পাহাড়ে আমাদের চৈত্র সংক্রান্তি উদযাপন করা হয়। আমরা বিজু বলি।
১৪২৭ বঙ্গাব্দের শেষে মানে ১৪২৮ বঙ্গাব্দের আগমনে আমাদের বিজু উৎসব হয়। বিজু আদিকাল থেকেই চলে আসছে। বিজুর প্রতি আলাদা একটা বিশ্বাস কাজ করে। চৈত্র মাসের শেষদিনকে চাকমারা বলে মূলবিজু । এর আগের দিনকে ফুলবিজু বলা হয় এবং বিজুর পরের দিনকে গোজ্জেপজ্জ্যা(নতুন বছর) বলে। এদিন কেউ কোনোদিন কাজ না করে এবং দুপরেও না ঘুমিয়ে বাড়িতে বা পাড়ায় ঘুরে বেড়িয়ে দিন পার করে। আজুদের(দাদুদের) কাছ থেকে শুনেছি যে বিজুর দিন ঘুমালে নাকি পরজন্মে শুকর হয়ে জন্ম নিতে হয়। ফুলবিজুর দিনে খুব ভোরে উঠে ফুল তুলে নদীতে ভাসিয়ে দিই। সারা বছরের সব দুঃখ-কষ্ট কে ভুলে গিয়ে নব উদ্যমে বছর শুরু করার প্রত্যয় নিয়ে আমরা প্রার্থনা করি।এর পর শুরু হয় বিজুর ধুম। বিজুর আমেজ শুধু আমাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। এদিন আমরা বাড়ি-বাড়ি গিয়ে গৃহপালিত পশু-পাখিদের খাবার দিয়ে থাকি বিশেষ করে হাঁস-মুরগিদের আমরা ধান খেতে দিই। নদীতে ফুল ভাসানোর পরে আমরা ঘর সাজিয়ে থাকি হরেক রকমের ফুলে-ফুলে। তারপরেই আমরা আদামের(গ্রামের) বৃদ্ধদের স্নান করিয়ে দিই।এতে আমাদের বন্ধন দৃঢ় এবং অশেষ পূণ্য সঞ্চিত হয় বলে জানি।

তারপর দিন মূল বিজু। মূল বিজুর দিনে আমাদের প্রধান আকর্ষণ হলো পাজন। পাজন মূলত অনেক রকমের মিশ্রনে তৈরি করা সবজি তরকারি। আমরা ৩২ রকমের সবজি দিয়ে এটি রান্না করি। বিজুর দিন অবশ্যই সাত ঘরের পাজন খাওয়া বাধ্যতামূলক। প্রচলিত আছে সাতঘরের পাজন খেলে নাকি কোনো অসুখ আমাদের আক্রমণ করতে পারে না বলে আমরা যুগ যুগ ধরেই বিশ্বাস করে আসছি। বিজু’র দিনে আমরা সবার বাড়ি যায় কারণ বিজুর দিন কেউ কাউকে নিমন্ত্রণ করে না যদিও আজকাল নিমন্ত্রণের রীতিও চলে আসছে। একে-অপরের বাড়িতে বেড়ানোর ফলে আমাদের সম্পর্ক গভীর হয়। মূলত বিজু আমাদেরকে সামাজিক হওয়ার প্রেরণা যোগায়। এদিন পাজনের পাশাপাশি চাউলের পিঠা বানায়, বরাপিঠা(বিন্নি চাউলের) , কলাপিঠা(কলা,নারকেল,চাউলের মিশ্রণে),সান্যে পিঠা(চাউল,গুড়/চিনি,নারকেলের), আর পানীয়স্বরূপ জগরা তৈরি করে। জগরা মূলত বিনি চাউলের তৈরি পানীয়। এটা শুধু বিজুর দিনেই পরিবেশন করা হয় এবং বিজুর জন্য বিশেষ পানীয় হিসেবে বানানো হয়। বিজুর একমাস আগে থেকেই একটা কলস/ পাতিলের মুখ বেঁধে রাখে। একমাস পরে ফুল বিজুর দিন জগরার কলসি/পাতিলের মুখ খোলা হয়।তারপরে জগরা ঢেলে পরিবেশন করা হয়। সামান্য মিষ্টি। তবে ঠান্ডা নয়। শুধুমাত্র বিজুর জন্য বিশেষ পানীয় হিসেবে বানানো হয় বলেই এর আকর্ষণ অনেক বেশি। তবে, জগরা’কে চাকমা সমাজে মাদক হিসেবে গণ্য করে না। এটি বিজুর বিশেষ পানীয় হিসেবেই সৌষ্ঠবপূর্ণ !

এরপরে গোজ্জে-পজ্জ্যা। মানে নতুন বছর (পহেলা বৈশাখ)। এদিন সবাই বিহারে গিয়ে সকল জীবের প্রতি মৈত্রী ও মঙ্গল কামনা করে। এবং কী বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজাও করে। আবার কেউবা ঘরে ভান্তে (ধর্মীয় গুরু) নিয়ে এসে মঙ্গলসূত্র শ্রবণ করে পারিবারিক হিতসুখ মঙ্গলার্থে। এইদিন নতুন চালের ভাত, মাছ-মাংস দিয়ে ভোজন সেরে নেয়। বিশ্বাস করা হয়, উক্তদিনে যদি ভোজন ভালো হয় তাহলে পুরো বছরের ভোজন কোনো রকমের কমতি হবে না।
এই তিনদিন সন্ধ্যায় ঘরের মূল খুঁটির সামনে, নদী এবং গৃহপালিত পশু-পাখিদের সামনে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করা হয়।
পূর্ণা চাকমা, শিক্ষার্থী,রাঙামাটি সরকারি কলেজ।
পাহাড়ি গ্রাম সম্পর্কে সামান্যই জানতাম। খুব ভালো লাগলো। লেখক ও বইচারিতা কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই।