‘মঙ্গলকোটে’র শৈশব কি কখনো ভুলা যায়!

‘মঙ্গলকোট’ আমার গ্রাম। গ্রাম মানেই এক অদ্ভুত রকমের ভালোবাসা। শান্তি। আত্মিক বন্ধন। বুড়িভদ্রা নদীর কেল ঘেঁষে এই গ্রাম। কালের বিবর্তনে বুড়িভদ্রা আজ মৃত প্রায়। নদীটি গিয়ে মিশেছে কপোতাক্ষ নদের সঙ্গে। যে নদ নিয়ে সনেটের প্রবর্তক কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত অনেক কবিতা লিখেছেন। নদের পাশে কবির বাড়ি।
যশোরের কেশবপুর উপজেলায় একটি গ্রাম। কেশবপুর থেকে মঙ্গলকোটের দুরত্ব সাত কিলোমিটার। শুধু গ্রাম নয়, এটি একটি ইউনিয়ন পরিষদও। মঙ্গলকোট বাজার থেকে একটু পূর্ব দিকেই ইউনিয়ন পরিষদ। গ্রামটি কেশবপুর উপজেলার ৫নং ইউনিয়ন। গ্রামটি বড় হওয়ায় দুটি ওয়ার্ডে বিভক্ত হয়েছে। মঙ্গলকোট গ্রামের আয়তন ১০ কিলোমিটারের মত। জনসংখ্যা সাড়ে ছয় হাজার।

গ্রামের নামকরণের নিয়ে নানাজনের নানা মত রয়েছে। অনেকেই বলেন, মুলত সম্রাট বাবরের সময়ে অত্যাচারিত হয়ে ভারতের অযোদ্ধা থেকে পালিয়ে আসেন একজন লোক যাঁর নাম ‘রামভদ্র ঘোষ’। এই অঞ্চল তখন বন জঙ্গলে ভরা। এখানে এসে তিনি বসতি স্থাপন করেন। তখন নামকরণ করা হয় বিদ্যানন্দকাটি। বিদ্যানন্দকাটিরও অনেক ইতিহাস রয়েছে। বিদ্যানন্দকাটি একটি দ্বীপ অঞ্চল, চারপাশে শুধু পানি আর পানি।
এখানে ছোট করে রামভন্দ্র ঘোষের পরবর্তী প্রজন্মের ধারাবাহিতা তুলে ধরা হল—
→রামভন্দ্র ঘোষ ছেলে হরিসচন্দ্র ঘোষ।
→হরিসচন্দ্র ঘোষ ছেলে রাজনারায়ণ ঘোষ।
→রাজনারায়ণ ঘোষ ছেলে কেষ্টনন্দ ঘোষ।
→কেষ্টনন্দ ঘোষ ছেলে কৈলাশ ঘোষ।
→কৈলাশ ঘোষ ছেলে অনুকুল ঘোষ।
→অনুকুল ঘোষ ছেলে সুবাসচন্দ্র ঘোষ।
→সুবাসচন্দ্র ঘোষ ছেলে মধুসূদন ঘোষ।
→মধুসূদন ঘোষ ছেলে সুদীপ্ত ঘোষ।

কেষ্ট ঘোষের সময় থেকে শুরু হয় জমিদারি। অনেক সম্পদের মালিক ছিলেন। তিনিই তৎকালীন জমিদার।
কৈলাশ ঘোষের সময় থেকে শুরু হয় জমিদারি প্রথা এবং অনুকুল ঘোষের সময়ে সুনামের সহিত জমিদারদের আধিপত্য বিস্তার লাভ করে।
তৎকালীন ব্রিটিশ রাও এখানে সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে বিচার কার্যের জন্য বিদ্যানন্দকাটির নদীর ওপারে কোর্ট বসানো হত। সেখানেই সকল প্রকার বিচারের কার্যক্রম চলত। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে নদীর এপারেও জনবসতি গড়ে ওঠে। এই বিচারালয় থেকে সকলের মঙ্গল হওয়ার ফলে জমিদার এই পারের নামকরণ করেন মঙ্গলকোট। আর তখন থেকেই এই নাম চলে আসছে। জমিদারদের শেষ বংশধর মধুসূদন ঘোষ এবং তাঁর ছেলে সুদীপ্ত ঘোষ আজও বেঁচে আছেন। জমিদারদের শেষ তিন প্রজন্ম মঙ্গলকোটের বাসিন্দা।
সেই জমিদার বাড়ির কিছু অংশ রয়েছে জমিদারদের সেই সরোবর।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, আবহাওয়া, জলবায়ূ, মানুষের আথিতিয়তা— সব কিছু মিলিয়ে এক অসাধারণ গ্রাম মঙ্গলকোট। চারপাশে নদী আর সবুজের সমারোহ। যে কারও মন জুড়িয়ে যাবে।
৫নং মঙ্গলকোট ইউনিয়ন বহুদিন ধরে ইতিহাস ও ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। এখানে সাধারণত বৈশাখ মাসের ৫ তারিখে বিশাল আকারে ফকির বাড়ির মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। অনেকদুর থেকে লোকজন ফকির বাড়ির মেলা দেখতে আসেন। মাওলানা মরহুম সাইফুদ্দীন সাহেবের বড়েঙ্গা পীর বাড়ি মাজার। এখানে পীর সাহেবপর খাদেম মুরিদসহ অনেক ভক্ত আসেন। গ্রামের পাশেই আছে এস বি গার্ডেন পার্ক। ১০ বিঘা জমির উপরে বিস্তৃর্ণ এই পার্ক। পার্কের সৌন্দর্য্য দেখে কেউ মূগ্ধ হবে না। এমন মানুষ পাওয়া যাবে না।

