গ্রামহারা এক পথিকের আর্তনাদ

উত্তরের সীমানার ভার নিজের হাতে তুলে নিয়েছে খরস্রোতা চূর্ণী। এখন অবশ্য শীর্ণকায়। পূবে রেল লাইন। এখান দিয়েই ছুটে যায় দর্শনার রেল গাড়ি। পশ্চিমে কাঠিম এবং ইটভাটা। কাঠিম আসলে একটি বড় জলাশয় ও কতগুলি ছোট পুকুরের সংসার। টলটল করে জল কাঠিমের। দক্ষিণে আমারা গ্রামের সীমানা করা খাল দিয়ে। খালের নাম আমি জানিনা। খালের ওপারেই শহর। শহরের নাম নাম রানাঘাট। এপারে, আমার গ্রাম হিজুলি।
গ্রামের ভিতর আমাদের বাড়ির পাশেই এক জোড়া স্কুল। প্রাইমারি ও হাই। তার আগে আমার ক্লাব, রেনেশাংস স্পোর্টিং অ্যাসোসিয়েশন। আমার পাড়ার কোনও নাম নেই। স্কুলের পাশে বলে বোধহয়। উত্তরে বাগানবাড়ি ও ঋষিপাড়া। পশ্চিমে বামুন পাড়া, দক্ষিণে গাজনতলা ও হিজুলি কলোনি, পূবে রেলের পারে গড়ে ওঠা পাড়ারও তেমন কোনও নাম নেই। এখন অবশ্য নতুন নতুন নাম হচ্ছে, গজাচ্ছে নতুন নতুন জনপদ। হাইমাস্ট আলোয় নেচে উঠছে হারিয়ে যাওয়ার সমস্ত আয়োজন।

আসলে, আমার শৈশব, আমার কৈশোর, আমার যৌবন বা আমার জীবনটাই তো হারিয়ে যাচ্ছে আমার থেকে। আমার গ্রামটাও এখন তাই মনে হয়। জীবন হারাচ্ছে জীবিকার ঘূর্ণিপাকে, গ্রাম হারাচ্ছে সময়ের জাঁতাকলে। হারাচ্ছি। হারিয়ে চলেছি দ্রুত গতিতে। স্কুলের পাশে একটা বিশাল বট গাছ ছিল। নামে বট হলেও, আসলে ছিল অশ্বত্থ গাছ। সেই গাছে ছিল টিয়া, হরিয়াল, দাঁড়াশ, গোখরোদের বসবাস। গাছটা নেই। কার্তিকদের বাড়িরে ঢেউয়া গাছও ওর বাবা-মার মতোই অতীত। আমাদের টালির চালার প্রাইমারি স্কুল এখন দোতলা। বাচ্চারা ড্রেস পরে স্কুলে আসে। টিনের চালার হাইস্কুল এখন তিন তলার। আমাদের স্কুলের এখনকার হেডস্যার আমাকে দাদা বলে। স্কুলের সামনের সেই আম বাগান, সেখানে শকুন মারার গপ্পো, জানেই না অনেকে। যে প্যানা পুকুরের পারে গেলে আগে স্নান করতে হত, সেখানে এখন কত বাড়িঘর! স্কুলের পাশেই ভুলু দোকান খুলেছে। সেখানে মাছ লজেন্স নয়, পাওয়া যায় দামি ক্যাডবেরি। ভুলুর দোকানের পিছনেই মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বট আর অশ্বত্থ।
আমার ক্লাবের ঘরটি আছে, খেলা-ধুলো নেই। পাশের পাড়ার যুব সংঘ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সবকিছুতেই। আমাদের পাড়ার ছেলেরা সব বুড়ো হয়ে গিয়েছে। বুড়োরা ছবি। এখন আর গরুর গাড়ি করে ইট যায়না, খেজুরের রস বা নারকেল চুরির খবর পাইনা। পাশের বামুন পাড়ার গাঙুলিদের বিশাল জমিদার বাড়ি, যেখান থেকে বাঙাল বলে খেঁপানো হতো, বাড়িটি থাকলেও খেপানোর কেউ নেই। তখন বুঝতাম না বাঙাল বা ঘটি, এখন বুঝি। কিন্তু কেউ বলে না। উকিল বাড়িতে ময়ুর ছিল, তেঁতুল গাছের তলায় বাসক পাতার ঝাড়। স্বামীজির বাড়ি এখন কাঠিয়াবাবার বাড়ি হয়ে গিয়েছে। বামুন পাড়ার সেই শঙ্করকাকু, বন্দুক দিয়ে মারত হরিয়াল, শামুকভাঙা। সেও এখন ওপারে। গ্রামের রাস্তা এখন পাকা। কাঁদা নেই কোথাও। হাতে হাতে মোবাইল, ঘরে ঘরে রঙিন টিভিতে দেখা যায় ফুটবল ক্রিকেট। নারকেল বা বাতাবি চুরির দিন শেষ। কাঠিম পারে সূর্যডোবা বা থানকুনি পাতা তুলতে যাওয়ার দিন শেষ। চূর্ণী পারাপার কিম্বা পাওয়ার লুমের ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙ আর নটার সাইরেন এখন আর নেই। স্কুলের মাঠে বৃষ্টিভেজা ফুটবলের মতোই হারিয়ে গিয়েছে শীত কালের বনভোজন।

