নজরুলের প্রবন্ধে ধর্মমাতালদের স্বরূপ উন্মোচন

কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৬) ‘মন্দির ও মসজিদ’এবং ‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রবন্ধদুটিতে মূলতধর্মমাতালদের স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে। ১৯২৬ সালের ২ এপ্রিল কলকাতায় এক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘঠিত হয়। এরই প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে প্রাবন্ধিক ‘মন্দির ও মসজিদ’ প্রবন্ধটি লিখেছেন। আনুষ্ঠানিক ধর্মের জন্য শুধু লোক দেখানো মন্দির-মসজিদ তৈরি করা মানবতাবাদি নজরুলের কাছে অর্থহীন। মানবপ্রেম তখন তাঁর কাছে প্রধান হিসেবে দেখা দেয়। ধর্মের নামে মসজিদ ও মন্দিরকে পুঁজি করে অনাচার, অসদাচরণ ও মানুষ হত্যা ইত্যাদি বিষয়গুলো মানুষকে পশুত্বে পরিণত করে। ধর্মের নামে যারা স্বার্থসিদ্ধি করে নজরুল তাদেরকে চরম ঘৃণা করেছেন। তাই তিনি উভয় জাতিকে একইমোহনায় মিলিত হওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। প্রাবন্ধিক নজরুল নিজেকে হিন্দু বা মুসলিম হিসেবে কখনো উপস্থাপন করেন নি। তিনি নিজেকে ভাবতেন সবসময় একজন মানুষ হিসেবে। তেমন ভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ‘মন্দির ও মসজিদ’ এবংহিন্দু-মুসলমান প্রবন্ধ দুটির অন্তর্নিহিত সারকথায়।
ধর্মান্ধ মুসলমান ও হিন্দু যখন আল্লাহ ও কালির নামে পরস্পর পরস্পরের মাথা ফাটিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে আর্তনাদ করে, তখন সে আর্তনাদকে তিনি ঘৃণা করেছেন। কারণ এদের আর্তনাদে মসজিদ টলে না, আবার দেবতার সাড়াও মেলে না। এক্ষেত্রে মানুষের রক্তে মসজিদ ও মন্দির হয় কলঙ্কিত। এমন অকাজে যারা লিপ্ত তাদেরকে নজরুল বলেছে ধর্মমাতাল। এরা যেমন দেখেনি সত্যের আলো, তেমনি দেখেনি মানব কল্যাণের জয়গান। কোথাও বহু সংখ্যক হিন্দু মিলে একজন মুসলমানকে, আবার কোথাও বহুসংখ্যক মুসলমান মিলে দুর্বল হিন্দুকে মারছে। অর্থাৎ পশুদের হাতে মার খাচ্ছে দুর্বল অসহায় মানুষ। এই পশুশয়তানের চেয়ে বীভৎস এবং শুকুরের চেয়েও কুৎসিত। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য নজরুল এক অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের কথা প্রকাশ করেছেন প্রবন্ধদুটির বিষয়বস্তুর নির্যাসে। যুগে যুগে মানুষকে অবহেলা করে সুবিধা নিয়ে কিছু কিছু মানুষ আছেন যারা আজ মহাপুরুষ বনে গেছেন। প্রাবন্ধিক নজরুল তাদের চরম ধিক্কার জানিয়েছেন। তিনি এ থেকে প্রতিকারের জন্য উত্তরণের আশায় উভয় সম্প্রদায়কে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।
ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ ও ত্রাসে যখন ভারতবর্ষ প্রকম্পিত, তখন ভারতশাসন আইন পাস করে কলাকৌশলী নির্ধারণ গ্রহণকরা হয়। দমন, পীড়ন ও নির্যাতনে দেশ তখন মহামারী আকার ধারণ করে। এ সময়ে দেশের মানুষ ও দেশের স্বাধীনতাকে রক্ষার জন্য প্রাবন্ধিক নজরুল হিন্দু ও মুসলমানদের এক হওয়ার কথা বলেছেন। তিনি তখন উভয় জাতিকে একত্রিত হয়ে মানবতার জয়গান নামক মত্র পাঠ করার পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ হিন্দু ও মুসলমানের বুদ্ধিহীন কৃতকর্ম যেদেশকে ধ্বংসের পথে পরিচালিত করে তাতে সন্দেহ নেই। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য মানুষকে ধর্মীয় গণ্ডির বাইরে আসতে বলেছেন। সেই সাথে জয়গান করেছেন সাম্য ও মানবতার। তিনি ধর্ম অপেক্ষা মানুষকে অনেক বড় ও মহীয়ান হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর কাছে‘এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নেই।’ এমন কথা দ্বারা তিনি তাঁর সুচিন্তিত অভিমত প্রকাশ করে অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন। অসাম্প্রদায়িকতাসম্পর্কে নজরুল ‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রবন্ধে সর্বসাধারণের উদ্দেশ্যে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন ‘অবতার-পয়গম্বর কেউ বলেননি আমি হিন্দুর জন্য এসেছি, আমি মুসলমানের জন্য এসেছি, আমি ক্রিশ্চানের জন্য এসেছি। তাঁরা বলেছেন, আমরা মানুষের জন্য এসেছি¾আলোর মত, সকলের জন্য। কিন্তু কৃষ্ণের ভক্তেরা বললে, কৃষ্ণ হিন্দুর, মুহম্মদের ভক্তেরা বললে, মুহম্মদ মুসলমানদের, খ্রিস্টের শিষ্যেরা বললে খ্রিস্ট ক্রিশ্চানদের। কৃষ্ণ-মুহম্মদ-খ্রিস্ট হয়ে ওঠলেন জাতীয় সম্পত্তি।’ আর এই সম্পত্তিত্ব নিয়েই সৃষ্টিহয়েছেযত বিপত্তি। প্রাবন্ধিক নজরুল হিন্দু-মুসলমান ও খ্রিস্টানদের ঈশ্বর বিষয়ক ভাবনার ঠেলাঠেলি থেকে বের হয়ে এসে মানুষকে বাঁচানোর জন্য মানবিক হওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। ‘আমি একজন মানুষকে বাঁচিয়েছি’ নামক কাতারে আসার জন্যই ‘হিন্দু-মুসলমান’ নামক প্রবন্ধটির সারকথা বিম্বিত হয়েছে।
প্রাবন্ধিক মনে করেন হিন্দু-মুসলমানের যে সংঘাত তার নাম পশুত্ব। তিনি প্রবন্ধে পশুত্বকে লোম ও লেজবিহীন প্রাণী হিসেবে তুলনা করেছেন। লেজ এবং শিং আছে এমন পশুগুলোকে তিনি কম হিংস্র হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আবার এক শ্রেণির প্রাণী আছে যাদের শিং নেই, কেবল লেজ আছে সেগুলো অধিকতর হিংস্র। এ বিষয়ে নজরুল রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ‘হিন্দু-মুসলমান’প্রবন্ধে বলেন ‘হিন্দু-মুসলমানের কথা মনে উঠলে আমার বারে বারে গুরুদেবের ঐ কথাটাই মনে হয়। সঙ্গে সঙ্গে এ প্রশ্নও উদয় হয় যে, এ-ন্যাজ গজালো কি করে? এর আদি উদ্ভব কোথায়? ঐ সঙ্গে এটাও মনে হয়, ন্যাজ যাদেরই গজায়¾তা ভিতরেই হোক আর বাইরেই হোক¾তারাই হয়ে ওঠে পশু।’ ভারতবর্ষে কতিপয় হিন্দু-মুসলমান মূলত ঐ রকম লেজওয়ালা পশু হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে। হিন্দু ও মুসলমান উভয় জাতির লেজ নেই বটে, তবে তাদের চিন্তাভাবনা, কর্মপরিকল্পনা পশুর মতো। তাই আজ তারা ভারতবর্ষে টিকি ও দাড়ি রেখে পশুত্ব অর্জন করতে চায়। এই দুটি অর্জন আজ গোটা ভারতবর্ষকে দাঙ্গা-হাঙ্গামায় অবতীর্ণ করেছে। আল্লাহ বা নারায়ণ মূলত হিন্দুও নয়, মুসলমানও নয়। তার টিকিও নেই দাড়িও নেই। টিকি ও দাড়ি মানুষকে সর্বদা স্মরণ করিয়ে দেয় যে তুমি আলাদা আমি আলাদা। এ বিষয়ে প্রাবন্ধিক‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন হিন্দুত্ব-মুসলমানত্ব দুটিই সওয়া যায়, কিন্তু তাদের টিকিত্ব দাড়িত্ব অসহ্য, কেননা ঐ দুটোই মারামারি বাধায়। টিকিত্ব হিন্দুত্ব নয়, ওটা হয়ত্ব পণ্ডিত্ব। তেমনি দাড়িও ইসলামত্ব নয়, ওটা মোল্লাত্ব। এই দুটি‘ত্ব’ মার্কা চুলের গোছা নিয়েই আজ এতো চুলোচুলি! আজ যে মারামারিটা বেঁধেছে, সেটা এই পণ্ডিত্ব ও মোল্লার মারামারি। ঐ মারামারিটা হিন্দু-মুসলমানের মারামারি নয়। নারায়ণের গদা আর আল্লার তলোয়ারে কোনো দিনই ঠোকাঠুকি বাঁধবে না, কারণ তাঁরা দুজনেই এক। তাঁর এক হাতের অস্ত্র আর এক হাতের ওপর পড়বে না। তিনি সর্বনাম, সকল নাম গিয়ে মিশেছে ওঁর মধ্যে। এত মারামারির মধ্যে এইটুকুই ভরসার কথা যে, আল্লা ওরফে নারায়ণ হিন্দুও নয়, মুসলমানও নয়। তাঁর টিকিও নেই, দাড়িও নেই। একেবারে ‘ক্লিন’। টিকিওদাড়ির উপর আমার এত আক্রোশ এই জন্য যে, এরা সর্বদা স্মরণ করে দেয় মানুষকে তুই আলাদা আমি আলাদা। মানুষকে তার চিরন্তন রক্তের সম্পর্ক ভুলে দেয় এমনবাইরের চিহ্নগুলো। নজরুল এসব থেকে বের হয়ে এসে উভয় জাতিকে একই সারিতে মিলিত হয়ে মানবতার জয়গান প্রচার করার সবিনয় অনুরোধ জানিয়েছেন।
