একজন শহরচারী মেয়ের চোখে তালগাছী গ্রাম

তালগাছী বাসস্ট্যান্ড। ছবি : মুরাদ হোসাইন
সবার মুখে শুনে শুনে বড় হয়েছি যমুনা পাড়ের মেয়ে আমি। যমুনা বিধৌত জেলা সিরাজগঞ্জ। যমুনা সেতু এই অঞ্চলের একটি প্রধান অঙ্গ। অঞ্চলটির অলিগলিতে এঁকেবেঁকে যাওয়া নিম্নগামী একটি নদী করতোয়া। এই করতোয়া বাঁকেই আমাদের খুব ছোট্ট একটি গ্রাম, তালগাছী। তাল চাষের আধিক্য এ অঞ্চলে, এমনটা নয়। বরং শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্পকারখানা বেষ্টিত হরদম ব্যস্ত একটা উন্নত গ্রাম। ঠিক গ্রাম নয় যেনো, একটা উন্নয়নশীল এলাকা যাকে ঘিরে অর্জিত হয় রোজ হাজার মানুষের রুটি-রুজির সংস্থান।
খুব ছোট্ট একটা গ্রাম আমাদের৷ তথাপি একটি প্রাইমারি স্কুল, চারটি বেসরকারি স্কুল, একটি হাইস্কুল, একটি ডিগ্রি কলেজ, একটি পাবলিক লাইব্রেরি, একটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ইউনিয়ন পরিষদ, একটি সরকারী মাতৃ ও শিশু সদন, দুটি মসজিদ, দুটি মাদ্রাসা, ঋণদানকারী বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, অগ্রণী-গ্রামীণ-ইসলামী ব্যাংক-বীমা, কলকারখানাসহ জীবন ধারণের ও মান্নোনয়নের সবকটি কর্মকৌশল সুপ্রতিষ্ঠিত।
খুব ছোট্ট একটা গ্রাম আমাদের৷ তথাপি একটি প্রাইমারি স্কুল, চারটি বেসরকারি স্কুল, একটি হাইস্কুল, একটি ডিগ্রি কলেজ, একটি পাবলিক লাইব্রেরি, একটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ইউনিয়ন পরিষদ, একটি সরকারী মাতৃ ও শিশু সদন, দুটি মসজিদ, দুটি মাদ্রাসা, ঋণদানকারী বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান, অগ্রণী-গ্রামীণ-ইসলামী ব্যাংক-বীমা, কলকারখানাসহ জীবন ধারণের ও মান্নোনয়নের সবকটি কর্মকৌশল সুপ্রতিষ্ঠিত।
গ্রামটি ঢাকা-সিরাজগঞ্জ-পাবনা হাইওয়ে বেষ্টিত হওয়ায় এবং শিক্ষার্জনের বহুবিধ প্রতিষ্ঠান ও জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর পর্যাপ্ত যোগান থাকায় প্রায় ২০-২৫ টিরও অধিক গ্রাম এই এলাকাটিকে ঘিরে নিত্য আবর্তিত। তাই এটিকে একটি সেন্ট্রাল পয়েন্ট বললেও অত্যুক্তি করা হবে না। সেইসঙ্গে সকল ধর্মের সহাবস্থান।

এখানে মুসলিম ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা পাশাপাশি অবস্থান করে। মুসলিম অনুষ্ঠানাদির পাশাপাশি পালিত হয় পূজাপার্বণাদি। চৈত্র সংক্রান্তি, দূর্গা পূজা, বৈশাখী মেলা এসব ঐতিহ্যবাহী আচার-অনুষ্ঠান গ্রামের সকলে মিলেমিশে উৎযাপন করে।
এখানে মুসলিম ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা পাশাপাশি অবস্থান করে। মুসলিম অনুষ্ঠানাদির পাশাপাশি পালিত হয় পূজাপার্বণাদি। চৈত্র সংক্রান্তি, দূর্গা পূজা, বৈশাখী মেলা এসব ঐতিহ্যবাহী আচার-অনুষ্ঠান গ্রামের সকলে মিলেমিশে উৎযাপন করে। বাৎসরিক ওয়াজ-মাহফিল অনুষ্ঠিত হয় এখানে বড় কলেবরে। তখন হিন্দু ধর্মাবলম্বীর বিবাহিত মেয়েরা বাবার বাড়িতে আসে বেড়াতে, আবার দূর্গা পূজাতে যে গ্রামব্যাপী মেলা বসে তাতে বিবাহিত মুসলিম মেয়েরা নাইওরে আসে বাবার বাড়িতে। ধর্মের বেড়াজাল গৌণ করে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে অঙ্গাঙ্গিক অবস্থান এখানে। গ্রামের প্রতিটি উপাদান ভাগাভাগি করে জীবনধারণ করে সবাই।