আসলে আমার গ্রাম, আমার কাছে থমকে আছে অন্তত বছর চল্লিশেক পিছনে। নদিয়ার জেলার রানাঘাট স্টেশন থেকে রিক্সায় বা পায়ে হেঁটে পৌঁছে যাওয়া যায় শহর ঘেরা গ্রামটিতে। শহর ঘেঁষা গ্রামটিতে চাষের ক্ষেত নেই। কাঠিমে কিছু মাছ চাষ হয় ঠিকই, তবে সেটাও খুব কমলোকের পেশা। অনেকেই চাকরি করেন। নয়তো দোকানদারি। বামুনপাড়ার লোকেরা তো সব বাবুসাহেব। বড় বড় সরকারি চাকরি করতেন তাঁরা। গরিবরাই বেশি থাকতেন স্কুল চত্বরে। তারপরই তো ছিল চাষা পাড়া, রেল কলোনি এইসব। এই তো সেদিনও বিদ্যুত ছিল বামুন পাড়ার একাধিপত্য। এখন অবশ্য পথে-ঘাটে, এমনকী আকাশেও আলোর বিচ্চুরণ। সেই আলোতেই খুঁজে পাই আমার হারিয়ে যাওয়া শৈশব। আবার পাইওনা। ঠিক নিজের হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিশক্তির মতো। তবু ফেরার সাধ কিছুতেই ভুলতে পারিনা। তাই বার বার ছুটে যাই, হতাশ হই। চেনা চেনা মুখ, চেনা চেনা পথঘাট, চেনাচেনা বাড়িঘর, চেনাচেনা পাওয়ারলুমের শব্দ, পছন্দ ও অপছন্দের মানুষজন সবই কেমন পাল্টে গিয়েছে! পাল্টে গিয়েছি আমিও। আমার মতোই বয়স বাড়ছে গ্রামেরও, আমার মতোই শহুরে হাওয়ায় বেসামাল তার জীবনও।

এই সেই গ্রাম, যেখানে খালি গায়ে ঘুরে বেড়াতে পারে যে কোনও বাউন্ডুলে, গলা ছেড়ে ঝগড়া করতে পারে অনায়াসেই, পারতে পারে অন্যের গাছের ফুল ও ফল, যেকোনো কিশোরীর কাছে লুকানোর প্রয়োজন হয় না দৈন্যতা, পাশের বাড়ির কাকিমার কাছে বলা যায় অনায়াসেই, সাদা ভাতের পাশে একটু ডিমের ঝোল দাও তো! অথবা, অনায়াসে স্কুল মাঠের ঘাসে শুয়ে থাকা যায় বিস্তীর্ণ সময়, চাঁদা তুলে নামানো যায় নাটক কিম্বা ওয়ানডে ফুটবল। পুতুল নাচ বা ওমুক কাকিমার শরীর খারাপ, তমুকের দাদুর মৃত্যু, সবকিছুতেই অবাধ আমন্ত্রন তো ছিল এই গ্রামেই। বিড়ির সুখটান আড়াল করার তাগিদ কিম্বা সাইকেল থেকে নেমে স্যারকে সম্মান জানানোর আন্তরিক তাগিদ এবং বন্ধুদের সঙ্গে অবাধ ও অসংকোচে আড্ডা এবং সবকিছু, ভন্ডামি মুক্ত বেলাল্লাপনার তীর্থভূমি আমার গ্রাম।
গ্রামের মানুষগুলো এখন বেশ ভালো আছে। অনেকে চাকরি করে, অনেকে ব্যবসা। অনেকে আবার গ্রাম ছেড়ে শহরে ঠিকানা বদলেছে, হয় তো মনটাও। সাইকেলের কৈশোর এখন দামি বাইক কিম্বা চার চাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সারা পাড়া। বেপাড়ার মানুষজন হয়ে উঠেছেন আমার পাড়ার লোক, আমি বেপাড়ার। চূর্ণী নদীটা, যেখানে গঙ্গা পুজোর দিন প্রতিবার সাঁতার জানা লোকও ডুবে