যোগাযোগ ব্যবস্থাও বেশ অত্যন্ত উন্নত। ঢাকা থেকে সাতক্ষীরা যাওয়ার প্রধান সড়কটি গিয়েছে এই মঙ্গলকোট বাজারের উপর দিয়ে। আবার মঙ্গলকোট বাজার থেকে পশ্চিম দিকের সড়কটি সরাসরি চলে গিয়েছে ভারত। মঙ্গলকোট থেকে ভারতের দুরত্ব খুব বেশি না। ফলে দেশের বাণিজ্য হয়েছে খুব সহজ। পদ্মা সেতু হয়ে গেলে এই সড়কটি হবে এই অঞ্চলের ভারত যাওয়ার প্রধান সড়ক।
শিক্ষা–দীক্ষা ও সংস্কৃতির দিক থেকেও পিছিয়ে নেই। এলাকায় আগের তুলনায় শিক্ষার হার অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রামে একটি মঙ্গলকোট মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মঙ্গলকোট বালিকা বিদ্যালয়, শহীদ খালেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মঙ্গলকোট উত্তরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মঙ্গলকোট জামে মসজিদ মঙ্গলকোট কমিউনিটি ক্লিনিকসহ একটি মাদ্রাসা রয়েছে। গ্রামটিতে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, জজ,বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ অনেক কৃতি সন্তান জন্মগ্রহণ করেছেন। উল্লেখ করা যেতে পারে— সাবেক শিক্ষা মন্ত্রী জনাব এএসএইচকে সাদেক, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ইশমত আরা সাদেক, শিবলী সাদেক এবং বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী অভিনেত্রী শাবানা।

শিক্ষা–দীক্ষায় যেমন এই গ্রাম। কৃষিতে অনেক তেমনি অবদান রেখে চলেছ। দেশের সবজি খাদ্য চাহিদার ৭০ ভাগ যায় যশোর জেলা থেকে। চারপাশে বিস্তৃত মাঠ জুড়ে রয়েছে নানা ধরনের সবজি। গর্ব করে বলতে পারি, এখানে আসলে যে কারও মন চাইবে এখানেই থেকে যায়।
গ্রামের মহিলারাও এখন অনেক সাবলম্বী। যশোরের নকশীকাঁথা নাম করা সারা দেশ জুড়ে। গ্রামের মহিলারা সেই কাঁথা সেলাই করে। গরু– মুরগীর খামার করে নিজেরাই সাবলম্বী হন।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ছিল এই গ্রামের অনেক ভূমিকা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় মঙ্গলকোটের পাশেই খুলনার ডুমিরিয়ার চুকনগর। এই চুকনগর ছিল পাকিস্তানি বাহিনী আস্তানা। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, কিশোর, শিশুসহ অসংখ্য মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে, এই বুড়িভদ্রা নদীতে ভাসিয়ে দেয়। মঙ্গলকোটের এই নদী ছিল লাল রক্তের নদী। বাতাসে ভারি চাপা কান্না আর লাশের পচা গন্ধে গ্রামের মানুষ ছিল আতঙ্কিত। তখন এই গ্রামের বিদ্যানন্দকাটি জমিদার বাড়িটি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এগিয়ে আসে। মুক্তিযোদ্ধাদের খাবারের জন্য ৫০টিরও বেশি চুলা জ্বলেছে। যার সহযোগিতায় ছিলেন বর্তমানের মধুসূদন ঘোষ। মধুসূদন ঘোষ, মোঃ সামসুর রহমান সরদার, শহীদ খালেক ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে খালেক নিহত হওয়ায় তাঁর নামে মঙ্গলকোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয়।

এই ইতিহাস–ঐতিহ্যভরা, সুন্দর, নির্মল নিরিবিলি গ্রামে আমার জন্ম। বেড়ে ওঠা। আমার শৈশব– কৈশোর। গ্রামের প্রতিটি ধূলিকণার সঙ্গে যেন মিশে আছে আমার সমস্ত স্মৃতি। দুরন্তপনায় কেটেছে শৈশব। দল বেঁধে পুকুরে গোসল, সাঁতার প্রতিযোগিতা, সবাই মিলে বুড়িভদ্রায় শাপলা তুলতে যাওয়া,শাপলা তুলতে গিয়ে সাপের কামড়ও খেয়েছি, কালবৈশাখীর বিকেলে ঘন মেঘে নৌকা চালাতে গিয়ে হারিয়েছি বৈঠা, আম্মার বকা ঝকা,দাঁড়িয়াবাধা, গোল্লছুট আর ইচিংবিচিং, দল বেঁধে স্কুল কলেজে যাওয়া, বন্ধু বান্ধবীদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া, বনভোজনে সেই কী আনন্দ! এমন মধুর শৈশব কি কেউ কখনো ভুলবে!
















