‘নষ্টনীড়’- একটি নিরীক্ষাধর্মী দৃষ্টিপাত

হরিশংকর জলদাস রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর একটি খাতার পাঠোদ্ধার করান রবীন্দ্রনাথের ঔরসজাত সন্তান রথীকে দিয়ে। এ কৌশলের আশ্রয়ে তাঁর দাঁড় করানো কাঠামোয় ‘আমি মৃণালিনী নই’ শীর্ষক উপন্যাসের সৃষ্টি। ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের টুকিটাকি অনেকটাই বেরিয়ে আসে তাতে। পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের লেখক জীবনের নানাদিকও আলোয় এসেছে। এসেছে রবীন্দ্রনাথসহ তাঁর ঘরের অনেকেরই স্পর্শকাতর অনেক বৃত্তান্ত। সে ফিরিস্তিতে স্বয়ং ভবতারিণী দেবী ওরফে মৃণালিনী দেবীও বাদ পড়েননি। রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাদম্বরী দেবীর সুইসাইড নোট থেকে যেমন জানা যায় কাদম্বরী-বিহারীলাল প্রেমের স্বীকারোক্তি, তেমনি আমি মৃণালিনী নই—এ উঠে আসে ভবতারিণীর বলেন্দ্রনাথ আখ্যান— ছোটো করে। তবে একে চট করে প্রেমাখ্যান বলে ফেলার সুযোগ নেই।
বলেন্দ্রনাথ রবিবাবুর ভ্রাতুস্পুত্র। কাকিমার সাথে তাঁর আন্তরিক সম্পর্ক হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। বিভিন্ন উৎস বলছে রবীন্দ্রনাথ এবং ভবতারিণী উভয়েরই স্নেহধন্য ছিলেন বলেন্দ্রনাথ। ভেতরকার ঘটনাবলি যা কিছুই হোক, তা এই দুজনের মধ্যে প্রণয়ের কথা বলে না কিছুতেই।
আপাতত লেখার এই জায়গায় অন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ থেকে ঘুরে আসছি।
তখন সস্ত্রীক রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে গেছেন। সঙ্গে বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই সময়ে ভবতারিণীর দাবিমতে রবিবাবুর অবহেলা, অবমূল্যায়নে মুষড়ে থাকতে হয় তাঁকে। হরিশংকর জলদাসের লেখায় এসেছে —
‘… এই বোটে ওপর-নিচ করে সময় কাটাই; বসে থাকি রবিবাবুর জন্য। কিন্তু সেই রবিবাবু আমাকে দেখে না, দেখে নিজের স্বার্থ। স্ত্রী-সান্নিধ্য তার কাছে তেমন আকাঙ্ক্ষিত নয়, যতটা ঈপ্সিত লেখাজোখা। তাই বলে আমি রবিবাবুর লেখালেখির বিপক্ষে নই। সে লেখার জন্য সময় তো ব্যয় করবেই, কিন্তু আমাকে কিছুটা সময় দেওয়া কি তার উচিত নয়? পরবাসে স্ত্রীকে সময় দেওয়া স্বামীর তো কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। কিন্তু রবিবাবু সেই কর্তব্যকে আমলে আনত না। আমার সঙ্গে দু-চার দণ্ড অবস্থান না করেই লেখার ঘরে চলে যেত সে। শুধু চলে যেত নয়, ঘরের দরজা বন্ধ করে দিত, যাতে আমি বা সন্তানরা ও-ঘরে ঢুকতে না পারি। আমরা ঢুকলে যে তার লেখার ব্যাঘাত হবে!’