যেতো, ভূপেন হাজারিকা যাকে নিয়ে লিখেছিলেন, চূর্ণী নদীর ঘুর্ণী ঝড়ে, যেখানে চৈত্র সংক্রান্তী বা দোলের দিনে পারিবারিক স্নান ছিল বাধ্যতামূলক, সেই নদীটাও বদলে গিয়েছে। এখন মনাকি সেখানে স্নান করলে অ্যালার্জি হয়! তিন পয়সার আইসক্রিমের মতো আমাদের আম বাগান, পানুবাবুর ছোলা খেত, অন্নপূর্ণার তিষির জমি, অপু চ্যাটার্জির কাঁচামিঠে আম গাছ নেই। দু পায়ে দুরকম চটি পরে চিঠি বিলোতে আসা শৈলেনকাকুও ডাকঘরের চিঠির মতোই অদৃশ্য। গরুর গাড়ি চলে না আর আমাদের গ্রামে। নেই সেই বুক দিয়ে টিউব লাইট ভাঙা কিম্বা সাইকেল চালিয়ে ভেল্কি দেখানোর কারবার।

আর কাঠিম পার? বহুকাল যায়নি সেখানে। মস্ত বড় জলাশয়, বিধানরা সেখানে কাপড় কাঁচতো। ফড়িংও ছিল। প্রচুর কাপড় কাঁচা হতো সেখানে। আর বর্ষায় কাঠিম ভাসলেই ছিপ হাতে সার্বজনীন মাছ শিকার। পেশা মুখুজ্জের পুকুরেও পড়তো ছিপ, ছিপে না পোশালে চুরি করে মারো জাল। সেই কাঠিমেও শুনেছি পেশাদারী মাছ চাষ শুরু হয়েছে। পারে বসেছে বসতিও। এখনও মনে আছে, এই কাঠিম পারেই কতো সন্ধে কাঠিয়েছি সবে সাবালক হওয়ার আনন্দে। জোছনা এসে ভুলিয়ে দিয়ে যেত আমাদের হতাশা, আমাদের বেদনা। বড় তাড়া ছিল, বড় হওয়ার। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। হোঁচট খেতে খেতে দাঁড়িয়েছি তো ঠিকই। নিজের মতো করে দাঁড়িয়েছি। স্বপ্ন নিয়ে, স্বপ্ন ভাসিয়ে, স্বপ্ন খুইয়ে, স্বপ্নকে সঙ্গী করে, নতুন নতুন স্বপ্ন দেখতে দেখতে নিজেদেরই স্বপ্নের জালে হারিয়েও গিয়েছি। তাই আজ আর সেই কাঠিম পারে আর যেতে পারিনা। অথচ, এই কাঠিমেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা মেরে আর গা ডুবিয়ে কম মার খেয়েছি একদিন! এখন বৃষ্টিতে ভিজতে ভয় পাই, তাই স্মৃতিতে ভিজি।
চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাই, মুখে বিড়ি নিয়ে একা একাই ক্রিকেটের পিচে জল দিচ্ছে আমাদের থেকে নির্বাসনে চলে যাওয়া বাবুলদা। কাঞ্চনদা এখনও স্বপ্ন দেখেন, ইস্ যদি ক্লাবটাকে ফের ঠিক করা যায়! কেলে বা অশোক জীবন যুদ্ধে লড়াইয়ের মাঝেও স্বপ্ন দেখে, ফের যদি আমরা আবার টেক্কা দিতে পারি সময়ের সঙ্গে! বুড়ো কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনলেও পাড়ার বাতাস ছাড়বে না, টোটো টোটো চালাতে চালাতে বাচ্চুও জাবর কাটে ফেলে আসা দিনের কথা। জিসি এখন বালি-ইট নিয়ে দিনভর ব্যস্ত, পলুদা অবসর জীবন কাটাচ্ছে কল্যাণীতে। মন্টুদা বা বুদি দেখা হলেই, ফিরিয়ে আনে ফিরে পাওয়া দিনগুলির স্বপ্ন। স্বপ্নটুকুই তো আছে, গ্রামও তো চলে যাচ্ছে আমার মতোই বার্ধক্যের গহ্বরে। যেখানে বেগ আছে, নেই কেবল আবেগ। লুঙ্গি আর ফতুয়ার শান্তি কী দিতে পারে সাহেবি পোশাক, ঠিক তেমনি হয়েছে কাঁটা-চামচের লৌকিকতায় আমার গ্রাম্য জীবনের সরলতার বিসর্জন। চিতকার করতে ভয় করে, তুই ডাকটাও কেমন যেন তুমি হয়ে যায়, তুমি হয় আপনি!
