কাওয়ালদিয়ার কথা

আমি তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। হ্যাফ প্যান্ট পরার বয়স। আমরা দুই ভাই মানিক জোড়ের মতো টো টো করে কাওয়ালদিয়া গ্রাম দিয়ে ঘুরে বেড়াতাম, আমাদের বোনটা তখনও পৃথিবীর মুখ দেখে নাই। দাদু বাড়ি আর মামা বাড়ির আদরে আদরে বড় হচ্ছি। নানু প্রায়ই আমাদের দুই ভাইয়ের মাথায় হাতবুলিয়ে বলতেন-‘আমার হাসান, হুসাইন’! কথাটা শুনে আমরা দুই ভাই একে অপরের দিকে ঘুরে তাকিয়ে মুখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন তুলতাম। নানু আমাদের হাসান, হুসাইন কেন বলেন? আমাদের নাম তো এটা নয়। এখন বুঝতে পারি তিনি কেন আমাদের ওই নাম ধরে ডাকতেন। আমাদের প্রিয় নবী রাসুল (সা.) এর দৌহিত্র কারবালায় শহীদ হাসান (রা.) এবং হুসাইন (রা.) এর নাম ধরে নানু আমাদের আদর করতেন। এখনও টের পাই নানুর সেই আদর এখনও আমাদের শরীরে আঠার মতো লেগে আছে।
আমাদের গ্রামের নাম কাওয়ালদিয়া।১৯৮৪ সালের কথা। এদেশের অন্য দশটি সাধারণ গ্রামের মতো এটাও একটি। গ্রামের দুই পাশে মস্ত বড় দুটি বিল। বর্ষাকালে বিল দুটিতে পানিতে থৈ থৈ করে। পদ্ম এবং সাদা শাপলায় ভরে যায় উদার জলাশয়। কৈ মাছের জন্য বিখ্যাত সে বিলে জলডুব আর শাপলা, শালুক তুলেই আমাদের আনন্দের শৈশব কেটেছে। কাওয়ালদিয়ার মতো আদি গ্রামে তখনও নগরের ছোঁয়া লাগে নাই। প্লাস্টিকের তৈরি জিনিসপত্র তখনও হাট-বাজার এবং গ্রামীণ মেলাকে গলা টিপে ধরতে পারে নাই। তখন ওই জনপদের মানুষের একরত্তি আনন্দ ছিল হাট বাজার এবং মেলাকে কেন্দ্র করে।
সারা বছর অপেক্ষায় থাকতাম কবে মেলা আসবে। কাঁটাগড়ের মেলা, দূর্গাপুরের মেলা, বুড়িমার গাছতলার মেলা, জলির পড়ের নৌকাবাইচ, হাজিরবাগের ঘোড়া দৌড়, সাঈদ ফকিরের মেলা, পাউচা ফকিরের মেলা কত যে মজার মজার নাম। এসব মেলায় গিয়ে অতি সহজে কিনে নিতাম-আম কাটার হাড়ের চাক্কু, টমটম, মাটির খেলনা সাথে কদমা, বাতাসা, মটকা, মনাক্কা, গুড়ের জিলাপিসহ আরও কত মজাদার খাবার।
শরতের এক বিকেলে মা চাউল কুটতে বসলেন। ঢেকি পারের শব্দে সমস্ত বাড়িতে আমোদ লেগে গেল। নানু আর মেঝ খালা বেড়াতে আসলেন। এসেই তারা পিঠাবানাতে বসে গেলেন। পকান পিঠা, দুধ চিতই, পাটিসাপ্টা, কুলি পিঠা কত সে পিঠার বাহার। আমরা দুই ভাই দুইখান গরম চিতই হাতে নিয়ে দৌড়ে গেলাম পুকুর পাড়ে। গরম পিঠায় ফুঁ দিতে দিতে চোখ গেল- বড় বিলের দিকে। দেখি সমস্ত বিল সাদা শাপলায় ধবল দুধের আকার ধারণ করেছে। বিলের শোভা দেখে উষ্ণ হয়ে ওঠি, আমার সমস্ত শরীর যেন অবস হয়ে যায়।

