রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের অমৃত বন্ধন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) ও কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) তাঁরা দুজন বাংলা সাহিত্যের আলোকিত সাহিত্যিক। আলোর ঝরনা ধারায় তাঁরা সৃষ্টি করে গিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল যা দিয়ে গিয়েছেন তা হলো অতুলনীয়। তাঁদের হাতে ছিল লেখনীর হাসি আর ফুলের রঙে রং ভরা। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের অমৃত বন্ধন ছিল অপূর্ব। দুজনায় ছিল শ্রদ্ধা ও স্নেহে ভরা এক মধুর সম্পর্ক। যা থেকে ফুটে উঠেছে মাধুর্য ও পরস্পর পরস্পরের প্রতি দাযিত্ববোধ। উভয়ের মধ্যে একজন অন্যজনকে তৃতীয় নয়ন দিয়ে চেনা এক মহামূল্যের দর্শন। এই প্রবন্ধ লেখার প্রয়াস তাঁদের দুজনের মধ্যে কোনভাবেই তুলনামূলক বিচার করা নয়। বরং তাঁদের দুজনের মধ্যে আত্মার সম্পর্ক তুলে ধরার চেষ্টা।
রবীন্দ্রনাথের সাথে নজরুলের সাক্ষাতের আগে একজন আরেকজন সৃষ্টির মাধ্যমে পরিচিত হয়েছিলেন। নজরুল বিদ্যালয় জীবনেই রবীন্দ্রনাথের রচনার সাথে পরিচিত। রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সাথে কবিতার মাধ্যমে পরিচিত হয়েছিলেন। নজরুল বাল্যকাল থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীত অনুরাগী ছিলেন। একদিন রবীন্দ্রনাথ কথায় কথায় সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কাছে নজরুলের কবিতার প্রশংসা করেন। সত্যেন্দ্রনাথের কাছে নজরুল এই কথা শুনে অভিভূত হয়ে পড়েন। নজরুল তাঁর বেড়ে ওঠা জীবনে রচিত সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের রচনার প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি তুলে ধরেছেন। যেমন : ব্যথার দান ছোটগল্পে রবীন্দ্রনাথের তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা গানটির যে অংশটুকু তুলে ধরেছেন সেটি হলো :
‘তুমি আমারি, তুমি আমারি,
মম বিজনজীবনবিহারি ॥’
[কাজী নজরুল ইসলাম : নজরুলের ছোটগল্প সমগ্র, ব্যথার দান, পৃ.২২] এই গানটি গীতবিতানে ‘প্রেম’ পর্যায়ে উল্লিখিত। [ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : গীতবিতান, পৃ. ১৭৬]
ব্যথার দান’ ছোটগল্পে রবীন্দ্রনাথের অপর একটি গানের যে অংশটুকু তুলে ধরেছেন সেটি হলো:
‘যদি আর-কারে ভালোবাস, যদি আর ফিরে নাহি আস,
তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও, আমি যত দুখ পাই গো ॥
আমার পরান যাহা চায় তুমি তাই, তুমি তাই গো।
তোমা ছাড়া আর এ জগতে মোর কেহ নাই, কিছু নাই গো ॥’
[কাজী নজরুল ইসলাম : নজরুলের ছোটগল্প সমগ্র, ব্যথার দান, পৃ. ৩২] এই গানটি গীতবিতানে ‘প্রেম’ পর্যায়ে উল্লিখিত। [রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : গীতবিতান, পৃ. ১৯৯]
এই ছোটগল্পে আরও একটি রবীন্দ্র সঙ্গীত নজরুল সন্নিবেশিত করেছেন। সেটি হলো-
‘আমার সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে দিবস গেলে করব নিবেদন-
আমার ব্যথার পূজা হয় নি সমাপন ॥’
[কাজী নজরুল ইসলাম : নজরুলের ছোটগল্প সমগ্র, ব্যথার দান, পৃ. ৩৪] এই গানটি গীতবিতানে ‘পূজা’ পর্যায়ে উল্লিখিত। [রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : গীতবিতান, পৃ. ৭৪]
‘ব্যথার দান’ গ্রন্থটি প্রথম পাঠকদের কাছে এসে পৌঁছে ১৯২২ ইংরেজিতে। প্রথম প্রকাশ, ‘ব্যথার দান’ ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মোতাবেক ১৩২৮ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়, প্রকাশক, এম. আফজাল-উল-হক, মুসলিম পাবলিশিং হাউস, কলেজ স্কোয়ার, কলকাতা, মুদ্রক, শশিভূষণ পাল, মেটকাফ প্রেস, ৭৯ বলরাম দে স্ট্রীট, কলকাতা, পৃষ্ঠা সংখ্যা-১৪৭, মূল্য-দেড় টাকা।’ তথ্যসূত্র : নজরুল-গ্রন্থপঞ্জী ও নজরুল-বিষয়ক গ্রন্থাবলী : পৃ. ২৪।
‘রিক্তের বেদন’ এই ছোট গল্পটিতেও নজরুল রবীন্দ্রসঙ্গীত সন্নিবেশিত করেছেন। সেটি হলো-
‘ দুজনে দেখা হল মধুযামিনী রে-
কেন কথা কহিল না,চলিয়া গেল ধীরে ॥
নিকুঞ্জে দখিনাবায় করিছে হায়-হায়,
লতাপাতা দুলে দুলে ডাকিছে ফিরে ফিরে ॥
দুজনের আঁখিবারি গোপনে গেল বয়ে
দুজনের প্রাণের কথা প্রাণেতে গেল রয়ে।
আর তো হল না দেখা, জগতে দোঁহে একা-
চিরদিন ছাড়াছাড়ি যমুনাতীরে ॥’