সময় পেলেই ছুটে যাই আমার গ্রামে। হিজুলি। বুড়োর বাড়ি যাই। লাল্টুর বাড়ি যাওয়া হয়না। লাল্টুও আমার বন্ধু। বহু দিন স্বপ্নের পথ ধরে আমরা হেঁটেছি উত্তরের পথ ধরে। ফুচকা আর ঘুগনি-র সেই স্বাদ দুজনাই হারিয়েছি। হারিয়েছি, স্বপ্ন দেখার সেই আলস্য দিনলিপি। তবু যাই। ভুল হলো, যেতে বাধ্য হই। হিজুলি তো আমিার গ্রাম। হ্যাঁ, আমার। আমাদের নয়, আমার। আমার শৈশব, আমার কৈশোর, আমার যৌবন, আমার আমিকে হারিয়ে ফেলা, স্বপ্নের ডালপালা সবই তো ছড়িয়ে রয়েছে বাতাসের প্রতিটি কনাতে। আমার প্রেমের উচ্ছাস, বিরহের দহন জ্বালা সবই খুঁজে পাই এই গ্রামে। প্রথম প্রেম, প্রথম পাপ, প্রথম সাফল্য, প্রথম ব্যর্থতা লুকিয়ে আছে এই গ্রামেই। এখান থেকেই হাঁটতে শেখা, হোঁচট খাওয়াও এখানেই। তাই ভুলতে পারিনা। চাইওনা।

আবার আসিবো ফিরে, সেই ভরসা বা বিশ্বাস করার ক্ষমতা ও যোগ্য।তা নেই। তাই হারিয়েই যাচ্ছে আমার গ্রাম, আমার থেকে দূরে, অনেক দূরে, অচেনা শহরে। আমিও তাই ক্যাটারার-সংস্কৃতিতে কোমরে গামোছা বেঁধে ভাত, ডাল, বেগুন ভাজা, শুক্তো, মাছের ঝোল, মাংসো, দই-মিস্টির ভোজবাড়ি ছেড়ে ছুটে চলেছি স্বাদহীন-গন্ধহীন-আবেগহীন স্যাটাস সিম্বল মেকি জীবনধারায়। ভালো লাগা ও মন্দ লাগা লোকগুলি থেকে কংক্রিটের জঙ্গলে বন্দিজীবনের ফাঁকে পিছন ফিরে জিরাপের মতো তাকিয়ে দেখি, অস্পষ্ট হয়ে চলেছে আমার গ্রাম। কাঠিমের ওপর মেঘগুলিতেও যেন লেগেছে কর্পোরেটের হাওয়া, চূর্ণীর পরনে ডিজাইনারের মেকি পোশাক। সর্বত্রই মুখোশের দাপাদাপি, সর্বত্রই বদলে যাওয়ার দৌড় এবং রং-চং করা কল্পিত বিলাসিতা। বদলে গিয়েছে আমার গ্রাম।
ভুল হলো, এখন আর আমার নয়, আমাদের গ্রাম! আমার পছন্দের এবং অপছন্দের, সকলেরই গ্রাম। সকলেরই আবেগ ও বেগ দিয়ে সজ্জিত সময়ের স্রোতে ভাসমান জনপদ। আমার ভালোলাগা ও মন্দলাগার ঠিকানা মাত্র, যে আমাকে কেবলই পিছু ডাকে। কিন্তু আমি এগিয়েই চলেছি থামবার লক্ষ্যকে সামনে রেখে। তার গতিও সামনের দিকেই, সেখানে কোনও বিরতি নেই, নেই কোনও যোতি চিহ্ণও! নতুন নতুন কলবরে অনন্ত অসীম পথ ধরে এগিয়ে চলুক আমাদের গ্রাম, আমার জন্য আঁচলটুকু থাকলেই হবে। চোখ মুছে নেবো বিদায় বেলায়।
তরুণ চক্রবর্তী : সাংবাদিক ও লেখক, কলকাতা, ভারত
‘আমার প্রিয় গ্রাম’ নিয়ে লিখুন
আপনি আপনার প্রিয় গ্রামকে নিয়ে আমাদের কাছে লিখুন। সঙ্গে পাঠাবেন গ্রামের একাধিক ছবি ও আপনার পরিচতি। সর্বনিম্ম ৩০০ শব্দে লিখে ফেলুন আপনার গ্রামের যা যা আছে, বেড়ে ওঠা, গ্রামকে নিয়ে স্মৃতি, স্বপ্ন, গ্রামে মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, ইতিহাস-ঐতিহ্য স্থাপনাসহ নানা বিষয়— এই সব নিয়ে চটজলদি লিখে আমাদের ইমেইল করুন। ইমেইল : boicharita@gmail.com