আমার ডানপিটে স্বভাবের ভাইটার তখন দুধের বয়স। হঠাৎ তার শরীরে জলবসন্ত দেখা দিল। বাবা তখন চট্টগ্রাম সেনানিবাসে কর্মরত মা আর আমি খানিকটা আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম। গ্রামের মানুষ নানা ধরণের উপদেশ দিতে লাগলেন। কেউ বলল বাতাস লাগছে- নূরা ফকিরের কাছে নিয়ে যাও। কেউ বললেন ঘরের দরজায় নিমের ডাল বেঁধে রাখো। হলুদ পড়া, তেল পড়া, বেত পড়া চলল একের পর এক। বলুগার মলবিসাপ মাকে ডেকে বললেন- ‘এই যে তেল আর কাঁচা হলুদ পইড়া দিলাম সাত দিন পর এই হলুদ দিয়া ছাওয়ালরে গোসল করাইয়া দিবা, তারপর সমস্ত গতরে তেল পড়া লাগাইয়া দিবা। আর মনে করে কাঁঠালের দুইটা রোয়া খাওয়াইয়া দিও কিন্তু। আল্লাহর রহমতে পোলা তোমার ভালো হইয়া যাইবো মা। আর একটা কথা- কাঁঠালডা কিন্তু এক দামে কিনতে হবি’।
আমার চাচা পান্নু মাস্টার তখন বিয়ে পরীক্ষার্থী মাকে বলেন- ভাবি জলবসন্তের সঙ্গে কাঁঠালের কি সম্পর্ক বুঝলাম না। আপনি এই সব মাথায় নেবেন না। দরকার হলে ভাতিজাকে উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে যাব। ওর উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করব। আপনি এই সব তেলপানি সুতানাতা দিয়ে ছেলেডার ক্ষতি ডেকে আনবেন না। চাচার কথা শুনে নূরা ফকির এবং মসজিদের ইমাম নিজেদের মধ্যে বির বির করে কথা বলতে বলতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। ইমাম: কলি কাল আইসা গেছে। কিয়ামত কাছাই গেছে। এখন কোন মান্যিগন্নি নাই। আল্লাহর উপর ভরসা রাইখো মিয়ারা। অসুখ দিছেন যিনি শেফা ও দিবেন তিনি।
মা কোনো পত্যই বাদ রাখলেন না। কয়েক দিনের মধ্যে ভাই আমার সুস্থ হওয়ার পথে। আঙুলের কর গুনে বার হিসাব করে হাটে যাওয়ার উদ্দেশ্যে মা আমার জামার পকেটে একটি পঞ্চাশ টাকার লাল নোট গুজে দিলেন। বয়ঃসন্ধিকালে সেটাই আমার প্রথম একা একা হাটে যাওয়া। সূর্য যখন মাথার উপরে গ্রামের মানুষের সাথে আমিও হেঁটে চললাম কাঁচা মাটির রাস্তাধরে পুরাণ মুকসুদপুরের দিকে। উত্তেজনায় বেপারি বাড়ির বড় চার পার হতে কোনো সমস্যাই হলো না। বাওড়ের পাড় দিয়ে হেঁটে চলছি। সারি সারি পাটের জাগ। ছলোম আর লাটিম ফল পড়ে আছে মাটিতে। দৌড় দিয়ে একটি লাটিম ফল তুলে নিয়ে ইংলিশ প্যান্টের পকেটে ভরি। প্যান্টের অন্য পকেটটা ফুঁটো হাত দিতেই সুরসুরি লাগে। লজ্জায় এদিক ওদিক তাকাই। গাঁয়ের মানুষ জোর কদমে হাঁটে আমি তাদের পেছনে পেছনে দৌড়াই।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। মাঝারি সাইজের রসখাজা একটি কাঁঠাল মাথায় করে যখন বাড়ি ফিরছি তখন আকাশে মেঘ। হাটের মানুষ দ্রুত বাড়ি ফেরার জন্য বড় রাস্তা ছেড়ে দিয়ে মাঠের মধ্য দিয়ে কোনাকুনি হাঁটা শুরু করল। আমিও তাদের অনুসরণ করলাম। মাথায় কাঁঠাল, পরনে হাফপ্যান্ট, সার্টের বোতামগুলো সব খোলা, সবুজ ধান খেতের আলধরে হেঁটে চলছি বাড়ির দিকে। ঠিক যখন মাঝ মাঠে এসে পৌঁছালাম তখন মুসলধারে বৃষ্টি। পকেটে আমার হাট ফেরত একটি দশ টাকার নোট। মূহুর্তেই ভিজে একাকার হয়ে গেলাম। তীব্র বৃষ্টি। জলকাদায় পা ডেবে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকালে শিশুমনটা কেঁপে ওঠে বার বার। ভিজে একাকার হয়ে যখন বাড়িতে ফিরলাম- মা এক দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন। আঁচল দিয়ে মাথা মুছিয়ে ঘরে তুলে নিলেন। আমি তখন হাট জয় করে ফেরা বীর পুরুষ, গর্বে আমার বুকের পাটাতন উঠছে আর নামছে।