[কাজী নজরুল ইসলাম : নজরুলের ছোটগল্প সমগ্র, রিক্তের বেদন, পৃ. ১০৪] এই গানটি গীতবিতানে ‘প্রেম ও প্রকৃতি’ পর্যায়ে উল্লিখিত। গীতবিতান, পৃ. ৪৮৪]
‘রিক্তের বেদন’, প্রথম প্রকাশ ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর (পৌষ, ১৩৩১) মাসে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়, প্রকাশক, ওরিয়েন্টাল প্রিন্টার্স এন্ড পাবলিশার্স লিমিটেড ২৬/৯/১-এ, হ্যারিসন রোড, কলকাতা, পৃষ্ঠা সংখ্যা-৪+১৬০, মূল্য-দেড় টাকা।’ [নজরুল-গ্রন্থপঞ্জী ও নজরুল-বিষয়ক গ্রন্থাবলী, পৃ. ২৬]
নজরুলের রচনায় যে ভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার হয়েছে তা থেকে তাঁর পরিশীলিত এবং আধুনিক রুচির পরিচয় সুন্দরভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মধ্যে প্রথম কবে কখন ও কোথায় দেখা হয়েছিল সেগুলো নিয়ে নানা মতবাদ রয়েছে। এই প্রসঙ্গে কিছু মতবাদ তুলে ধরা হলো :
ক. রবীন্দ্রনাথের সাথে নজরুলের ‘প্রথম সাক্ষাৎ হয় শান্তি নিকেতনে ১৯২১ এর অক্টোবরে। সেবার নজরুলের সঙ্গী ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।’ [গোপালচন্দ্র রায় : রবীন্দ্র-নজরুল : একটি সাক্ষাৎকার, রবীন্দ্রনাথ নজরুল, পৃ. ৯৫]
খ. সুলতান মাহ্মুদ মজুমদার বলেছেন, আমি নজরুলের মুখ থেকে শুনা :
‘রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের প্রথম সাক্ষাৎ ঘটেছিল ১৯২১ ইং সনের আগস্ট মাসে, এক সকাল বেলা, কলকাতায়, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে। প্রথম সাক্ষাতেই পেয়েছেন রবি ঠাকুরের হে, খেয়েছেন ভীম নাগের সন্দেশ-অবাক জলপান, বুঝেছেন ঠাকুরবাড়ির খানদান, গেয়েছেন গান; আপ্সোস রয়েছে-খেতে পাননি পান। যদ্যপি কবিগুরুর সামনেই ছিলো পানদান ও পিকদান।’ [সুলতান মাহ্মুদ মজুমদার : ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি, পৃ. ১১০)]
গ. ‘সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় বলেেেছন যে, জোড়াসাঁকোর বাড়িতে নজরুল একদিন ‘দে গরুর গা ধুইয়ে’ বলে চিৎকার করতে করতে রবীন্দ্রনাথের ঘরে ঢুকে পড়েন। অবিনাশ ভট্টাচার্য্যরে বর্ণনা অনুযায়ী-তিনি নাকি শুনেছিলেন স্বয়ং নজরুলের কাছে। ‘বিজলী’ পত্রিকায় ‘বিদ্রোহী’ কবিতা পুনর্মুদ্রিত হলে নজরুল তাঁর কয়েকটি কপি হাতে করে রবীন্দ্রনাথের বাড়ি এসে ‘গুরুজি’ ‘গুরুজি’ বলে চেঁচাতে থাকেন। রবীন্দ্রনাথও ওপর থেকে জানতে চান, ‘কী কাজী, অমন ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছ কেন, কী হয়েছে ?’ নজরুল বলেন, ‘আপনাকে হত্যা করব।’ তারপর জ্যেষ্ঠের সামনে দাঁড়িয়ে হাত-পা নেড়ে ‘বিদ্রোহী ’ আবৃত্তি করেন কনিষ্ঠ এবং রবীন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে উঠে নজরুলকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘হ্যাঁ, সত্যিই তুমি আমাকে হত্যা করবে।’এসব ঘটনা বিশ্বাস করা শক্ত। মনে হয়, ষাট বছর বয়সের রবীন্দ্রনাথের ঘরে যখন-তখন প্রবেশ করা যেতো এবং কেউ ডাকছে বুঝতে পারলেই তিনি অমনি ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেন। নজরুলকেও শুধু আবেগপ্রবণ নয় কা- জ্ঞানহীন মনে হত-যা তিনি কখনো ছিলেন না। সম্ভবত, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মুখেই নজরুল প্রথম শোনেন যে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতার প্রশংসা করেন। আর রবীন্দ্রনাথের সচিব সুধাকান্ত রায় চৌধুরীর দৌত্যে দুই কবির সাক্ষাৎকার ঘটে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ও নজরুল ইসলাম একসঙ্গে শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন কলকাতা থেকে। ট্রেনে শহীদুল্লাহ্কে নজরুল নাকি ‘ গীতাঞ্জলি’ র সবকটা গান শোনান। শহীদুল্লাহ্ একথা রবীন্দ্রনাথের কাছে উল্লেখ করলে তিনি বলেন, ‘অসম্ভব স্মৃতিশক্তি তো ! আমার ‘গীতাঞ্জলি’র সবকটা গান আমারই মনে থাকে না।’ নজরুল রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে গান ও আবৃত্তি শুনতে চান। রবীন্দ্রনাথ পালটা অনুরোধ করেন নজরুলকে। তিনি তখন তাঁর ‘আগমনী’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন। এই বিবরণ দিয়েছেন সুধাকান্তের ভাই নিশিকান্ত-তিনি তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আর ‘রবীন্দ্র-জীবনী’ তে প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় ওই সময়ে যে তাঁদের সাক্ষাৎ হয়েছিল তা উল্লেখ করেছেন।’ [আনিসুজ্জামান : রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল : ব্যক্তিগত যোগাযোগ, রবীন্দ্রনাথ নজরুল, পৃ. ৮৫]
