আয়শা জাহান নূপুরের কবিতাগুচ্ছ

অতীত এলেই মনে হয় বেঁচে নেই
তোমাকে দেখি না আমি বহুদিন।
সেই গতজন্মে একবার দেখেছিলাম উড়ন্তপাখি।
তারপর ধীরে ধীরে কেটে গেছে নক্ষত্রের কাল।
ততদিনে ভুলেছি সব-
শুকনো পাতার গান,
আলোর দুয়ার,
শরতের ফুল,
অবেলার কলরব।
মিটে গেছে আহবানে ঝলমলে রোদের উঠান।
ডুবে গেছে ঝুপড়িতে শীত নামা হাওয়ার দোকান।
তোমাকে দেখিনি আমি কোনো দিন,
শুধু একবার দেখেছিলাম বহুকাল।
পরিচিত পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে মহাকাল!
শুধু একবার দেখেছিলাম সতেজ ঘ্রাণে,
জেগে থাকা উন্মুক্ত শরীরের ব্যবধানে,
ফেলে আসা প্রবাহমান নদীতে হারানো শৈশব।
তারপর কেটে গেছে কোজাগরী রাত—
বয়সী বাতাসে উড়ে রুক্ষ চুল,
দৃষ্টি কেড়ে নেয় দেখার সকাল।
অভিমানী ট্রেনের নিশুতি রাত।
সিন্ধুকের জমানো প্রেমের আর্তনাদ!
আজ জেগে নেই কোথাও কেউ আর!
কেন যেন মনে হয়—
কতদিন তোমাকে ছুঁয়ে দেখি না!
কতদিন তোমাকে ছুঁয়ে দেখি না!
একটি পৃথিবীর কবিতা
সেই সব পাতা ঝরা দিনগুলি স্মৃতি এ্যালবামে জমে উঠে।
আকাশের জমিনে ফুটে থাকা অসংখ্য শিমুল ছিল প্রেরণায়।
আমরা প্রত্যেকেই সে বেলায় ফুল নয় আগুনই দেখতাম।
সে দৃশ্য আমাদের চোখে দেখা উজ্জ্বলতর মূহুর্ত হয়ে থাকে।
আঁধারের উঠোনে সকলি এক একটা পারিজাত,
দেবতার বাগানে চুরি হওয়া প্রয়োজনীয় প্রেম।
জীবনের গভীরে আরও এক দর্শনের পাঠ।
জীবনের গভীরে আরও এক মিথ্যার আবাদ আমরা পরিহাস করতাম, নিজেকে ভালোবেসে।
এই ক্ষয়ে যাওয়া পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই স্বীকার করে, একটি ভুল চিঠি তার ঠিকানায় এসেছে।
এই বিস্তীর্ণ আলোতেও ধরা পরে নিজেদের প্রগাঢ় অন্ধকার, যা সম্পর্কের খুব কাছে বাস করে।
তবুও আমরা মেখেছি বিশ্বাসের মলম জরায়ূতে।
বিনীত পাঠ নিয়েছি বৈশ্বিক পাঠশালায়।
মূল্যবোধ বেড়ে উঠুক ফলবতী বৃক্ষের মতোন।
মানবতা বাচুক বোধ আর ভালোবাসার কবিতায়।
সবটুকু সত্যি নয়, কিছুটা সত্যের মতো
শতবর্ষী বৃক্ষ ফলহীন ফসল।
আগাছায় ঢেকে রাখে সময়ের ক্ষত।
তবুও সব প্রাক্তন নয়কো পুরনো।
সূর্যোদয় সকালের গর্ভপাত নয় এ বেলায়।
কেউ বলুন।
মাথা তুলুন।
কেউ কি কোথাও ছিলেন?
না, নেই। চুপচাপ প্রকাণ্ড দেয়াল।
তাহলে অতীতের পৃষ্ঠা নেই একদম, ক্লিয়ার?