করতোয়া এক সময় স্রোতস্বিনী নদী ছিলো যার অঞ্চলে ছোট্ট একটি জায়গা করে বসে আছে আমাদের এ গ্রাম। শাহজাদপুর উপজেলা হয়ে বয়ে যাওয়া এ নদীটির পাড়ে বসেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সৃষ্টি করে গেছেন তাঁর অমর সব রচনা ছিন্নপত্র, ছুটি, পোস্টমাস্টারসহ আরও নানাবিধ। হিন্দু কিংবদন্তির মতে এই নদীটি পার্বতীকে বিয়ে করার সময় শিবের হাতে ঢালা পানি থেকে তৈরি হয়েছিল। আবার মহাভারতে বলা আছে, তিনদিন উপবাসের পর করতোয়া নদীতে ভ্রমণ করা আর ঘোড়া বলিদান সমান পুণ্যের কাজ। গ্রামে জনশ্রুতি আছে যে, এই গ্রামের সাথে অন্যান্য গ্রামের সংযোগ স্থলে নদীটির উপরে নির্মিত যে সুদৃশ্য ব্রিজটি আছে সেখানে মৃতদেহ সৎকার করা হয়। তার নীচে বিশাল কদাকার একটা গজার মাছ আছে যাকে কেউ শিকার করতে পারে না। অতীতে যারাই শিকার করার দুঃসাহস দেখিয়েছে তারা কেউ কেউ মারা গিয়েছে, কেউবা মানসিক ও শারীরিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। গভীর রাত্রিতে সে মাছের আনাগোনা টের পাওয়া যায়।
এই গ্রামের সাথে অন্যান্য গ্রামের সংযোগ স্থলে নদীটির উপরে নির্মিত যে সুদৃশ্য ব্রিজটি আছে সেখানে মৃতদেহ সৎকার করা হয়।

শাহজাদপুর উপজেলাতে ১৯৭৩ সালে ‘বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী কো-অপারেটিভ সমিতি’ স্থাপিত হয়। এটিই দেশের অন্যতম বৃহৎ দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ সমবায় সমিতি। সেই সময় থেকে আমাদের গ্রামের গো-হাট প্রসিদ্ধ। দেশের সর্বস্তরের ব্যবসায়ীদের আনাগোনা হয় এই গো-হাটে। এছাড়াও এক সময়ে সোনালী আঁশের জমজমাট ব্যবসাস্থল ছিলো এই গ্রামটি।

এখানে বর্ষাকালে দৃশ্যত হয় সবচেয়ে সুন্দর চিত্রটি। নদী তখন কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠে বানের নয়া পানিতে। যদিও যমুনা পাড় আর করতোয়ার এই বাঁক আমার খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয় নি তবুও আমি নানাজনের তৈলচিত্রগ্রহণ যন্ত্রের কারিগরিতে দেখেছি বর্ষার টইটম্বুর চিত্র। এ গ্রামের ছেলেমেয়েরা শিক্ষার্জনের লক্ষ্যে স্বভাবতই শহরগামী। জেনেছি বর্ষার ছুটিতে শহরে থাকা ছেলেমেয়েরা যখন বাড়িতে আসে, গ্রামের বন্ধুদের সাথে একাকার হয়ে ভাগ করে নেয় বর্ষার আনন্দ। সব বয়সের সকলে মিলে বের হয় নৌকা ভ্রমণে। এ ভ্রমণ দূর করে দেয় মাসের পর মাস গ্রামে নিজের উপস্থিতহীনতা। সবলে শুষে নেয় প্রকৃতির বিশুদ্ধতা। গ্রাম, মাটি ও মানুষের কাছে যে দায়বদ্ধতা তাদের তা দুহাতে ঢেলে দিতেই যেনো সবার এ আনন্দভ্রমণ।

এই শহরবাস আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে গ্রামের শৈশব, গ্রামের চাক্ষুস চিত্রপট। তবুও আমি জানি বর্ষার আগমনে ভরন্ত প্রবাহে গ্রামের দিনাতিপাত হয়ে উঠে মানুষের কাছে প্রেমময় ও কোমল। ছোট্ট গ্রামটিতে কোনো চাষযোগ্য জমি না থাকায় হেমন্ত এখানে আদুরে হয়ে নামে না। তাই আমি যেখানেই যাই যেখানেই থাকি শুনতে পাই জীবনানন্দের মতো —
মেয়ে ইতস্তত বসে আছে ;
গান গায় ;
নদীর শব্দ শুনি আমি।
নদী তুমি কথা কও!
রাজিয়া সুলতানা ঈশিতা : সহসম্পাদক, বইচারিতা
‘আমার প্রিয় গ্রাম’ নিয়ে লিখুন
আপনি আপনার প্রিয় গ্রামকে নিয়ে আমাদের কাছে লিখুন। সঙ্গে পাঠাবেন গ্রামের একাধিক ছবি ও আপনার পরিচতি। সর্বনিম্ম ৩০০ শব্দে লিখে ফেলুন আপনার গ্রামের যা যা আছে, বেড়ে ওঠা, গ্রামকে নিয়ে স্মৃতি, স্বপ্ন, গ্রামে মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, ইতিহাস-ঐতিহ্য স্থাপনাসহ নানা বিষয়— এই সব নিয়ে চটজলদি লিখে আমাদের ইমেইল করুন। ইমেইল : boicharita@gmail.com
Its very impressive writings as well as attractive village scenario. Im very much impressed to see this village natural pictures.