ঘ. নজরুল রবীন্দ্রনাথকে বললেন, ‘গুরুদেব’ ! আপনার একটি আবৃত্তি ও একটি গান শুনার জন্যে একান্ত উৎসুক হয়ে আছি। ‘কবিগুরু জানালেন-গান এখন আর গাইতে পারি না, সুর ভুলে যাই। আমার একটি সম্প্রতি লেখা গান, কবিতায় আবৃত্তি করি। তোমরা যেমন হঠাৎ এসেই চলে যেতে চাচ্ছ, আমার গানের মাধবীও তেমনি হঠাৎ এসেই চলে যেতে চায়। কবিগুরুর সুললিত ও রমণীয় কণ্ঠে বেজে উঠল :
‘মাধবী হঠাৎ কোথা হতে
এল ফাগুন দিনের স্রোতে
এসে হেসেই বলে, ‘যাই যাই যাই’।
কবিগুরু যতক্ষণ আবৃত্তি করছিলেন, ততক্ষণ কবি নজরুলের কালো বাবরি চুলের মাথাটি আবৃত্তির তালে তালে দুলছিল এবং তাঁর মুখ-চোখ একটা আবেশমুগ্ধ অভিব্যক্তি প্রকাশ করছিল। আবৃত্তি শেষ করে কবিগুরু দাঁড়িয়ে উঠলেন এবং সমবেত সকলেই দাঁড়িয়ে উঠলেন। বিদায়ের একটি অনুচ্চারিত বেদনার সুর বেজে উঠল।’ [রফিকুল ইসলাম : রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল, রবীন্দ্রনাথ নজরুল , পৃ. ৪৪]
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মধ্যে কবে কখন কোথায় প্রথম দেখা হয়েছিল সেটা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও দু’জনায় একাধিক বার দেখা হয়েছে এটা নিয়ে কোন বিতর্ক নেই।
‘১৯২২ সালের ১১ আগস্ট, বাংলা ১৩২৯ সালের ২৬ শ্রাবণ তারিখে ‘ধূমকেতু’ প্রথম প্রকাশিত হয় । পত্রিকার প্রচ্ছদে ‘ হপ্তায় দু’বার দেখা দেবে’ -এই ঘোষণা দিয়ে পত্রিকাটি বের হয়েছিল। অর্থাৎ এটি ছিল অর্ধ-সাপ্তাহিক পত্রিকা, ইংরেজিতে যাকে বলে By weekly, পত্রিকাটির বার্ষিক মূল্য ৫্ টাকা নগদ মূল্য প্রতি সংখ্যা /. আনা। ক্রাউন ১৫” * ২০” পৃষ্ঠার মাপে প্রথম ১৬ পৃষ্ঠার পত্রিকা বের হয়। কাগজ সাধারণ নিউজ প্রিন্ট।’
[সেলিনা বাহার জামান : সম্পাদকীয়, নজরুলের ধূমকেতু]
‘ধূমকেতু’র প্রথম সংখ্যা থেকে প্রতিটি সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাণীটি ছাপা হতো। প্রথম থেকে ছয়টি সংখ্যায় ছাপা অক্ষরে, সপ্তম সংখ্যা থেকে হস্তলিপিতে ছাপা হতো। আশীর্বাণীটি নিন্মরূপ:
কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু
আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু,
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,
দুর্দ্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন !
‘অলক্ষণের তিলক রেখা
রাতের ভালে হোক না লেখা,
জাগিয়ে দে রে চমক মেরে ’
আছে যারা অর্দ্ধচেতন !
২৪ শ্রাবণ ১৩২৯ শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
[নজরুলের ধূমকেত : পৃ. ২]
২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২ ইংরেজিতে ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার ১২ নং সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এই সংখ্যায় নজরুলের ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ নামক কবিতাটি প্রকাশিত হয়। কবিতাটিতে প্রচ্ছন্ন রাজনীতি ফুটে উঠে। কবিতাটি প্রকাশের পরে পুলিশ ‘ধূমকেতু’ কার্যালয়ে হানা দেয় ১৯২২ ইংরেজির ৮ নভেম্বরে। তার কয়েকদিন পরে নজরুল গ্রেফতার হন কুমিল্লায়। কবি কারারুদ্ধ হওয়ার পরে অমরেশ কাঞ্জিলাল ধূমকেতু বের করেন। নজরুলকে গ্রেফতার করে রাজদ্রোহিতার অভিযোগে তাঁর বিরেুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। সে সময় নজরুলের পক্ষে বেশ কয়েকজন আইনজীবী বিনা পারিশ্রমিকে এগিয়ে আসেন। নজরুল বিচারের সময় আত্মপক্ষ সমর্থন করে আদালতে যে বিবৃতি দেন, তা বাংলা সাহিত্যে ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ নামে পরিচিত।
১৯২৩ ইংরেজির ১৬ জানুয়ারি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহো নজরুলের মামলার রায় দেন। ভারতীয় ফৌজদারি দ-বিধির ১২৪-ক এবং ১৫৩-ক ধারা অনুযায়ী ‘ধূমকেতু’ রাজদ্রোহ মামলায় তাঁকে এক বৎসর সশ্রম কারাদ-ে দ-িত করা হয়। বিচারাধীন অবস্থায় নজরুল ছিলেন প্রেসিডেন্সি জেলে। তাঁকে বিচার শেষে ১৭ জানুয়ারি আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
