মফস্বল দর্পণ

সম্মুখে ঢাকা-পাবনা হাইওয়ে। আজ হাইওয়েদের ছুটি। নেই লোক সমাগম, ছোটাছুটি নেই যানবাহনদের। দীর্ঘ ক্লান্তির পরে আজ তারা নিঃশ্বাস ফেলবে স্বস্তির। নানা রকম পাখির ডাকে ভরে আছে এপার-ওপার। মনে হচ্ছে গ্রামের পিচ ঢালা কোনো রাস্তা। কালভদ্রে মনুষ্য যাতায়াত ঘটে থাকে। কেবল পাখিদের রাজত্ব তাতে। ওপারে সোনালু ঝুলে আছে থোকেথোকে। পাতাদের আন্দোলনে মৃদুমন্দ বাতাস এসে লাগছে গায়ে৷ পাখির ডাকগুলো সব অচেনা। একটা বোধহয় ডাহুক। রেইনট্রির শরীর জুড়ে কাঠ ঠোকরা চাষ করে চলেছে৷ কাক, দোয়েল আর শালিককে অনায়াসেই চেনা যাচ্ছে।
এই যে পাখিদের আন্দোলন, এটুকুই আমার রোজবারের ঈদ আনন্দ। এই আনন্দটুকু পেতে সবার অলক্ষ্যে চলে আসতে হয় দৃশ্যপটের কাছে। টুপ করে পাকা কাঁঠাল পাতা ঝরে পড়বে, কাঁচাপাকা আমগুলো দোল খাবে, নারিকেলের চিরল পাতা নৃত্য করবে। এটুকুই আমার ঈদ আনন্দ। সবাই যখন ঈদগাহে নামাজ আদায় করতে যায়, শুধু তখনই এসব দৃশ্যের অবতারণা হয়৷ নয়তো বছরের আর কোনো সময়েই এসব দৃশ্য দেখা যায় না। কী ভীষণ যানজট, কোলাহল হরদম, করাত কলের ঘ্যাচাং, ইটভাটার ধোয়ায় আচ্ছন্ন, ব্যস্ত গাড়িদের হর্ণ, উপর শ্রেণির মানুষদের প্রতিযোগিতা, দিন মজুরের ঘাম, রিক্সাওয়ালার টুংটাং এসবই অধিকার করে আছে মফস্বলটাকে। একে আর মফস্বল বলা যায় না। শহরের ধরাছোঁয়া সবখানে। মফস্বল কখনো গ্রাম হয় না, শুধু শহরের দিকেই ধাবিত হয়ে যায়। কিন্তু আমরা শহর চাই না, গ্রামও না হোক, অন্তত মফস্বলটাই বেঁচে থাক।
এই যে শুদ্ধ বাতাস, ঈদের দিনে সকালে হঠাৎ করে লোকশূন্য হয়ে যাওয়া আমাদের শহরটা, পাখিদের নেমে আসা, দিনমজুর মানুষগুলোর শাদা তৃপ্তির হাসি, কড়কড়ে নতুন লুঙ্গির আনন্দ, এইসব বেঁচে থাক আমাদের শহরটায়। অন্তত এই একদিনে তো আমরা তাদের আলসে চলাফেরার সাক্ষী হতে পারবো। এই মানুষগুলোর জন্য, এইটুকু দৃশ্যপটের জন্যই আমি এখনো মফস্বলে আছি। নয়তো শহুরে ধাঁচের কথিত মফস্বলে থাকা যেতো না। আমার মফস্বলের ঈদের এটুকুই চিত্র। এছাড়া আর কোথাও কোনো পরিবর্তন নেই বছরের অন্যান্য দিনগুলোর সাথে।
আমার মফস্বলের ঈদ কেটেছে ভয়ানকভাবে। না পেয়েছি গ্রামীণ আবহ, না পুরোদম শহুরে অবস্থা। পরিবার ছিলো কড়া নিয়মতান্ত্রিক। সূর্যদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দারুণ শৃঙ্খলা। এই শৃঙ্খলা ও শাসনের ঘেরাটপে ঈদ কোনো তারতম্য বয়ে আনেনি আমাদের মফস্বল কথিত শহুরে জীবনে। শুধুমাত্র সূর্যের গমনাগমই ছিলো অবারিত। সূর্য ব্যতিত সবকিছুর সাথেই ছিল পারিবারিক বেড়াজাল। এই বেড়াজাল এখন শিথিল হয়ে পড়েছে। পরিবারের সকলে মানিয়ে নিয়েছে, জীবন চলে গেছে অনেকটা পথে। সেই পথ থেকে যখন সকালে ফিরে এলাম পুরনো সেই দৃশ্যপটে, দেখলাম দৃশ্যপট শহুরে ব্যস্ততায়ও হারিয়ে যায় নি। শুধু আমরাই ছেড়ে গেছি তাদের। এই যে ছেড়ে যাওয়া, জীবনের পথে হাঁটা, আজ এসে দেখলাম আমাদের নিয়মতান্ত্রিক জীবনে অন্যান্য কিছুর মত কোনো মানুষও প্রবেশ করেনি যাদের সাথে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়া যায়, যাদের হাত ধরে চোখ বুঝে আমার সামনের হাইওয়েটা পার হওয়া যায়, যাদেরকে অনায়াসেই স্নেহ দেয়া যায়, ভালোবাসা যায়। যাদের ঈদ আনন্দে নিজেদের আনন্দিত হওয়া যায়, যাদের নিয়ে রোজকার উঠাপড়া আবর্তিত হয়ে যায়।
শূন্য হাতে প্রতিবার এসে দাঁড়াই এখানে। আমাদের শৃঙ্খলিত মফস্বলি জীবন আমাদের যান্ত্রিক করেছে। অনুভূতিকে দলিত করে দিয়েছে অনেক আগে। এই যান্ত্রিকতার জীবনে আমরা রিক্ত হস্তে খেলছি সময়ের সাথে। আমাদের যান্ত্রিক সময়ের ঈদ আমাদের আন্দোলিত করতে পারেনি কোনোকালে।
তাই বলি, গ্রামীণ জনপদের সাথে ছেদ কোরো না জীবনের।