ভেসে বেড়ানো হাট উধুনিয়া গ্রামবেলা

পাড় ভাঙ্গুড়ার ঘাট থেকে ছৌই ওয়ালা বড় স্যালো নৌকায় উঠতাম। নৌকা ছাড়ার পরে পরেই আমরা ভাইবোন সবাই মিলে ছৌইয়ের উপরে ওঠে বসতাম। ৬ কিলোমিটার পানি ভাসতে ভাসতে গ্রামে বাড়ির উঠনের ঘাটে পৌঁছাতাম। বর্ষার পানির জন্য এতটা পথ যাওয়া সহজ হয়। তা না হলে গ্রামের বাড়ি যাওয়া হয়ত হত না। হেঁটে যাওয়া ছাড়া সেই সময় তেমনি কোনো ব্যবস্থা ছিল না। নৌকায় যেতে যেতে চোখ পড়ত কত কত গ্রাম। ঘরবাড়ি। মনে হত ছোট ছোট সবুজে ঘেরা পাহাড়ের মতো গ্রামগুলো। পাবনা শহর থেকে আমাদের গ্রাম হাট উধুনিয়ার যাচ্ছি। পাবনার ভাঙ্গুড়ার উপজেলার একটি গ্রাম। সেখানে আমার শিকড়। দাদা–দাদীর বাড়ি।
বর্ষার পানির জন্য এতটা পথ যাওয়া সহজ হত। তা না হলে গ্রামের বাড়ি যাওয়া হয়ত হত না। হেঁটে যাওয়া ছাড়া সেই সময় তেমনি কোনো ব্যবস্থা ছিল না। নৌকায় যেতে যেতে চোখ পড়ত কত কত গ্রাম। ঘরবাড়ি। মনে হত ছোট ছোট সবুজে ঘেরা পাহাড়ের মতো গ্রামগুলো।

নৌকায় ভাসতে ভাসতে দেখা যায় আমাদের বাড়ির সামনে প্রাইমারি স্কুলটি। সেই স্কুলটিকে দেখে অপেক্ষার প্রহর শেষ হত। নৌকা ঘাটের কাছাকাছি আসরা পর নৌকার মেশিন বন্ধ করে দেওয়া হত। নৌকাঘাটে নামার পর আমাদের গ্রামের মানুষ আমাদের দেখার জন্য ভীড় করত। আমার দাদা তৎকালীন পাকিস্তান সময়ের চার বার নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ছিলেন এবং স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে তিনি বিল্লাহিরি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। দাদার সুনামের কারণে গ্রাম মানুষজন আমাদের সঙ্গে অনেক আন্তরিক ব্যবহার করতেন। সবাই অনেক সমীহ করতেন। ছোটবেলা বিষয়গুলো দারুণ লাগত।

সারাদিন নদীর পানিতে ঝাপাঝাপি, মাছ ধরা, সাঁকো পার করে এ গ্রাম সে গ্রাম ঘুরে বেড়ানো। পাকা পেঁপে আর ছোরি ধরে পাকা কলা লুকিয়ে পেরে খাওয়াও বাদ যায়নি। বাড়ির ঘাটে দুটো ভিঙ্গী নৌকা বাধা থাকত সব সময়। বিকেলে ভাইবোনেরা নৌকা দুইটি নিয়ে ভাসতে বের হতাম, বাতাসে নৌকা দোলে খেতে খেতে শীতল হয়ে যেত। কী অরূপ সুন্দর প্রকৃতি! একবার ভাসতে ভাসতে একটা জায়গায় আটকে যাই, চারদিক পানি আর পানি। নৌকা আর সামনে দিকে না পিছনের দিকে যায় না। বৈঠা মাটি ঠাঁই পায় না। অনেক সময় পার হবার পর, দেখি চাচা বাবা অন্য নৌকা নিয়ে আমাদের খুঁজতে বের হয়েছে,আমাদের দিকেই আসছে। বন্যার পানিতে নাকি অনেক ভয়ংকর থাকে মাটির নিচে টেনে নেয়। বলাবলি করতে শুনছিলাম একার মানুষের মুখে। সে দিনের পর থেকে আমাদের আর ওভাবে বের হতে দেয়নি।