এই পৃথিবীতে যত পীরপয়গম্বর ও অবতার এসেছেন তাঁরা সবাই এসেছেন মূলত মানুষের কল্যাণের জন্য। তাঁরা কখনো বলেননি আমি কেবল হিন্দু বা মুসলমানের জন্য এসেছি। আলোর মতোই ছিলেন তাঁরা সবার জন্য উন্মুক্ত পথের দিশারী। অথচ পয়গম্বর ও অবতারদের সীমিত করেছে টিকিওয়ালা ও দাড়িওয়ালা নামক সুবিধাবাদী, সুবিধাভোগীরা। কৃষ্ণের ভক্তেরা কৃষ্ণকে তাদের নিজের, মোহাম্মদ (স.) এঁর অনুসারীগণ মোহাম্মদ (স.) কে নিজের এবং খ্রিস্টের ভক্তরা খ্রিস্টকে নিজ নিজ সম্পত্তি মনে করেন। এমন কৃতকর্মকে নজরুল বিপত্তি হিসেবে দেখেছেন। আলো নিয়ে কখনো ঝগড়া করাচলে না, বরং ঝগড়া করলে বুদ্ধিহীনতা প্রকাশ পায়। ছেলেবেলায় চাঁদ ও সূর্যকে সবাই নিজের পাড়ার সম্পত্তি হিসেবে মনে করতেন। তবে চাঁদ ও সূর্য কোনো বস্তুগত সম্পত্তি নয়। সেটি বড় হলেই ছেলে-মেয়েরা বুঝতে পারে, তেমনি স্রষ্টাও বস্তুগত কোনো সম্পত্তি নয়। তাই এ নিয়ে বা এর মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব না করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রাবন্ধিক প্রবন্ধদুটির ভাবসম্মিলনের মধ্য দিয়ে। সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে নজরুল যেমন ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, তেমনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন। কারণ সাম্প্রদায়িকতার মতো ‘আদিম’ দুরন্ত ইচ্ছার কাছে মানুষের প্রগতি লজ্জাজনকই শুধু নয়, মানবতারও পরাজয়। শুভ্র মনুষ্যত্ববোধের অভাব থেকে ওর জন্ম। এ কারণেই বোধটা মানবেতর, ধর্মহীন মানবতা পরিপন্থী। নজরুল মানবধর্মের কবি। সার্বজনীনতা তাঁর কবিধর্ম। মহৎ প্রতিভার প্রধান বৈশিষ্ট্যই হলো সার্বজনীনতা। কুলধর্ম তাঁদের ক্ষেত্রে দৈব এবং দৈবকে অতিক্রম করতে পারেন বলেই তাঁরা মহৎ।
প্রাবন্ধিক নজরুল ‘মন্দির ও মসজিদ’ এবং ‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রবন্ধ দুটির মধ্য দিয়ে ধর্ম নিয়ে মতান্তর বা বিভেদ সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। সব ধর্মের মানুষের জীবনধারাকে অখণ্ডজীবনধারায় পরিণত করার প্রতি তাঁর প্রবল ঝোঁক ও ইচ্ছাশক্তি ছিল প্রখরতায় পরিপূর্ণ। তাঁর প্রবন্ধের আবেদনে স্থান পেয়েছে অস্তিতাববাদী ও মানবতাবাদী চিন্তার নিঃশঙ্ক প্রকাশ। তিনি উভয় জাতিকে ধর্মের বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে অবতীর্ণ হওয়ার পরিবর্তে অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের পরিচয়কে লালন করতে বলেছেন। তিনি প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন ধর্মের ভেদহীন নীতিকে দূর করার জন্য। প্রাবন্ধিক নজরুল ইসলামের কাছে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষ সমানভাবে শ্রদ্ধা-ভালোবাসা ও সম্মানের অধিকারী। তাই তিনি ‘মন্দির ও মসজিদ’ এবং ‘হিন্দু-মুসলমান’ প্রবন্ধে ধর্ম নিয়ে ভেদবুদ্ধিহীন বিড়ম্বনা থেকে বের হয়ে আসার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। এখানে নজরুলকে কেবল একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ হিসেবেই পাওয়া যায় না, বরং তিনি সম্পূর্ণ মানবিক। ধর্ম নিয়ে বাদানুবাদের পরিবর্তে তিনি কামনা করেছেন ‘ক্ষুধাতুর শিশু চায়না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত একটু নুন।’ এমন কথার মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হয়েছে উভয়ধর্মের ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না করা। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না করে দেশের সর্বস্তরের মানুষ যেন খেয়ে-পরে সম্মানের সাথে বেঁচেথাকতে পারে তারই কামনা ও প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম : গবেষক, প্রাবন্ধিক, ইতিহাসজ্ঞ এবং সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, নওগাঁ সরকারি কলেজ, নওগাঁ, বাংলাদেশ