গাছতলার স্কুল থেকে প্রাথমিক শেষ করে এস জে স্কুলে মাধ্যমিকে ভর্তি হলাম। হ্যাফ প্যান্ট ছেড়ে ফুল প্যান্ট ধরলাম সঙ্গে যোগ হলো- একটি চায়না ফনিস্ক সাইকেল। সপ্তাহে ছয় দিন সাড়ে তিন কিলোমিটার কাঁচা মাটির রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যেতাম। সাইকেল ঘাড়ে করে কালিখোলার চার পার হওয়া, রমজান খাঁর জঙ্গল অতিক্রম করা ছিল প্রতিদিনের চ্যালেঞ্জ। বৃষ্টি নামলে আর রক্ষা নেই পায়ে হাঁটা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না তখন। গ্রামে কাঁচা মাটির রাস্তা, বিদ্যুৎ নেই, ভালো স্কুল নেই, ডাক্তার নেই, হাসপাতাল নেই, খেলার মাঠ নেই, বাজার নেই সব নেই আর নেই। সব নেই মধ্যে শুধু একটা জিনিস সবার মধ্যে বিরাজ করত সেটা হলো ভালোবাসা। শুধু এই ভালোবাসাকে বুকে নিয়ে শত শত বছর গ্রামে কাটিয়ে দিয়েছেন আমাদের আদি পিতামহরা। গ্রীষ্মের খরতাপে সাধের শরীর কয়লা করে তাঁরা ফলিয়েছেন সোনালি ফসল। তাদের দয়া এবং ভালোবাসাই তো এখনও আমরা মুখে ভাত খুঁজতে পারছি।

নয়ের দশকে আমাদের গ্রামটা আস্তে আস্তে ভাঙতে শুরু করল। আকাশ সংস্কৃতির কালো ছোবল এসে পড়ল গ্রামের পাড়ায় পাড়ায়। হিন্দিগানের খ্যামটা নাচ। ববকার্টি চুল, জিন্সের প্যান্ট আর চোস পাজামার স্টাইল আসল। জীবনযাত্রায়, কথাবার্তায়, পোশাক পরিধানে, এমন কি বাজারের ব্যাগেও পরিবর্তন দেখা দিল। পাটের তৈরি ব্যাগ আর মাছের খালোইয়ের পরিবর্তে হাতে উঠল পলিথিনের ব্যাগ। বাল্যশিক্ষা শেষ না হতেই গাঁয়ের ছেলে মেয়েরা গার্মেন্টসে চাকরির জন্য ঢাকায় পাড়ি জমাল।
নয়ের দশকে আমাদের গ্রামটা আস্তে আস্তে ভাঙতে শুরু করল। আকাশ সংস্কৃতির কালো ছোবল এসে পড়ল গ্রামের পাড়ায় পাড়ায়। হিন্দিগানের খ্যামটা নাচ। ববকার্টি চুল, জিন্সের প্যান্ট আর চোস পাজামার স্টাইল আসল। জীবনযাত্রায়, কথাবার্তায়, পোশাক পরিধানে, এমন কি বাজারের ব্যাগেও পরিবর্তন দেখা দিল। পাটের তৈরি ব্যাগ আর মাছের খালোইয়ের পরিবর্তে হাতে উঠল পলিথিনের ব্যাগ। বাল্যশিক্ষা শেষ না হতেই গাঁয়ের ছেলে মেয়েরা গার্মেন্টসে চাকরির জন্য ঢাকায় পাড়ি জমাল। কিছুদিনের মধ্যে গার্মেন্টস আমাদের ভুষণে আধুনিক করে তুলল। এদেশের কৃষকদের কল্যাণে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলাম। সবই হলো- কালিখোলার ব্রিজ হলো, বিদ্যুতের পাখা ঘুরল, কাঁচা রাস্তায় ইটের সলিং বসল, এখন গ্রামের ভেতর দিয়ে রেললাইন তৈরির কাজ চলছে। কিন্তু মানুষের ভেতরে যে পাখিটা বাস করে, সে একা হয়ে পড়েছে। ক্রমশ্য আমরা থেকে ব্যক্তি আমিতে পরিণত হলাম। মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ে মানুষ ক্রমশ্য পরিবার থেকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে লাগল।