এরকম একটা অবস্থায় বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর ওরফে বলুকে কথা বলার সঙ্গী করে নেন ভবতারিণী দেবী। বলুর পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে যথেষ্ট আন্তরিক সাড়া মেলে। এ বিষয়টা রবীন্দ্রনাথ খেয়াল করেছেন – এমনটাই স্বাভাবিক হবার কথা। যেটা স্বাভাবিক নয়, ভবতারিণী আর বলুর মধ্যে প্রণয়সূত্রের কল্পনা, ভবতারিণীর সেই খাতার দাবি – সেরকম কিছুই করে ফেলেছেন রবিবাবু। এ দাবি করতে গিয়ে সেই খাতায় তিনি লিখেছেন –
‘বলুর মৃত্যুর দুবছর পর রবিবাবু একটা গল্প লিখল ভারতী পত্রিকায়। গল্পটির নাম ‘নষ্টনীড়’। ভূপতি নামের একজনকে দিয়ে গল্পটির শুরু। ভূপতি একটা ইংরেজি দৈনিকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। পত্রিকাটির জন্য সে উৎসর্গীকৃতপ্রাণ। সংসারের দিকে মনোযোগ দেওয়ার সময় নেই তার। বালিকাবধূ চারুলতা দিনের পর দিন তার সান্নিধ্যলাভের আকাঙ্ক্ষায় অপেক্ষা করে। জীবনের বসন্তগুলো উদাস-নিঃসঙ্গতায় কাটতে থাকে চারুলতার। স্বামীর অবহেলার অবসরে চারুলতার জীবনে আসে অমল। অমল ভূপতির পিসতুতো ভাই। দুজনের মধ্যে ভালোবাসাবাসি গভীর থেকে গভীরতর হয়। ভূপতি-চারুলতার দাম্পত্য জীবনের ট্রাজেডিই ‘নষ্টনীড়’ গল্পের মূল বিষয়। গল্পের সম্পাদক তো রবিবাবু স্বয়ং। কিন্তু গল্পের অমল কে? কার ছায়া অবলম্বনে চারুলতা চরিত্রটি তৈরি করেছে রবিবাবু? গল্পে দেবর-বউঠানের যে কাহিনী তা রবিবাবু-কাদম্বরীর পুরাতন সম্পর্কের₁ প্রতিচ্ছবি। গল্পটি প্রথমবার পড়ে আমার তা-ই মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে অন্য। গল্পের সম্পাদক ভূপতি যে স্বয়ং রবিবাবু, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু স্বামীসঙ্গ বঞ্চিত চারু যে আমি, তা এই গল্পে স্পষ্ট। আর অমল চরিত্রটি রবীন্দ্র আর বলেন্দ্রর মিশেলে₂ তৈরি। আমার আর বলুর সহজতর সম্পর্কটিকে কুটিল উপায়ে দেবর-বউঠানের সম্পর্কে রূপান্তরিত করেছে রবিবাবু। আরেকটা ব্যাপার এখানে উল্লেখের দাবি রাখে। ‘নষ্টনীড়’-এর অমল ভূপতি-চারুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বিদেশে চলে যায়। আর বাস্তবের বলু আমার আর রবিবাবুর কাছ থেকে চিরবিদায় নিয়ে পরপারে চলে যায়₃। গল্পের চরিত্র, পরিণতি, কাহিনি কিসের ইঙ্গিত করে? আমার সম্পর্কে রবিবাবুর মনের কোন চিত্রটি তুলে ধরে গল্পটি?”
ভবতারিণী দেবীর মাথার বালিশের নিচে পাওয়া সেই খাতার উদ্ধৃত এ অংশের চিহ্নিত বিষয়গুলোতে একটু চোখ বোলাই এবার সবিস্তারে –
রবিবাবু-কাদম্বরীর পুরাতন সম্পর্ক –
