এম আর আলম ঝন্টুর কবিতাগুচ্ছ

প্রতিঘাত করিনি
আমি কিন্তু প্রতিঘাত করিনি! আমি বলিনি
পথ আগলে দাঁড়াই কখনও। অথচ
পদাঘাত আর অশ্রাব্য কথনে নতুন এক আঘাত।
আঘাত এলো অস্তিত্বধারায়। আমাকে দিকভ্রান্ত করে
বারবার। বিপন্ন হই বিরুদ্ধাচারে।
হৃদয় কতটা বড়? আকাশের বিশালতার কাছে তা কি
কিছু? মনে হয় তার চাইতেও বিশাল হয়ে উঠি আমি।
কৃষ্ণচুড়ার লাল আর অঝোর ধারায় কদম্ববৃক্ষ।
শরতের শ্বেতশুভ্র মেঘ ভেলায় পৌঁছে দিয়েছিলাম নীলিমায়!
প্রতিদানও চাইনি। পাইনি কিছুই, নিষ্ফলা।
কতরাত গেছে অনাহুত। জাগ্রত অসহায়। নিরুপায়।
শকুনেরা তবু উন্মত্ত বিচরণে। আজও উচ্ছিষ্টভোজী তারাই।
বিতাড়িত আমি নিজ ভূমে পরবাসী। অসম সন্যাস খুঁজি।
নির্বিকল্প কিছু নেই, নির্বিকার তুমি তাও।
অহংবোধ যেন উচ্চাভিলাষী করে। মাটিতে পড়েনা পা।
দ্বিধাহীন পলকপাত। বিদ্বেষ ছড়িয়ে যায়।
আছো তো সিংহাসনে, প্রজাপতি হয়ে। হয়ে দুঃশাসক।
মান্যবর তুমি! আজ কি পদানত? আহত আঘাত কেবলই
খুঁজে সত্যাগ্রহ। নির্বাসিত হয়ে থাকা, বড় একা।
আমি তবু প্রতিঘাত করিনি আজও! হৃদয় মাঝে লিখেছি
যে, তার নাম। অভিনাম তাই অভিমান হয়ে যায়।
বেঁচে আছি আজ হয়ে যেন অসহায়।
হিমালয় হাতের নাগালে আজ। সন্তর্পণে ধর। নয়তো
ভেঙে যাবে স্বপ্নজাল। বিস্মিত হবে ধরিত্রী। অধিবাস।
এক চিলতে রোদ্দুর দাও
এক চিলতে রোদ্দুর দাও দিগন্তরেখায়
আমি মেখে নেবো। আমি বুলিয়ে দেবো হাত
নিভৃতে থেকে হয়ত দেখবেনা তুমি! হয়ত দেখবে
আরও কিছুক্ষণ সেখানেই থাকা।
সূর্য উঠেছিল বাঁকা চাঁদ অস্তাচলে। মনে পড়ে
বড় বেশি, বেশিদূর হয়না যাওয়া আর।
আমি অবোধ, অবধারিত এক। দেখা হয়নি
নিজ আঁখিপাত। অভিসম্পাতে।
তুমি আকাশ ছুঁবে জানি, কারো হৃদয় সিঁড়ি করে।
ঘুম ভাঙবে কি অবন্তিকার তাতে।
তুমি আমার কাছেইতো ছিলে। বড় বেহিসেবি ক্ষণ।
ক্ষণ গণনায় মাত্র দুটো দিন, একি খুব বেশি কোন কিছু?
তুমি আবীরখেলায় আমাকে দিয়েছিলে চাঁদের এক
তারিখ। আমি সেই অপেক্ষাতে এখনও নতজানু।
কতদিন সূর্য দেখিনা চোখে! বড় ঝাপসা হয়ে আসে
বিদগ্ধ বচন। সচকিত ঘুম ভাঙে।
তবু দাও এক চিলতে রোদ্দুর মাখা সকাল
আমি উত্তাপ নেবো। আমি উৎসস্থল খুঁজে নেব।
সেই নাভিমূল। সংগত অধীরতা বাহুমূলে। আমি
নিবিষ্টমনে এঁকে দেব দীর্ঘ চুম্বন তাতে।
আমি খুঁজে পেতে চাই দুঃসময়ে হারিয়ে যাওয়া পথ।
নির্ঘাত নিলয় নিজেই যা খুঁজে পেতে অভিঘাত
বারবার। আমার সমন্বিত ইন্দ্রিয়জগৎ উদ্বীপ্ত প্রবল
আজ তাকে খুঁজে নিবো আমি।
তেষ্টা তার
পদ্মার এক ফোটা জল চাইতে এতোটা পথ আসা। আর
কত দূর যেতে হবে বল?