উন্নত জীবনের হাতছানি রোপালি পর্দার মতো আমাদের পরিবারকেও ঘোরের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। মূলত মৌলিক চাহিদা পূরণ এবং উন্নত সুযোগ সুবিধার আশায় আমাদের পরিবার কাওয়ালদিয়ার নিভৃত পল্লী ছেড়ে গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলায় স্থায়ী বসতি শুরু করে। সাড়ে তিন মাইলের সেই ছোট্ট অভিগমন আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিলো অনেকটাই। বুঝে ওঠার আগেই সময় গড়িয়ে গেল নদীর মতো। আমি যেন ক্রমশ্য বিচ্ছিন্ন হতে লাগলাম মাটি থেকে, শেকড় থেকে, মানুষ থেকে। কী এক সোনার হরিণের পেছনে ছুঁটে চলছি কোনো বিরাম নেই। কোনো অবসর নেই, শুধু ছুঁটছি আর ছুঁটছি।
রাতে ঘুমাতে পারি না গ্রামটাকে স্বপ্ন দেখি। গ্রাম আমাকে ডাক দেয়। পদ্ম বিল আমাকে ডাকে দেয়। বাবার কবর আমাকে ডাকে দেয়। সবুজ ধানখেত আমাকে ডাক দেয়। নাগরিক জীবন আমাকে অস্থির করে তুলেছে। এই তেলাপোকার জীবন থেকে আমি মুক্তি চাই।
রাতে ঘুমাতে পারি না গ্রামটাকে স্বপ্ন দেখি। গ্রাম আমাকে ডাক দেয়। পদ্ম বিল আমাকে ডাক দেয়। বাবার কবর আমাকে ডাক দেয়। সবুজ ধানখেত আমাকে ডাক দেয়। নাগরিক জীবন আমাকে অস্থির করে তুলেছে। এই তেলাপোকার জীবন থেকে আমি মুক্তি চাই। রোজ প্রতীক্ষায় থাকি একটি লম্বা ছুটির। একটি লম্বা বিরতির। আমি গ্রামে যেতে চাই। বাবার কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে চাই, প্রাণ ভরে নির্মল নিশ্বাস নিতে চাই। বটগাছের ছায়ায় বসে বাউল ফকিরের গান শুনতে চাই। স্বপ্ন দেখি কোনো একদিন পদ্ম বিলের কালো জলে ডুব দিয়ে- আবার আদিম হয়ে যাব।
মাহফুজ রিপন: কবি ও গল্পকার।
‘আমার প্রিয় গ্রাম’ নিয়ে লিখুন
আপনি আপনার প্রিয় গ্রামকে নিয়ে আমাদের কাছে লিখুন। সঙ্গে পাঠাবেন গ্রামের একাধিক ছবি ও আপনার পরিচতি। সর্বনিম্ম ৩০০ শব্দে লিখে ফেলুন আপনার গ্রামের যা যা আছে, বেড়ে ওঠা, গ্রামকে নিয়ে স্মৃতি, স্বপ্ন, গ্রামে মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, ইতিহাস-ঐতিহ্য স্থাপনাসহ নানা বিষয়— এই সব নিয়ে চটজলদি লিখে আমাদের ইমেইল করুন। ইমেইল : boicharita@gmail.com
এই লেখাকে আমি গল্প বলবো না । বলবো লেখক এর জীবনের আত্মকথন। একটি নিভূতে গ্রামের হৃদয় নিংড়ানো লেখোকের শৈশব-কৈশোরের চলার পথ নিপুণ হাতে তুলে ধরা হয়েছে । অসাধারণ সাহিত্য ভঙ্গিমায় লেখাটি ধীরে ধীরে পরিচিত সব রাস্তাঘাট মাটিমানুস গ্রাম তুলে ধরা হয়েছে , যা আমার হৃদয় পটে দারুণভাবে দোলা দিয়ে গেলো।