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার ছেলেবেলা’ পাঠে রবিবাবু আর কাদম্বরীর মধ্যে মধুর সম্পর্কের প্রমাণ মেলে। পণ্ডিতমশায়ের জন্য আমসত্ত্ব চুরির সূত্রে প্রথম বউঠানের সাথে সখ্য বালক রবীন্দ্রনাথের। কিন্তু আরো আগে, তাঁদের প্রথম দেখা যখন, তখন তাঁদের বয়স ছিল যথাক্রমে আট এবং ছয় বছর। কাদম্বরী আফিম সেবনে আত্মহত্যা করেন পঁচিশ বছর বয়সে। তার যে চিঠির (সুইসাইড নোট) পাঠোদ্ধারের দাবি করেছেন রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, তাতে কাদম্বরী দাবি করেছেন রবীন্দ্রনাথকে তিনি সতেরো বছর চেনেন। এই সতেরো বছরে যত দিন গেছে, বয়স যত বেড়েছে দুজনের, সম্পর্কের রসবিচারে মাধুর্য থেকে আদিরসের দিকে এগিয়েছে বলেই দাবি আছে সেই সুইসাইড নোটে। কাদম্বরী লিখেছেন –
‘হাতে ছিল আমার সেলাইয়ের কাজ। আমি মাথা নীচু করে তোমার পাশে বসে সেলাই করতে লাগলুম। তোমার আকাশের মতো গান, তার সমস্ত মেঘ-বৃষ্টি-ঝড়-বিদ্যুৎ নিয়ে, আমার সমস্ত শরীরের ওপর ছড়িয়ে দিলে আদর। এমন আদর তোমার কাছ থেকে আমি কোনওদিন পাইনি।
বৃষ্টি ধরে এল। তোমার গান থামল। আমি আমার সেলাই বন্ধ করে জানালার বাইরে ঝাপসা গাছগুলোর দিকে চেয়ে রইলুম। মনে হল, আমার জীবনের মতোই ঝাপসা ওরা।
তারপর একটিও কথা না বলে আমি আমার ঘরে ফিরে এলাম চুল বাঁধতে। ঠাকুরপো, সেদিন আমি গা ধুইনি। পাছে ধুয়ে যায় তোমার আদর। যেমন ধুয়ে যায় নাগকেশরের সোনালি রেণু বৃষ্টিতে। ঠাকুরপো, আমি তোমাকে চিনি, জানি, কাছে পেয়েছি, ভালোবেসেছি ১৭ বছর ধরে।’
চিঠির একেবারে শুরুতে কাদম্বরী লিখেছেন –
“প্রাণের রবি,
এই সবে শুরু হয়েছে আমার জীবনের শেষ দিন। পুবের আকাশ সবে লাল হচ্ছে। আজকাল তোমার ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয়। সেটাই তো স্বাভাবিক। মাত্র চারমাস বিয়ে হয়েছে তোমার। আগে তো সূর্য ওঠার আগে তুমি উঠতে। আমার ঘুম ভাঙাতো তোমার সকালবেলার গান। আমরা একসঙ্গে যেতাম নন্দনকাননে। আমার ঘরের পাশে ছাদের উপর যে-বাগানটি একসঙ্গে করেছিলাম আমরা, তুমি তার নাম দিলে নন্দনকানন, তারপর একদিন সেই বাগানে ভোরের প্রথম আলোয় আমাকে চুমু খেয়ে জিগ্যেস করলে— ‘নতুন বউঠান, নামটা তোমার পছন্দ হয়েছে?’ আমার সমস্ত শরীর তখন কাঁটা দিচ্ছে। আবার ভয়ে বুক করছে দুরদুর।”
এরপর সে চিঠিতে নতুন বউঠান দাবি করেন তাঁর ভয় কাটাতে রবিবাবু হাসতে হাসতে বলেছিলেন – নন্দনকাননে মর্ত্যলোকের দৃষ্টি গিয়ে পৌঁছায় না।
এই জায়গায় এসে আবার ভবতারিণী দেবীর শরণাপন্ন হতে হবে।
কাদম্বরীর মৃত্যুর চারমাস আগে রবি-ভব’র বিয়ের আসরে চলছে ভাঁড়কুলো খেলা। একপর্যায়ে রবিবাবু ভাঁড়গুলো উপুড় করে দিতে লাগলে তাঁর ছোটো কাকিমা ত্রিপুরাসুন্দরী প্রতিবাদ করেন।
জবাবে রবিবাবু বললেন – জানো না, কাকিমা – সব যে ওলটপালট হয়ে গেল। সবকিছুই যখন ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে, ভাঁড়গুলো আর সোজা রেখে লাভ কী! তাই ওগুলোকে এলোমেলো করে দিলাম।
এই ওলটপালট হয়ে যাওয়ার গূঢ়ার্থ আসলে রবীন্দ্রনাথ-কাদম্বরীর সম্পর্ককে নির্দেশ করে। ঠাকুরবাড়ির সকলেই এই সম্পর্কের ব্যাপারে অবগত ছিলেন বলা চলে। কোনো কোনো সূত্র বলে – এই সম্পর্ককে ধামাচাপা দেবার লক্ষ্যেই রবীন্দ্রনাথের বিয়ের আয়োজন। অবশ্য সেই বিয়ের কন্যা দেখতে স্বয়ং কাদম্বরী তবে কী করে গেছিলেন যশোরে?
