কখন সোনার রোদ : কবিতায় প্রকৃতিপ্রেম, আয়নার মতো প্রষ্ফুটিত

রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ রচিত ‘কখন সোনার রোদ’ কবিতায় প্রকৃতিপ্রেম আয়নার মতো পরিস্ফুটিত। এ যেন প্রকৃতির এক দর্পণ। প্রকৃতির ঐতিহ্য, রূপ, রঙ, রহস্য ও বিচিত্রতায় জীবনানন্দ দাশ। তাই প্রকৃতির সঙ্গে কবির একটি গভীর প্রেম পরিলক্ষিত হয়। আর এজন্য জীবনানন্দ দাশকে প্রকৃতির কবিও বলা হয়। তাই মনে হয় এই কবিতাটি লিখতে কবিকে কোনো পরিকল্পনা বা ভাবনায় ডুবে যেতে হয়নি। হৃদয়ের গহীন প্রেম আর দৃশ্যকল্পে তিনি অনায়াসে বাংলার ছয় ঋতুর সমাহার ঘটিয়েছেন ‘কখন সোনার রোদ’ কবিতায়।
প্রসঙ্গত—’রূপসী বাংলার’ কবিতাগুলো রচিত হয় ১৯৩২ সালে অর্থাৎ প্রথম কাব্যগ্রন্থটির ঠিক পরপরই। অথচ এর পরে বনলতা সেনের দ্বিতীয় সংস্করণ (১৯৫২) সহ আরও পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের ভাই অর্থাৎ এই কাব্যগ্রন্থের সম্পাদক অশোকানন্দ দাশের মতে এই বইটি সঠিক সময় প্রকাশ করলে এটিই হত দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ।
‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থের অর্ন্তনিহিত ‘কখন সোনার রোদ’ কবিতাটির শারীরিক গঠনে এটি একটি সনেট । সনেট সাধারণত চতুর্দশপদই সাহিত্য জগতে বিরাজ করতে দেখা যায়। এটা দু‘ভাবে বিভক্ত হয় প্রথম অষ্টকপদ অবশিষ্ট ষষ্টকপদ। এই সনেটটি ২২ মাত্রা বহন করছে প্রতিটি পঙক্তিতে । ১৪ পঙক্তিতেই এর ভাব সম্পূর্ণ হয়ে থাকে। সনেটের একটি বিশেষ ব্যাপার রয়েছে অন্তমিল বিষয়ে- ‘কখন সোনার রোদ’ সনেটটির অন্তমিলগুলো লক্ষ্য করলে দেখতে পাবো- ক, খ, খ, ক, ক, খ, খ, ক, এটা অষ্টকপদ ষষ্টকপদের অন্তমিলের ক্ষেত্রে কখনো কখনো স্বাধীনতা দেখা গেছে। যেমন- ‘কখন সোনার রোদ’ সনেটটিতে ষষ্টকপদে চতুর্থ পঙক্তিতে সেই স্বাধীনতা আমরা দেখতে পাই। সজাগ ও সচেতন ও বাস্তবতার কবি জীবনানন্দ দাশ খুব সচেতন ও নিপুণতার সাথে এই কবিতাটিতে বাংলাদেশের প্রকৃতির রূপ অর্থাৎ ষড়ঋতুর একটি চিত্রকল্প অঙ্কন করেছেন। এবার আমি ‘কখন সোনার রোদ’ কবিতাটির মূল স্রোতের দিকে ফিরে আসি।
অবিশ্রান্তভাবে সুপারি গাছের সারি যখন আঁধারে ডুবে যাচ্ছে এবং মাঠের ওপার থেকে গরম বাতাস ভেসে আসছে তখনই কবির অবচেতন মন গরমে ঘেমে চেতনা ফিরে পেয়ে বলে ‘কখন সোনার রোদ’ নিভে গেছে! আর অনুভব করে চৈত্রের গরমে ক্লান্ত হয়ে নেতিয়ে পড়ে ক্ষুধার্থ চিলের মত তাই ক্ষীণভাবে ফেলছিল শ্বাস। এখানে চিলকে কবি প্রতীকী হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