‘নজরুল কারাবরণ করে সমগ্র দেশবাসীর যে শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যটি নজরুলকে উৎসর্গ করে সেই শ্রদ্ধা প্রকাশ করেন। নজরুল তখন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দী। রবীন্দ্রনাথ সে সময় ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ২২ ফেব্রুয়ারি ‘বসন্ত’ নজরুলকে উৎসর্গ করেন। তিনি উৎসর্গ পত্রে লিখেছিলেন,
উৎসর্গ
শ্রীমান কবি নজরুল ইসলাম হে ভাজনেষু
১০ ই ফাল্গুন ১৩২৯
বসন্ত নজরুলকে আলিপুর জেলে পৌছে দেবার জন্যে রবীন্দ্রনাথ পবিত্র গঙ্গোপাধ্যাকে জোড়াসাঁকোয় ডেকে পাঠান। রবীন্দ্রনাথ সেখানে ভক্তজন পরিবৃত্ত হয়ে বসে ছিলেন। পবিত্র বাবুকে তিনি বললেন, ‘ জাতির জীবনের বসন্ত এনেছে নজরুল। তাই আমার সদ্য প্রকাশিত বসন্ত গীতিনাট্যখানি ওকেই উৎসর্গ করেছি। সেখানা নিজের হাতে তাকে দিতে পারলে আমি খুশি হতাম, কিন্তু আমি যখন নিজে গিয়ে দিয়ে আসতে পারছি না, ভেবে দেখলাম, তোমার হাত দিয়ে পাঠানোই সবচেয়ে ভালো, আমার হয়েই তুমি বইখানা ওকে দিও। ’ রবীন্দ্রনাথের উপস্থিত ভক্তরা সবাই খুশি হতে পারেননি এই উৎসর্গে; এটি সম্ভবত ঠাকুর পরিবারের বা ব্রাহ্ম সমাজের বাইরে কাউকে রবীন্দ্রনাথের কোন গ্রন্থের প্রথম উৎসর্গ।’ [রফিকুল ইসলাম : রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল, রবীন্দ্রনাথ নজরুল, পৃ. ৪৮] এটাই ফুটে উঠেছে যে, রবীন্দ্রনাথের নজরুলের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা চিরন্তন বাণীর মতো।
রবীন্দ্রনাথ যখন ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যটি পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের মাধ্যমে নজরুলকে পাঠিয়েছিলেন সেটিতে তিনি দস্তখত করে দিয়েছিলেন। তিনি পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে বলেছিলেন আমি নিজে হাতে দিতে পারলাম না বলে সে যেন মনে কিছু না করে। আমি তাকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে আশীর্বাদ করি। সে যেন কবিতা লিখা চালিয়ে যায়। সৈনিক অনেক পাওয়া যাবে। তবে যুদ্ধে যাওয়ার প্রেরণা পাওয়ার জন্যে কবিতার তো অবশ্যই প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। রবীন্দনাথ নজরুলকে উৎসর্গ করে বই জেলখানায় পাঠানোর কথা শুনে ইউরোপীয়ান ওয়ান্ডেন বিস্মিত হন। নজরুল বইখানা পেয়ে কপালে ঠেকিয়ে বুকে চেপে ধরেন। বইটি পাওয়ার পরে নজরুলকে জেল জীবনের যন্ত্রণা উপশম করতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছিল। মনে হয় রবীন্দ্রনাথের উৎসর্গকৃত বইটি পাওয়ার পরে তাঁর প্রতি নজরুলের শ্রদ্ধা আরও বেড়ে যায়। তাই তো নজরুল লিখেছেন রবীন্দ্রনাথের বসন্ত নাটক আমায় উৎসর্গ করায় ‘তাঁর এই আশীর্বাদ-মালা আমি পেয়ে আমি’ জেলের সর্বজ্বালা, যন্ত্রণা, ক্লেশ ভুলে যাই’। তিনি আরও লিখেছেন:
হে সুন্দর, বহ্নি দগ্ধ
মোর বুকে তাই
দিয়ে ‘ছিলে’ ,‘বসন্তের’
পুষ্পিত মালিকা।’
[রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল : রবীন্দ্রনাথ নজরুল , পৃ. ৫০]
নজরুল পরবর্তীকালে ‘সঞ্চিতা’ কাব্যগ্রন্থ রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করেন। তিনি উৎসর্গপত্রে লেখেন-
বিশ্বকবি সম্রাট শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শ্রী শ্রী চরণারবিন্দেষু
‘সঞ্চিতা’ কাব্যগ্রন্থটি, প্রথম প্রকাশ হয়, আশ্বিন ১৩৩৫, (২ অক্টোবর ১৯২৮), প্রকাশক, বজ্রবিহারী বর্মণ রায়, বর্মণ পাবলিশিং হাউজ, ১৯৩ কর্নওয়ালিস স্ট্রীট, কলকাতা, পৃষ্টা সংখ্যা-২+১৩০, মূল্য-দেড় টাকা।’ [নজরুল-গ্রন্থপঞ্জী ও নজরুল-বিষয়ক গ্রন্থাবলী, পৃ. ১৬]
নজরুলকে আলিপুর জেলখানা থেকে পরবর্তীতে হুগলি জেলে স্থানান্তর করা হয়। ‘তিনি হুগলি জেলে কারাদ- ভোগ করছেন। সেই সময় জেলের সুপার ছিলেন মি.আর্সটন। বন্দীদের প্রতি তার আচার-আচরণে কোনরকম সৌজন্যতা ছিল না বরং অভদ্রতাই প্রকাশ পেত। এই সুপারকে উদ্দেশ্য করে নজরুল লিখেছিলেন ‘তোমারি জেলে পালিছ ঠেলে, তুমি ধন্য ধন্য হে !’ এই গানটি। এটি রবীন্দ্রনাথের ‘তোমারই গেহে, পালিছ ‘হে, তমি ধন্য ধন্য হে’ এই গানটির প্যারডি। সুপার আর্সটন্ পরিদর্শনে এলে বন্দীরা একসঙ্গে গানটি গেয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানাতো।’ [সম্পাদনা : আবদুল আজীজ আল আমান, স্বরলিপি: নিতাই ঘটক, শ্রেষ্ঠ নজরুল স্বরলিপি, অখ-, পৃ. ২৬]