তখন গ্রামে বিদ্যুৎ পৌছায়নি। সন্ধ্যার আলো থাকতে থাকতেই ঘরে ঘরে জ্বালানো ওঠত কেরোসিনের কুপ আর হ্যারিকেন আলো। এশার আজার হবার পর পরই হয়ে যেতো রাতের খাওয়া। তারপর বড় উঠলে মাদুর পেতে বসতাম পরিবারের সবাই। গল্পে গল্পে অনেক সময় কেটে যেত। গ্রামের যে পুরনো মসজিদ আছে, সেটির এক অংশ অলৌকিকভাবে তৈরি হয়েছিল। একটা শ্বাশান ঘাট আছে। যা বর্ষার পানিতে তলিয়ে যেত। সেখানেও নাকি অনেক ভৌতিক কর্মকাণ্ড হয়। এই সব নানান ধরনের গল্পে জমে যেত আসর। আশে–পাশের মানুষজনেরাও যোগ দিত আসরে।
তখন গ্রামে বিদ্যুৎ পৌছায়নি। সন্ধ্যার আলো থাকতে থাকতেই ঘরে ঘরে জ্বালানো ওঠত কেরোসিনের কুপ আর হ্যারিকেন আলো। এশার আজার হবার পর পরই হয়ে যেতো রাতের খাওয়া। তারপর বড় উঠলে মাদুর পেতে বসতাম পরিবারের সবাই। গল্পে গল্পে অনেক সময় কেটে যেত।
আমার দাদা দাদীর ছিল ৯ ছেলে দুই মেয়ে। আমরা সবাই যখন যেতাম এক সঙ্গে যেতাম। সবাইকে দিয়ে পরিবারের সদস্য ছিল ৫২ জন। এখন আরও বেরেছে। দাদা-দাদী, বড় ফুফু ও সেঝো চাচী মারা গেছেন। গ্রাম এখন উন্নত। ডিজিটাল যুগের ছোঁয়া এখন গ্রামের প্রতিটি ঘরে।

বর্ষাকাল আসলে এখনো খুব যেতে ইচ্ছে করে গ্রামের বাড়ি যেতে। সবাই বিভিন্ন জায়গায় থাকে এখন। প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে বাড়ি। শুধু স্মৃতিগুলো এখনো ভরপুর করে রাখে মনকে।
একটি বড় পুকুরকে ঘিরে গ্রামটির অবস্থান। গ্রাম মধ্যপাড়া, হাট উধুনিয়া। পূর্ব দিকে ইছামতী নদী। গ্রামের মানুষ কৃষিজীবী ও মৎস্যজীবী। গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়—নাম হাট উধুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। একটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। স্কুলে মাঠে বর্ষাকালে আমরা ফুটবল খেলতাম। গ্রামের বৈশাখ মাসে একটা মেলা বসত। জামাই মেলা নামে পরিচিত ছিল। ছেলে–মেয়েদের পাঠ্যবই বাদে পড়তে যেত হাট উধুনিয়া শান্তি সংঘের লাইব্রেরিতে।
আনিকা তাসনিম, পাবনা
গ্রাম: মধ্য গ্রাম, হাট উধুনিয়া। পোস্ট : দিলপাশার উপজেলা : ভাঙ্গুড়া জেলা: পাবনা।
আপনি আপনার প্রিয় গ্রামকে নিয়ে আমাদের কাছে লিখুন।সঙ্গে পাঠাবেন একাধিক ছবি, আপনার পরিচতি। বিষয় : ‘আমার প্রিয় গ্রাম’। আপনার গ্রামের যা যা আছে, আপনার ভালো লাগা, বেড়ে ওঠা, স্বপ্ন— এই সব নিয়ে চটজলদি লিখে আমাদের ইমেইল করুন। ইমেইল : boicharita@gmail.com