‘কোন চৈত্রের চ’লে গেছে সেই মেয়ে আসিবে না, ক’রে গেছে আড়ি: ‘এখানে মেয়ে চরিত্রটিকে চিত্রকল্প হিসাবে ব্যবহার করেছেন যার কোন দৃশ্যতা নেই। চৈত্রের গরমে জনজীবন ছটফট করে চিত্ত অস্থির হয়ে পরে। এই দৃশ্যপটই কবি একটি দুরন্ত ও অভিমানি চরিত্রের দ্বারা কল্পচিত্র এঁকেছেন। কারণ এটাই স্বাভাবিক, বাংলাদেশ রূপ বদলের দেশ। তাই বর্ষ পঞ্জিকা অনুযায়ী চলে রূপ বদল বা ষড়ঋতুর বদলের পালা।’
‘ক্ষীরুই গাছের পাশে একাকী দাঁড়ায়ে আজ বলিতে কি পারি’ কবি এখানে বসন্ত পেরিয়ে অভুতপূর্বভাবে গ্রীষ্মে পদাপর্ণ করলেন দেশিও ফল শসার মাধ্যমে। আবার কবি লিখলেন-
‘কোথাও সে নাই এই পৃথিবীতে-তাহার শরীর থেকে শ্বাস
ঝ’রে গেছে ব’লে তারে ভুলে গেছে নক্ষত্রের অসীম আকাশ’
কবি এখানে বলেছেন ঘাম ঝরে গেছে সেই ঋতু চলে গেছে কিন্তু তাকে ভুলে যায়নি বরং তাকে খুঁজেছেন ও প্রশ্ন করেছেন পাব না কি পৃথিবী নিঙাড়ি এবং নক্ষত্রের অসীম আকাশে।
ষষ্টকপদে বলেছেন—
‘এই মাঠে- এই ঘাসে- ফলসা- এ ক্ষীরুয়ে যে গন্ধ লেগে আছে
আজও তার ; যখন তুলিতে যাই ঢেঁকিশাক-দুপুরের রোদে’
ঢেঁকিশাক বর্ষাঋতুতে তরতাজা হয়ে ওঠে এবং এটি উত্তরবঙ্গের মানুষের একটি প্রিয় খাদ্য। কবি সর্তকতার সাহিত এখানে এক ঋতু থেকে আর এক ঋতুতে প্রবেশ করলেন। কিন্তু তিনি ভুলে যাননি ফলসা ও শসার গন্ধ।
‘সর্ষের খেতের দিকে চেয়ে থাকি-অঘ্রাণে যে ধান ঝরিয়াছে,
তাহার দু’-এক গুচ্ছ তুলে নিই, চেয়ে দেখি নির্জন আমোদে’
সর্ষের খেত, ধানঝরা এবং ঝরাধানের দু’এক গুচ্ছ তুলে নেওয়ার মাধ্যমে দুই ঋতুতে অবস্থান করেছেন কবি এখানে। নির্জন আমোদে এই জন্যে বলেছেন তখন ধান কেটে ঘরে তুলে নিয়ে গেছেন কৃষক আর বুনেছেন সরিষা তাই ক্ষেতে সেই সময় লোকসমারোহ দেখা যায় না তেমন। তবে মাঝেমধ্যে খেতের মাঝে ঝরা ধান পড়ে থাকতে দেখা যায়।
‘পৃথিবীর রাঙা রোদ চড়িতেছে আকাঙ্ক্ষায় চিনিচাঁপা গাছে-‘
এখানে রাঙা অর্থাৎ নরম মোলায়েম রোদকে বুঝিয়েছেন। এই রাঙা রোদ দ্রুত চলে যাওয়ার আশা নিয়ে চড়ছে চিনিচাঁপা গাছে। চিনিচাঁপা একটি কলার গাছ এই গাছটি দীর্ঘ হয় না। এখানেও কবি রাঙা রোদ চিনিচাঁপা গাছের উপমা ব্যবহার করে পেরিয়ে এলেন শীতঋতু। অর্থাৎ মিষ্টিমাখা রোদের কনিষ্ঠ দিনগুলো।
বাংলার প্রকৃতি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছিল কবিকে, ছেড়ে যায়নি কখনও। যা সর্বক্ষণ বসবাস করত কবির মননে কবির ভাবনায়। তাই কবি লিখলেন-