এই গানটির সংশ্লিষ্ট বিবরণ নিন্ম রূপ :
গ্রন্থ : ১. ভাঙার গান
শিরোনাম-সুপার বন্দনা
পাদটীকা- “ হুগলি জেলে কারারুদ্ধ থাকাকালীন জেলের সকল প্রকার জুলুম আমাদের উপর দিয়ে পরখ করে নেওয়া হয়েছিল। সেই সময় জেলের মূর্তিমান জুলুম বড়-কর্তাকে দেখে এই গান গেয়ে আমরা অভিনন্দন জানাতাম ”।
২. সঞ্চয়ন
বি.দ্র. : গানটির সুর রবীন্দ্রসঙ্গীত-‘তোমারই গেহে পালিছ -হে’-এর সাদৃশ্যে রচিত।
[ব্রহ্মমোহন ঠাকুর : নজরুল সঙ্গীত নির্দেশিকা, পৃ. ৩৫৪]
পরবর্তীতে হুগলি জেলে অনিয়মের বিরুদ্ধে তিনি আমরণ অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। তখন রবীন্দ্রনাথ নজরুলের অনশনের খবর পান। রবীন্দ্রনাথ তখন শিলং এ অবস্থান করছিলেন। তিনি সেখান থেকে নজরুলকে তারবার্তা পাঠান। তারবার্তায় লিখা ছিল – ‘Give up hunger strike, our literature claims you. ’ আমার ব্যক্তিগত ভাবনায় রবীন্দ্রনাথের তারবার্তাটি নজরুলের প্রতি তাঁর অগাধ ভালবাসা, ‘স্নেহে এবং হৃদয়ের টান সুন্দরভাবে চিত্রিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ব্যক্ত করা তারবার্তাটি দুজনায় অমৃত বন্ধনের মাইল ফলক হিসেবে আমি ব্যাক্তিগতভাবে অনুধাবন করি। আমার চিত্তে এটাই ধরা দিয়েছে যে সাহিত্যের বন্ধনে তারবার্তাটি গৌরবের বিষয় কিন্তু সেইটি নজরুলের হাতে পৌঁছেনি। শরৎচন্দ্র ও নজরুলের গর্ভধারিনী মা অনশনের খবর পেয়ে জেলখানায় দেখা করতে গিয়েছিলেন অনশন ভাঙ্গানের জন্যে অনুরোধ জানাতে, কিন্তু দেখা হয়নি। সে সময় বিরজাসুন্দরী দেবী জেলখানায় নজরুলের সাথে দেখা করে লেবুর রস পান করিয়ে তাঁর অনশনের ৪০তম দিবসে অনশন ভঙ্গ করান। পরবর্তীতে নজরুল ‘সর্বহারা’ গ্রন্থটি (১৯২৬ ইংরেজিতে ) বিরজাসুন্দরী দেবীকে উৎসর্গ করেন।
১৯২৬ সালের ১৫ এপ্রিল, ২রা বৈশাখ, ১৩৩৩ বৃহস্পতিবার ‘লাঙল’-এর প্রথম খ- ১৫শ সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের আশীর্র্ব্বচনটি বের হয় । সেটি নিন্মরূপ:
‘জাগো জাগো বলরাম
ধরো তব মরুভাঙা হল।
বল দাও ফল দাও
শুদ্ধ কর ব্যর্থ কোলাহল।’
[ লাঙল ও গণবাণী : পৃ. ২২৭]
এটা তো নজরুলের প্রতি কবিগুরুর স্নেহাশিস ও অকৃত্রিম ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের পত্রালাপের মাধ্যমে দুজনার অমৃত বন্ধন ফুটে উঠেছে। ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ আগস্ট নজরুল কলকাতার সাপ্তাহিক ‘নাগরিক’ পত্রিকার ২য় বর্ষ ১ম বার্ষিক সংখ্যার জন্যে লেখা চেয়ে রবীন্দ্রনাথকে একটি পত্র দিয়েছেলেন। পত্রটি তুলে ধরা হলো :

রবীন্দ্রনাথ ১৩৪২ সালের ১৫ ভাদ্র নজরুলকে সে পত্রের উত্তর দেন। পত্রের উত্তরটি নিন্মরূপ :
কল্যাণীয়েষু,
অনেকদিন পরে তোমার সাড়া পেয়ে মন খুশী হোলো। কিছু দাবী করেছ-তোমার দাবী অস্বীকার করা আমার পক্ষে কঠিন। আমার মুস্কিল এই, পঁচাত্তরে পড়তে তোমার এখনো অনেক দেরী আছে, সেইজন্য আমার শীর্ণ শক্ত ও জীর্ণ দেহের পরে তোমার দরদ নেই। কোনো মন্ত্রবলে বয়স বদল করতে পারলে তোমার শিক্ষা হোতো। কিন্তু মহাভারতের যুগ অনেক দূরে চলে গেছে, এখন দেহেমনে মানব সমাজকে মেনে চলতে হয়। সায়েন্সর সীমানা বাঁচিয়ে। …
তুমি তরুণ কবি, এ প্রাচীন কবি তোমার কাছ থেকে আর কিছু না হোক, করুণা দাবী করতে পারে। অকিঞ্চনের কাছে প্রার্থনা করে, তাকে লজ্জা দিও না। এই নতুন যুগে যুগে যে সব যাত্রী সাহিত্য-তীর্থে যাত্রা করবে, পাথেয় তাদের নিজের ভিতর থেকেই সংগ্রহ করতে হবে।
শুনেছি বর্ধমান অঞ্চলে তোমার জন্ম। আমরা থাকি তার পাশের জিলায়-কখনও যদি ঐ সীমানা পেরিয়ে আমাদের দিকে আসতে পারো খুশী হব। স্বচক্ষে আমার অবস্থাও দেখে যেতে পারবে। ইতি ১৫ই ভাদ্র, ১৩৪২
স্নেহরত
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নজরুল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঐ চিঠি পেয়ে খুবই অভিভূত হয়ে পড়েন। তিনি রবীন্দ্রনাথের পত্রের উত্তর দেন ‘ তীর্থপথিক ’ নামে একটি কবিতার মাধ্যমে। এই কবিতাটি ‘নাগরিক ’ পত্রিকার ২য় বর্ষ ১ম সংখ্যায় (১৩৪২) মুদ্রিত হয়। এই কবিতাটিতে রবীন্দ্রনাথের প্রতি নজরুলের গভীর ভালোবাসা ফুটে উঠেছে বলে মনে করি। কবিতাটি হলো-
হে কবি, হে ঋষি অন্তর্যামী, আমারে করিও ক্ষমা !