আর কতটা সমূখে এগুতে পারি মরুময় দুঃসহ
সংকীর্ণতা। আমার স্বচ্ছ জলরাশি।
দেখা হয়েছিল ভদ্রায়, সাহেব বাজার মোড়ে। কিছুটা
এগিয়ে আবার পদ্মায়। আর সেখানেই
কেশবচন্দ্র বসে
সাজিয়েছিল সিংগারার দোকান। তুমি বসতে সেই শেষ
সারির চেয়ারটাতে। সবুজের ক্যাম্পাসে অবুঝেরা
কতনা জ্বালিয়েছে নির্বাক। তবু অবাক বিস্ময় তাড়া
করেনি তাকে।
কাজলার বিপুল নন্দী আর সাগরপাড়ার
ফারুকেরা আজও আছেন! তবে কেমন যেন বদলে
গেছে সবই। বদলে গেছে ছবি চিরচেনা জনপদ।
বদলে গেছে কবি।
গরুর গরম দুধের চায়ে চুমুক দিয়ে খুব বেশি মনে
পড়ে যায় সেই কথা। একজন নিভৃতচারী, একজন
উদ্দাম বাদন। রাজপথে মার্কসবাদী ভাষণ।
অথবা কবিতা আসরের বিপ্লবী উচ্চারণ। তবু তুমি
জীবনানন্দ বেছে নিলে।
সেই ছায়াপথ, বিব্রত পথচলা, খানিক আঁধার নেমে এলে
লাজনম্র শুভ্রতা। অশোভন তর্জনী- মধ্যমী
বাঁকা পথ খুঁজে নিতো। আমি কিন্তু ভিতুই ছিলাম, কেমন
একটা উদ্ভট ভাব।
আবার পদ্মায় সেই ভোরের সূর্যোদয়, দেখে ফেরা
গন্তব্য নিলয়। অবনত চোখটাও বুঝতো তেষ্টা তার।
বহুদূর পদ্মাটা। মনে হয় যোজন যোজন দূর। মন পড়ে
থাকে বনপাড়ায়, সয়রাত ভুক্ত করি প্রান্তর।
পদ্মার কাছে জল কি চাইব বল?
সে আছে দূরে গগনপট প্রান্তর দূরে।
তুমি আসবে বলেছিলে
তুমি আসবে তাই সাজ সাজ রব চারিদিক
জয়ন্তের দিকবিদিক ছুটে চলা।
তুমি হিমালয় ছুঁয়ে দ্যাখো
আরও উঠতে চুড়ায়
চূর্ণ করে পাথর বরফখণ্ড
একদণ্ড দাঁড়ালে না।
তুমি আসবে তাই উচ্ছ্বাসে সহৃদয়তা
উদ্বেল পৌরপথ।
শত শত পরিচ্ছন্ন কর্মী আর পাতাকুড়ানি
শিশুদের ঝাঁক।
পথ চেয়ে থাকা।
গানের পাখিরা আজ প্রভাতেই পাখা মেলে
উড়ে যায় দাঁড়কাক।
বাতাসে মৃগয়ার সুঘ্রাণ।
আতশবাজির ঝলকানি মৃদুলার সুরব্যঞ্জনা।
তুমি আসবে বলেছিলে
তাই চৌপথে রাজকীয়তা ঘোড়সওয়ারী।
সারি সারি বিউগলে সংগত বাদন,
আর বিগড্রামে দম দম দামাম।
তুমি আসবে তাই একদল শৃখলায়
হাতে তুলে নেয় আগ্নেয়াস্ত্র।
অতঃপর ট্রিগারে আঙুল দাবে।
সশব্দে বারুদ উদগীরন।
ভারি হয়ে ওঠে জনপদ
বিউগল করুণ সুর আর প্রাণান্ত দেশের
গানে বিষাদময় প্রতিবেশ।
এই তার ফিরে আসা,
বারবার ফেরা। বারবার ফেরা।।
একমনে
শতাব্দীকাল হতে বসে আছি একমনে নিয়ে
যাবো এই বলে তাকে।
এক ফাঁকে তুমি তার অসাড়তা ভেঙে দিয়ে
বলে যাও—আমি কিন্তু আমি না
তুমি হতে পারো তুমি, সে না!
নাবিকেরা সাগরে—বন্দরে
জাহাজের মাস্তুল দেখে নেয় নীল আকাশ।
শ্রাবণের ধারায় নিজে হাত বাড়ায়, সে নয়।
ছলনার ভূবনে ওই দূরে কাশবন ঘনময়।
শতকোটি শতদল ভেসে আসে
শাপলা শালুক আর পদ্মপাতায়।
জলতরঙ্গ তুলে ব্যঞ্জনাময় তাল
আমি তুলি, সে না।
শত রঙ রঙচঙ বেদনার নীল রঙ একাকার।
ডায়মন্ড হারবার বারবার ডেকে যায় নাবিকটা
সে পথের যাত্রী। আমি না।
আমি দিকদর্শী নই তো, তুমি তাও জানো না
জয়ন্ত জানেতা, নিভৃতে মানেতা, তুমি না!
আজ শুধু বসে থাকা তাকে খুঁজি।
পথ চেয়ে বসে আজ বিস্ময়, ভুলে যাই।
যাকে পাই ধরে নেই সেইজন।
তবু সে বলে ওঠে সে না, কে তবে?
এম আর আলম ঝন্টু : পেশায় একজন সাংবাদিক। ১৯৬৮ সালের ৯ জুলাই জন্ম। লেখালিখি করছেন ছোটবেলা থেকেই। তাঁর কবিতা গল্প প্রবন্ধ বিভিন্ন পত্রিকা এবং ম্যাগাজিনে প্রকাশ হয়েছে। আশির দশকে তিনি সৈয়দপুর কলেজে অধ্যায়নকালে চেতনা নামে একটি দেওয়াল পত্রিকা প্রকাশ করতেন। প্রগতিশীল ধারার ওই প্রকাশনাটি অনেকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেছে। এছাড়া সৈয়দপুরের কথক সাহিত্য গোষ্ঠীর প্রকাশনা কথক প্রকাশের ক্ষেত্রে অন্যতম অবদান রেখেই চলছেন। ‘ ফিরে চলা অতলান্তে’ তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ।
সবগুলো কবিতাই ভালো। তবে ‘একমনে’ কবিতা বেশী ভালো লেগেছে আমার।