যা হোক, এই পুরাতন সম্পর্কের রেশ পাওয়া যাচ্ছে ‘নষ্টনীড়’ গল্পে। ভূপতির পড়ে থাকা জমিতে গল্পের অমল-চারু “উভয়ে মিলিয়া কিছুদিন হইতে ছবি আঁকিয়া, প্ল্যান করিয়া, মহা উৎসাহে এই জমিটার উপরে একটা বাগানের কল্পনা ফলাও করিয়া তুলিয়াছে।”
এ গল্পের শুরুর দিকে দেখা যাচ্ছে মন্দাকিনীকে চারু-অমল উভয়েই সচেতনভাবে এড়িয়ে চলছে। এই ধারায় কাহিনি যতক্ষণ চলেছে নন্দনকানন প্রসঙ্গ ধরে বলা যায় এ গল্পে সেই পুরাতন সম্পর্কের রেশ এসেছে।
অমল চরিত্রে কার ছায়া?
কাদম্বরী দেবী তাঁর সুইসাইড নোটে বিহারীলাল চক্রবর্তীর প্রতি তাঁর প্রেমের ব্যাপারে স্বীকারোক্তি জানিয়েছেন। কাদম্বরী একবার বিহারীলালকে একটা আসন বুনে দিয়েছিলেন।
এদিকে ‘নষ্টনীড়’ গল্পে অমলকে কার্পেটের জুতো সেলাই করে দিচ্ছে চারুলতা।
বলেন্দ্রনাথ প্রবন্ধসাহিত্যে বিশেষ নাম করেছিলেন। আর রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের কোন শাখায় অবদান ছিল না, সে ত গবেষণার বিষয়। বলেন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথ উভয়ের প্রভাবে যে অমল, সেটা এক্ষেত্রে মোটামুটি ভালো অনুমান বলা যায়।
মোটাদাগে অমল চরিত্রে বলেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, বিহারীলাল – তিনের ছায়াই পাওয়া যায়।
বলেন্দ্রনাথ আর অমলের বিদায় –
বলেন্দ্রনাথ আর ভবতারিণীর মেলামেশাকে রবিবাবু সহজভাবে নেননি বলে দাবি ভবতারিণীর। আমাদের মনেও একই প্রশ্ন – বলুর চিতা দেখতে যেতে ভবতারিণীকে কেন বাধা দিলেন রবিবাবু?
বলুর মৃত্যুর দুবছর পর লেখা গল্পে অমলকে তিনি বিলেতে পাঠালেন। অমলের সাথে সম্পর্কের গূঢ়ার্থ ধরা পড়লে চারুকে ভূপেন একরকম ত্যাগ করলেন। ব্যক্তিজীবনে ভবতারিণীর মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ তেমন বিচলিত হয়েছেন বলে মনে হয়নি। এক্ষেত্রে অবশ্য ইন্দিরা দেবীর ‘রবীন্দ্রস্মৃতি’ থেকে কিছু কথা উল্লেখযোগ্য –
“আমাদের স্তরের মধ্যে প্রচলিত স্নেহ দয়া মায়া মমতা অনুরাগ বিরাগ শোক আনন্দ প্রভৃতি মনোভাবগুলি যেভাবে প্রকাশ পায় তাতেই আমরা অভ্যস্ত, সুতরাং, অপর কোনো ব্যক্তিতে যদি সেই প্রকাশের ব্যতিক্রম দেখি তখন মনে হয় সে বেদনাবোধই বোধ হয় তাঁর নেই। রবিকাকা সাধারণভাবে শোক প্রকাশ করতেন না বলে তাঁর ব্যক্তিগত বেদনাবোধ কম ছিল, এ কথা কেউ কেউ মনে করতেন শুনেছি। …”
‘নষ্টনীড়’ গল্পের চারু-অমলের সম্পর্ককে একটা সময় পর্যন্ত সখ্যরস পর্যায়ে রেখে দেওয়ার জায়গায় (চারু ও অমলের সখিত্বে ভূপতি আনন্দ বোধ করিত।) বিচক্ষণ পাঠকমনে প্রশ্ন জাগার কথা – বাস্তবজীবনেও রবীন্দ্রনাথ কি কিছুটা সময় এই সখ্যরসকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন বলে ভেবেছেন?
যদি এর উত্তর অস্তিবাচক হয়, তবে হয়তো শেষমেশ ঈর্ষান্বিত হয়েই সৃষ্টি করেছেন ‘নষ্টনীড়’।
রেজওয়ান আহমেদ : শিক্ষার্থী, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য (৬ষ্ঠ আবর্তন), বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।