পর্বত-সম শত দোষ-ত্রুটি ও চরণে হল জমা।
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের রচনায় উল্লেখযোগ্য সাদৃশ্য রয়েছে। যেমন :
ক. রবীন্দ্রনাথ ‘মানসী’ কাব্যগ্রন্থে (১৮৯০) উৎসর্গ করেছেন নামহীন কোনো নায়িকাকে উদ্দেশ্য করে-
‘এ চীর জীবন তাই আর কিছু কাজ নাই
রচি শুধু অসীমের সীমা।
আশা দিয়ে তাহে ভাষা দিয়ে তাহে
ভালবাসা দিয়ে গড়ে তুলি মানসী প্রতিমা’।
নজরুল তাঁর ‘ব্যথার দান’ (১৯২২) গ্রন্থটি উৎসর্গ করেন আর এক অজ্ঞাতনামা মানসীকে। রহস্যময়
শব্দপ্রয়োগে উৎসর্গটি লেখা হয়েছিল –
‘মানসী আমার !
মাথার কাঁটা নিয়েছিলুম বলে
ক্ষমা করোনি,
তাই বুকের কাঁটা দিয়ে
প্রায়শ্চিত্ত করলুম’।
খ. রবীন্দ্রনাথ সরাসরি রাজনীতি না করলেও তাঁর কিছু রচনায় রাজনৈতিক ভাবধারা পরিলক্ষিত হয়। উদাহরণ হিসেবে- ঘরে-বাইরে, চার অধ্যায়। নজরুল ১৯২৬ সালে সরাসরি আইনসভার নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেন। তাঁর কিছু রচনায় রাজনৈতিক ভাবাপন্ন বা বিপ্লবী চরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। উদাহরন হিসেবে-কুহেলিকা, মৃত্যুক্ষুধা।
গ. রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করেছিল শীর্ণা নদী কোপাই এবং নজরুলকে মুগ্ধ করেছিল কুমিল্লার গোমতী নদী।
ঘ. ১৩০২ সালের ২ ফা-ুন রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন ‘ ১৪০০ সাল ’ কবিতাটি। তা নিন্মরূপ :
‘আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি
কৌতূহলভরে,
আজি হতে শতবর্ষ পরে’ !
১৩৩৪ সালে নজরুল এই কবিতার উত্তরে ‘১৪০০ সাল’ নামে আরেকটি কবিতা লিখলেন। এই কবিতাটি ১৩৩৪ সালের আষাঢ় মাসে প্রকাশিত হয়। কবিতাটি নিন্মরূপ:
‘আজি হ’তে শত বর্ষ আগে
কে কবি, স্মরণ তুমি করেছিলে আমাদেরে
শত অনুরাগে,
আজি হতে শত বর্ষ আগে’!
ঙ. রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের কিছু রচনা পাশাপাশি তুলে ধরা হলো।
১. হার-মানা-হার পরাব তোমার গলে। (গীতিমাল্য : ২৪) | ১. এই হার-মানা-পরাই তোমার কেশে। (ছায়ানট, বিজয়িনী) |
২. এবার তোরা আমার যাবার বেলাতে জয়ধ্বনি কর। (গীতালি : ২১) | ২. ঐ ভাঙা-গড়া লেখা যে তার, কিসের তরে ডর ? তোরা সব জয়ধ্বনি কর। (অগ্নিবীণা, প্রলয়োল্লাস) |
৩. এক হাতে ওর কৃপাণ আছে আর এক হাতে হার। (গীতালি : ১০) | ৩. মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণতূর্য। (বিদ্রোহী, অগ্নিবীণা) |
৪. বকুল ঝরিয়া মরিবারে চায় কাহার চুলে ? কেহ ভোলে কেহ ভোলে না যে, তাই এসেছি ভুলে। (মানসী, ভুলে) | ৪. কেই ভোলে না কেউ ভোলে অতীত দিনের স্মৃতি। (চোখের চাতক : ৮) |
৫. সারা জীবন দিল আলো সূর্য-গ্রহ চাঁদ তোমার আশীর্বাদ হে প্রভু, তোমার আশীর্বাদ। (গীতি-চর্চা-১) | ৫. এই সুন্দর ফুল সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি খোদা তোমার মেহেরবাণী। (বনগীতি, ২য় সংস্করণ) |
৬. ওরা অন্ত্যজ, ওরা মন্ত্র বর্জিত। দেবালয়ের মন্দিরদ্বারে পূজা ব্যবসায়ী ওদের ঠেকিয়ে রাখে। (কবি আমি ওদের দলে, পত্রপুট) | ৬. তব মসজিদ-মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী। মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি। (মানুষ, সাম্যবাদী) |
৭. শক-হূনদল মোঘল-পাঠান এক দেহে হলো লীন। (ভারততীর্থ, গীতাঞ্জলি) | ৭. গাহি সাম্যের গান-যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান, যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্লিম-ক্রীশ্চান। গাহি সম্যের গান ! (সাম্যবাদী) [মানবর্দ্ধন পাল : গ্রন্থোৎসর্গে নজরুলমানস, পৃ. ১২৩ ও ১২৪] |
চ. রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় ও প্রয়াণ পরবর্তীকালে কবিগুরুর উদ্দেশ্যে নজরুল যে সমস্ত গান ও কবিতা রচনা করেছিলেন তা একনজরে দেখার জন্যে তুলে ধরা হলো :
০১. ১৪০০ সাল (আজি হতে শত বর্ষ আগে)
০২. তীর্থপথিক (হে কবি, হে ঋষি অন্তর্যামী)
০৩. অশ্রু-পুস্পাঞ্জলি (চরণারবিন্দে লহ অশ্রু-পুষ্পাঞ্জলি)
০৪. রবিহারা (দুপুরের রবি পড়িয়াছে ঢলে)
০৫. সালাম অস্ত-‘রবি’ (কাব্যগীতির শ্রেষ্ঠ স্রষ্টা)
০৬. কিশোর রবি (হে চির-কিশোর কবি রবীন্দ্র)
০৭. রবির জন্মতিথি (রবির জন্মতিথি কয়জন জানে ?)
