বাদল দিনের প্রথম কদম…

বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল
তোমারে করেছি দান!
কদম ফুল বর্ষাদিনের এক আরতি নিয়ে আসে। বর্ষা যেনো কদম ফুলের জন্যই এত মোহনীয় হয়ে উঠেছে আমাদের কাছে। কদমবিহীন বর্ষাযাপন এ যেনো ভাবা যায় না। বর্ষার উপচে পরা নদী ঠিক যেনো কদম ফোটা গাছের মত। ভরন্ত নদীর গা জুড়ে আঁকেবাকে কদম ফুটে থাকে। ফুটন্ত কদমের ভারে গাছ নুয়ে পরে বর্ষার নতুন পানিতে। নতুন পানির আকুল স্পর্শে ফুল ফোটে প্রাণবন্ত, ষোলকলা পূর্ণরূপে। সূর্যের হাসির ন্যায় থরেবিথরে ঝুলতে থাকে কদম দিনের আরতি।
সেই আরতি অঞ্জলি ভরে তুলে নেয় কিশোর-কিশোরী, কপোত-কপোতী, বর-কনে। কখনোবা বিহঙ্গ চাতক ডুব মেরে ছুঁয়ে আসে ডুবন্ত কদম। একদল স্কুল ফেরত ছানাপুনো, প্রাথমিক স্কুল পড়ুয়া অর্ধেক পোশাকাবৃত দুরন্ত দল হৈহৈ করে নেমে পরে বুক পানিতে। তুলে নেয় কদম অথবা সবে গলতে থাকা এঁটেল-দোঁআশ মাটির এক মুঠ। ছুঁড়ে দেয় সঙ্গীদের দিকে। শুরু হয় বর্ষার আনন্দ, বর্ষাতে গ্রামবাংলার প্রথম চিত্র। একদল ছুঁড়তে থাকে কাদা, একদল ঝাপিয়ে পরে বন্ধুর কাঁধ বরাবর পানিতে, এরইমধ্যে কে একজন দলের ভয়কাতুরে ছেলেটাকে পায়ে টান মেরে নিয়ে যায় গভীর পানিতে। কিছুটা দূরে আরেকদল গ্রামের উঁচু কালভার্ট থেকে লাফিয়ে পরে প্রতিযোগিতায় প্রথম হতে চাইছে। যতদূরে লাফিয়ে পরে ডুবে যাবে সে-ই সাহসীদের দলে। এভাবেই সকাল-দুপুর বর্ষাদের বিরাম নেই।

গৃহস্থালির কাজ শেষে গ্রাম্য বধূরা এসে ভিড় করে একই ঘাটে। চিরাচরিত নিয়মে নতুন বধূরা আসে লজ্জাবনত আঁচলে, কলসী থাকে কাঁখে। নতুন বর্ষায় আজ সবাই নব বধূর মতই আনন্দে উচ্ছলিত। কেউ কোলের ছেলেকে নাইতে নিয়ে আসে, কেউ আধোয়া শাড়ি-কাপড়, কেউবা বয়স্ক শাশুড়ী আর ননদের সাথে উচ্ছলতা ভাগাভাগি করতে ঘাটে নেমে পরে। মায়েদের বকুনিতে দুরন্ত কিশোরেরা দলছুট হয়ে পড়িমরি করে দৌড় ধরে বাড়ির উঠোনে। ঘাটে পরের দফার জলকেলি উৎসব শুরু হতে থাকে ঘাট বধূদের স্থিত গল্পগুজবের আড়ম্বরে। বর্ষা তখন পূর্ণতা প্রাপ্তির দিকে চলেছে। বধূদের ছোঁয়ায় বর্ষা কিশোরী থেকে যুবতীতে রূপ পেতে চলেছে। স্ফীত যৌবনার বর্ষা ফুলেফেঁপে মধ্যাহ্ন থেকে বিকেলের দিকে গড়িয়ে পরছে। বধূরা আনন্দে শরীরে মেখে নিচ্ছে নতুন বর্ষাকে। বর্ষার চকচকে জল বধূদের কোমলতা ছুঁয়ে ছুটে চলেছে কোন সে সুদূরের পথে। সহসাই সাঙ্গ হয়ে আসে এ জলকেলিদের উদ্দামতা। বধূরা ফিরে গেছে ঘরে। মাঠের কাজ, বাজারের কাজ, বাইরের কাজ সব বন্ধ করে বিরতিতে বাড়ি এসেছে বধূদের কর্তারা। পরিপাটি দস্তরখানা বিছিয়ে নিয়ে বসে আছে স্ব স্ব কর্তাদের সামনে ভোজন সাজিয়ে। মধ্যাহ্ন গড়িয়ে পরছে আনন্দ বিকেলের দিকে। তার আগে একবার গুমোট নেমে আসে বধূদের ঘরে ঘরে, বর্ষার জলে। ধীরস্থির হয়ে থাকে বর্ষার জল। গড়তে ভুলে যায়। বাতাস থেমে থাকে। তখনই একটা দোয়েল নারকেল ডালে শূন্য বাড়িতে ডেকে উঠে। সাড়া শব্দহীন ঘর-গৃহস্থালি। ঘুমে ঢুলুঢুলু কিশোর। কর্তারাও গড়িয়ে নেয় একপ্রস্থ। বর্ষা তখন দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে ঘাটে ঘাটে। ঘরে ঘরে তার সন্ধি হয়৷ ঘুম শেষে কিশোরেরা জেগে উঠলে বর্ষার স্বস্তি মেলে। হেলেদুলে চলতে শুরু করে। বাতাস মৃদুমন্দ স্বরে দোলাতে শুরু করে চিরল পাতাগুলোকে।
আর কিশোরীরা? বেণী দুলিয়ে ফিতা বেঁধে কলকল করে উঠে বর্ষা জলে। আর যুবতী? চোখে কাজল দেয় কি যেনো ভেবে, ছোট্ট একটা টিপ পরে নেয় তার সাথে, আর পায়ে একটা মল। রিনঝিন করে প্রতি পদে বাজতে থাকে সেই সুর। উৎকীর্ণ স্রোতা বুঝে নেয় তার আহবান। শান্ত ভদ্র পড়ুয়া যুবক তখন দুলে উঠে পরিমিত হাস্যে। দোল খেতে থাকে পাট করে আসা চুলগুচ্ছ। যুবতীর বেণুনি দেখতে দেখতেই ঘোর লেগে যায় চোখে৷ মিলাতে থাকে সদ্য পড়ে আসা রবীন্দ্রনাথের নায়িকার সাথে অথবা রাধাকে মনে পরে তার। যুবতীর নীল ওড়না পতপত করে উড়তে থাকে চোখে। ওড়নার ফাঁক গলে দেখে বর্ষার জল। নীল জল। হাস্যময়ী জল।
কোনো কথা বলে না যুবক। যুবতীর অবিরত হাসি আর নীল জলে বুঁদ হয়ে যায় সে। সহসাই ঝুপ করে নেমে পরে আবছায়া সন্ধ্যানামা। দূরে কেউ বাজাতে থাকে –
‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা।
মম শূন্য গগণবিহারী।’
রাজিয়া সুলতানা ঈশিতা : লেখক
দারুণ লেখাতো! চোখে পড়লো কেন? আস্ত কানা মনে হচ্ছে নিজেকে!
হা হা, দেরিতে হলেও চোখে পরলো তো৷ আগে-পরে যখনই হোক পড়লেই হলো। বর্ষার শুভেচ্ছ।