ঘোর কেটে গেছে, আরও দু পেগ।
পৃথিবীর গলিতে বাড়েনি দোকান।
ঘোর কেটে যায়,
আরো নীল হয়ে আসে চারপাশ।
তারপর? তারপর-
পরিব্রাজক পায় না উতলা নারীগন।
সব ঋষি মানুষের মাঝে পুরুষ,
সব সন্ন্যাসিনী মানুষের মধ্যে নারী।
শুনছেন?
কেউ কি কোথাও বর্তমান?
না,নেই। সকলি দুঃসময়।
তাহলে এখানে কেউ থাকে না আর আজকাল।
অতঃপর অন্ধকারের দেহে চলে-
ফলহীন শতবর্ষী বেদনার চাষ।
দ্বিগুণ বাড়ে ব্যথা,
বেড়ে চলে অচেনা সময়।
চিল এসে উড়ে যায়,
উড়ে উড়ে কোথা যায়?
জানে না সময়।
কেউ আছেন?
কোথাও কি কেউ আছেন?
না,নেই। সবি অন্ধ ভবিষ্যৎ।
জাতিস্মর
একাধিকবার পৃষ্ঠা উল্টেয়েছি দু’জনে মোড়ক উন্মোচনের আগে।
আউশ ধানের মতো তা,
শরীরের হাত রাখতেই ফুরুৎ করে নেমে যায়।
পিচ্ছিল গতিপথ, একটা ব্যাপার আছে!
তাজা ঘ্রাণ, তোমার ভাষায় একদম ভার্জিন।
মিলনায়তন বড্ড ফাঁকা, দর্শক শূন্য।
কোন হাহাকার নেই।
তুমি বললে, পাঠক ধ্রুপদী সাহিত্য কম বোঝে!
মেঝেতেই শষ্যা।
সাদা পায়রা পোষাক খুলেছে বালিশে।
টিমটিমে প্রদীপে জয়নুল আবেদিনের দূর্ভিক্ষ।
তুমি আদিম পাথরে ঠোঁট রেখে গাঢ় প্রণাম সারলে।
তোমার হাত প্রদীপ ছুঁয়ে নেমে আসতেই,জোছনায় আমরা কবিতার পৃষ্ঠায় নামি।
তোমার পূর্ব পুরুষের মতো চাইলেই তুমি ডুবুরি হতে পার, সে কাব্য লিখে চললে।
পাহাড়, জঙ্গল পেরিয়ে নেমে পড়লে জলে।
আমি চিৎকার করে বললাম, ‘মোড়ক উন্মোচনের আগেই ভিজে যাচ্ছে পৃষ্ঠা!’
তুমি বললে, ‘সৃষ্টির আগেই এক পুরুষ সে দায়িত্ব পালন করেছেন।’
গন্ধরাজের দিনগুলোতে প্রেম
সেই কবে, কোন একদিন হেমন্ত আসিয়া গেছে।
তবুও স্বস্তিদায়ক অপরাহ্নের বারো মাসের ছুটি।
ঘুঙুরের শব্দের মতো ছুটতে থাকা মেঘের দেয়ালে
আমি এঁকে রাখি অসংখ্য কবিতার প্রচ্ছদ।
একটি কমনীয় নদী আমার রক্তে তোলে বুদবুদ।
লাস্যময়ী সস্তা মেয়েদের মতো আঁছড়ে পরে তীরে
অতঃপর দখল করে সমুদ্রের প্রমোদ উঠোন।
এক্কা দোক্কার খেয়ালে খোলে আবেগী বসন।
প্রগাঢ় ঢেউ ঠোঁটে জন্মায় গদ্যময় কাঁপন।
হেমন্তের শেষে পূর্ণচ্ছেদে আসে শীতের দাপট।
তখন বিমূর্ত শরীর আরও গভীরে নামে,
তুলে আনে সাপের ফণার মতো অবয়ব।
শান্তির জল ভাসিয়ে দেয় শিশিরের ঘর।
জনপথ এখানে আরো নির্জন হয়ে আসে।
পাথরের চোখ ডুব দেয় ঘোলাটে আলোয়।
পরিণত বাতাসে দোলে দেশান্তরী গন্ধ।
তোমার বিস্তীর্ণ শরীর খোলে মহুয়ার দোকান।