০৮. মৃত্যুহীন রবীন্দ্র (রবীন্দ্রনাথ, তোমাদের তরে নিত্য আছেন জাগি)
[মানবর্দ্ধন পাল : গ্রন্থোৎসর্গে নজরুলমানস, পৃ. ১২৫]
ছ. নজরুলের ‘অগ্নি-বীণা’ কাব্যগ্রন্থের নামের পেছনে রবীন্দ্রনাথের ‘অগ্নিবীণা বাজাও তুমি কেমন ক’রে’ গানটির প্রেরণার কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।
জ. রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল সবসময়ই পুরুষদের পাশাপাশি নারীদেরকেও সমভাবে মূল্যায়ন করেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘পরিণয়’ কবিতায় বলেছেন-
‘নৃত্যের বশে সুন্দর হলো বিদ্রোহী পরমাণু,
পদযুগ ঘিরে জ্যোতিমঞ্জীরে বাজিল চন্দ্রভানু’।
নারী পুরুষের সমান যোগ না হলে সম্পূর্ণতা নেই। নজরুল তার ইঙ্গিত দিয়েছেন ‘নারী’ কবিতায়। এই কবিতায় তিনি বলেছেন-
‘বিশ্বের যা-কিছু মহান্ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’।
রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৮ সালে ‘বাংলা কাব্যপরিচয়’ শিরোনামে একটি কবিতা সংকলন সম্পাদনা করেন। এই গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের কবিতা, অন্যান্য কবিদের কবিতার পাশাপাশি নজরুলের তিনটি কবিতা স্থান পেয়েছিল। নজরুলের কবিতাগুলো -‘দেখব এবার জগৎটাকে’, ‘সিন্ধু’ ও ‘পউষ’ – এই বিষয়টি অনুভূতি প্রবণ বিদগ্ধ পাঠক চিত্তকে অভিভূত করে। রবীন্দ্রনাথের আশি বছর পূর্তি উপলক্ষে নজরুল ‘অশ্রু-পুষ্পাঞ্জলি’ নামে একটি কবিতা লিখেন। এই কবিতায় নজরুলের বেড়ে ওঠার পেছনে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা সুন্দরভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছে। কবিতাটি নি¤œরূপ :
‘চরণারবিন্দে লহ অশ্রু-পুষ্পাঞ্জলি,
হে রবীন্দ্র, তব দীন ভক্ত এ কবির।
অশীতি-বার্ষিকী তব জনম-উৎসবে
আসিয়াছি নিবেদিতে নীরব প্রণাম।’
[কাজী নজরুল ইসলাম : নজরুলের কবিতা সমগ্র : নতুন চাঁদ, পৃ. ৬৯৭]
১৩৪৮ সালের ২২ শ্রাবণ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুত্যু বরণ করেন। রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ নজরুলকে বড় আঘাত দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের স্মরণে নজরুল বেশ কয়েকটি গান ও কবিতা রচনা করেন। সেগুলো ‘রবিহারা’, ‘সালাম অস্ত রবি’ ‘মৃত্যুহীন রবীন্দ্র’ এবং ‘ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবি রে জাগায়ো না জাগায়ো না’। এ গান ও কবিতায় স্বজন ও অভিভাবক হারানোর ক্রন্দনের অনুরণন। ‘রবীন্দ্রনাথ প্রয়াণের স্বল্প সময় পরে নজরুল ‘ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবি রে জাগায়ো না জাগায়ো না’ এই গানটি রচনা করেন। ‘বিদায়’ শিরোনামে গানটি ‘বুলবুল’ ২য়’তে সঙ্কলিত হয়। রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণ উপলক্ষে ‘রবিহারা’ শিরোনামে নজরুল একটি কবিতাও রচনা করেন। এই কবিতাটিও নজরুল স্বকণ্ঠে আবৃতি করেন।’
ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবি রে জাগায়ো না জাগায়ো না -এই গানটির সংশ্লিষ্ট বিবরণ তুলে ধরা হলো।
গ্রন্থ : বুলবুল ২য় খ-
রেকর্ড : এইচ.এম.ভি, সেপ্টেম্বর, ১৯৪১
নং-এন ২৭১৮৮
শিল্পী-নজরুল ও সহশিল্পীবৃন্দ
(সুনীল ঘোষ, ইলা ঘোষ)
বেতার : রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু উপলক্ষ্যে ৭.৮.১৯৪১ তারিখের সন্ধ্যায় গানটি নজরুল ও তাঁর সহশিল্পীবৃন্দ গেয়েছিলেন।
স্বরলিপি : ১. নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি, দ্বিতীয় খ-, ঢাকা
২. নজরুল স্বরলিপি, ষষ্ঠ খ-, হরফ।
[ব্রহ্মমোহন ঠাকুর : নজরুল সঙ্গীত নির্দেশিকা, পৃ. ২৫৪]
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মধ্যে সবার আগে যে মিলটি চোখে পড়ে সেটি হলো-তাঁরা দ‘ুজনই সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় বিচরণ করেছেন। তাছাড়াও দুজনই সুরকার, গায়ক ও অভিনেতা। তাঁরা পত্রিকা সম্পাদনাও করেছেন। এতগুলো সাহিত্য ও সঙ্গীত গুণের সমাহার আর কোন কবির মধ্যে রয়েছে তা দেখা যায় না। রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। নজরুল রবীন্দ্রনাথের মতো বিশাল মহীরুহের প্রভাবের আওতায় বেড়ে উঠে তাঁর স্বকীয়তায় স্বাতন্ত্র্যে অবিসম্বাদিতভাবে প্রোজ্জ্বল। এটাই নজরুলের বিশেষত্ব। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল দুজনেই খুব মানবতাবাদী ছিলেন।