’জানি সে আমার কাছে আছে আজো- আজো সে আমার কাছে আছে।’
বিশ্বের খুব কম দেশেই বছরে ছয় ঋতুর দেখা পাওয়া যায়। বাংলায় যুগ যুগ ধরে রয়েছে ছয় ঋতুর বৈচিত্র্য। এই বৈচিত্র্যতা থেকেই পরাবাস্তববাদের কবি ’রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থের ‘কখন সোনার রোদ’ কবিতাটিকে আবহমান গ্রাম-বাংলার উপাদান এবং প্রকৃতির রূপ রঙ দিয়ে সজ্জিত করেছেন। কবিতাটি তুলে ধরা হলো :
কখন সোনার রোদ
কখন সোনার রোদ নিভে গেছে- অবিরল শুপুরির সারি
আঁধারে যেতেছে ডুবে- প্রান্তরের পার থেকে গরম বাতাস
ক্ষুধিত চিলের মতো চৈত্রের এ- অন্ধকারে ফেলিতেছে শ্বাস;
কোন চৈত্রে চ’লে গেছে সেই মেয়ে- আসিবে না, ক’রে গেছে আড়িঃ
ক্ষীরুই গাছের পাশে একাকী দাঁড়ায়ে আজ বলিতে কি পারি কোথাও সে নাই এই পৃথিবীতে- তাহার শরীর থেকে শ্বাস
ঝ’রে গেছে ব’লে তারে ভুলে গেছে নক্ষত্রের অসীম আকাশ;
কোথাও সে নাই আর- পাব নাকো তারে কোনও পৃথিবী নিঙাড়ি?
এই মাঠে—এই ঘাসে—ফলসা এ—ক্ষীরুয়ে যে গন্ধ লেগে আছে আজো তার; যখন তুলিতে যাই ঢেঁকিশাক – দুপুরের রোদে
সর্ষের ক্ষেতের দিকে চেয়ে থাকি- অঘ্রাণে যে ধান ঝরিয়াছে, তাহার দু’-এক গুচ্ছ তুলে নিই, চেয়ে দেখি নির্জন আমোদে পৃথিবীর রাঙা রোদ চড়িতেছে আকাঙ্ক্ষায় চিনিচাঁপা গাছে-
জানি সে আমার কাছে আছে আজো- আজো সে আমার কাছে আছে।’
এক কথায় বলা যায় কবি অবগাহন করেছেন রূপসী বাংলার ‘কখন সোনার রোদ’ কবিতায় প্রকৃতির নিসর্গ প্রেমে এবং উল্লেখ্য উদাহরণ ও চিত্রকল্পের মাধ্যমে বাংলার ভৌগলিক রূপরেখা এঁকেছেন ষড়ঋতুর মাধ্যমে। এই কবিতায় জীবনানন্দ দাশকে প্রকৃতির পুরুষ প্রেমিক বললেও ভুল বলা হবে না। কারণ শুধু এই কবিতাতেই নয়, তাঁর অধিকাংশ কবিতায় প্রকৃতির রূপ ও নৈসর্গিক প্রেম বিরাজ করে এবং প্রায়শই লক্ষ্য করা যায় কল্পিত একটি নারী চরিত্র। তিনি প্রকৃতির মধ্য দিয়ে তাঁর ভাবনা, তাঁর দৃশ্যকল্প এবং রূপকল্পময়তার মধ্য দিয়ে অজস্র কবিতায় শ্রেষ্ঠত্বের স্থান দখল করে রয়েছেন বিশ্বের পাঠক হৃদয়ে। এটাও নিশ্চিত যে সর্বকলেই জীবনানন্দ দাশের কবিতার যাত্রী হয়ে থাকবে এই পৃথিবী ও পৃথিবীর পাঠককুল।
তথ্যসূত্র :
১. মোঃ মনির হোসেন, সম্পাদনা, রূপসী বাংলা, প্রথম প্রকাশ, জুলাই ২০১, প্রকাশক, শিক্ষা প্রকাশ, ৩৪নং নর্থব্রুক হল, ঢাকা, পৃ. ২৭-২৯
২. ঐ, পৃ. ৭৭
হাবিবা বেগম : লেখক, বাংলাদেশ।
কৃতজ্ঞতা বইচারিতার কাছে।
গুরুত্ববহ আলোকপাত
সমালোচক রৃতু বৈচিত্রকে তুলে এনেছেন কবির দৃষ্টিতে। সত্যি চমৎকার।
ধন্যবাদ আপনাকে, ভালো থাকবেন।