নজরুলের চিত্তে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন শ্রদ্ধার আসনে আর রবীন্দ্রনাথের চিত্তে নজরুল ছিলেন প্রেমময় স্নেহাশিসে সিক্ত। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল পরস্পর পরস্পরের প্রতি অমৃত বন্ধনে জড়িত ছিলেন। দুটো উপমার মাধ্যমে পরিষ্কারভাবে উপলব্ধি করা যায়, প্রথমত: ১৯৩৬ সালে কলকাতার ‘দেবদত্ত ফিল্মস’ র মাধ্যমে কবিগুরুর ‘গোরা’ উপন্যাসটি চলচ্চিত্রে রূপ দেওয়া হয়। পরিচালক ও নির্মাতা ছিলেন নরেশ বাবু। সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন নজরুল। সেই সময় চলচ্চিত্রে কবিগুরুর কোনো গান ব্যবহার করতে গেলে বিশ্বভারতীর মিউজিক বোর্ডের অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু অনুমতি নেওয়া হয়েছিল না। অন্তর্ভুক্ত রবীন্দ্র সঙ্গীতগুলো সম্পর্কে বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড আপত্তি তোলায় ছবির মুক্তিতে বাঁধার সৃষ্টি হয়। সেই সময় ঐ ছবির নির্মাতা নরেশ বাবুকে সঙ্গে নিয়ে নজরুল শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের কাছে চলে যান এবং তাঁর অনুমোদন নিয়ে আসেন। ফলে ছবিটি নির্ধারিত সময়ে মুক্তি পায়। দ্বিতীয়ত: বন্ধুবর জগৎ রায় রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কটূক্তি করায় তাকে আহত করেছিলেন। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়ে থাকে। সেই সময় নজরুলের বয়স স্বল্প থাকায় আদালত তাঁকে মামলা থেকে মুক্তি দেন। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল দুজনে মহামানব এবং মহাপুরুষতো বটেই, তাছাড়া আমাদের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁদের দুজনার গানেই আপন আপন সুর সৃষ্টির ছাপ ফুটে উঠেছে। তাই সহজেই অনুমেয় কোনটি রবীন্দ্রনাথের আর কোনটি নজরুলের গান। একবার ‘সওগাত’ অফিসে গিয়ে তাদের লাইব্রেরিতে রবীন্দ্রনাথের কোন বই না থাকায় নজরুল রেগে যান, পত্রিকার সম্পাদক রবীন্দ্রনাথের বই এনে নজরুলকে শান্ত করেন। নজরুলের প্রতি রবীন্দ্রনাথের ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম। দু‘জনার মনোজগতের তরঙ্গদৈর্ঘ্যে ব্যবধান ছিল না। তাঁদের দ’জনের হৃদয় ছিল পয়োধির মতো।
কবিগুরু যেমন বিশ্ব দরবারে বাংলা সাহিত্যকে পৌঁছে দিতে পেরেছেন। তেমনি কিবি নজরুল নতুন যুগ নিয়ে নতুন জীবনচেতনা নিয়ে শুধু এদেশে নয়, সারা বিশ্বে তাঁর সৃষ্ট কালোত্তীর্ণ সাহিত্য ও সাহিত্যচিন্তা পৌঁছে দিতে পেরেছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের আগ পর্যন্ত দ‘ুজনার সম্পর্ক ছিল পারস্পরিক ¯েœহে ও শ্রদ্ধার। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল আমাদের আলোর দিশারি। আমাদের জীবনবোধ উৎসারিত করার জন্যে দ‘ুজনার অবদান অপরিসীম। দ‘ুজনার অতলান্তিক সম্পর্ক আমাদেরকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মসৃণ পথ দেখায়।
তথ্যঋণ :
০১. কাজী নজরুল ইসলাম , নজরুলের ছোটগল্প সমগ্র, অষ্টম মুদ্রণ, ফেব্রুয়ারি ২০১৫, প্রকাশক, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা।
০২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর , গীতবিতান, প্রথম সাহিত্য সৌরভ সংস্করণ ২০০৩ ইং, প্রকাশক, সাহিত্য সৌরভ, ঢাকা।
০৩. নজরুল-গ্রন্থপঞ্জী ও নজরুল-বিষয়ক গ্রন্থাবলী , প্রথম প্রকাশ, আগস্ট ১৯৯৪, প্রকাশক, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা।
০৪. রশীদ হায়দার, সম্পাদনা, রবীন্দ্রনাথ নজরুল , দ্বিতীয় সংস্করণ, একুশে বইমেলা ২০১৩, প্রকাশক, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা।
০৫. সুলতান মাহ্মুদ মজুমদার , ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি, প্রকাশকাল, জুন ২০০৬, প্রকাশক, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা।
০৬. নজরুলের ধূমকেত, দ্বিতীয় প্রকাশ, জুন ২০১৩, প্রকাশক, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা।
০৭., আবদুল আজীজ আল আমান, সম্পাদনা, স্বরলিপি: নিতাই ঘটক, শ্রেষ্ঠ নজরুল স্বররিপি, অখ-, পরিমার্জিত সংস্করণ, ২০ এপ্রিল ২০০৭, প্রকাশক, হরফ প্রকাশনী, কলকাতা।
০৮. ব্রহ্মমোহন ঠাকুর, নজরুল সঙ্গীত নির্দেশিকা, প্রথম সংস্করণ, ২৫ মে ২০০৯, প্রকাশক, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা।
০৯. লাঙল ও গণবাণী, দ্বিতীয় সংস্করণ, জুন ২০১৩, প্রকাশক, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা।
১০. মানবর্দ্ধন পাল, গ্রন্থোৎসর্গে নজরুলমানস, প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০১৩, প্রকাশক, অক্ষর প্রকাশনী, ঢাকা।
১১. কাজী নজরুল ইসলাম, নজরুলের কবিতা সমগ্র, পঞ্চম মুদ্রণ (প্রথম সংস্করণ ) জানুয়ারি ২০১৫, প্রকাশক, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা।
লেখক : নজরুল গবেষক, বাংলাদেশ।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ও জাতিয় কবি নজরুলের অমৃত বন্ধন সত্যি অসাধারণ লিখেছেন।
সফলতা আপনাকেও অটুট বন্ধনে ঘিরে থাকুক প্রার্থনা করি।
এক কথায় অপূর্ব।কতো ছোটো বড়ো তথ্য যে গুলো হতে পারে অনেকেরই অজানা.. ..সেই গুলো কে এক জায়গায় পেয়ে কতো যে সম্বৃদ্ধ হলাম। ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার লেখাকে। আরো শক্তিশালী হোক আপনার কলম….এই প্রার্থণা করি🙏🙏