জোবেদা আঁখি’ র পাঁচটি কবিতা

চিঠি
তোমাকে একটা চিঠি লিখব।
কাগজে কালিতে লিখার চেয়ে,
ইথারের বুকে শব্দের অক্ষরে লেখা চিঠি।
তোমার প্রশান্ত বুকের জমিনে মাথা রেখে,
উদাত্ত আকাশের নিচে বসে, সাহসী।
আমি লিখতে চাই সেই চিঠি।
কোথায় লিখবো এতো বড় চিঠি?
এ চিঠি ব্যতিক্রম।
প্রাপক জবাব দেবে তাৎক্ষণিক।
ইথারে ইথারেই।
অথবা, বুকের ভেতর জাপটে রেখে ফিসফিসিয়ে।
আমি মন্দ্রস্বরে একে একে বলে যাবো…
তোমাকে প্রথম দেখে আমার বুকের ভেতর ছলকে ওঠা।
প্রথম দেখাই তো!!!!!
অথবা, দেখার আগে অবশ পায়ে সিড়ি ভেঙে ভেঙে উঠার জড়তা,
বুকের ধুকপুক।
তুমি যখন অনতিক্রম্য দুরত্ব পার হয়ে
আলতো হাতে জড়ালে বুকের মাঝে।
ললাটে চুম্বন।
আমি নিজের কাঁপন ঠেকাতে
কি করে কামড়ে ধরেছিলাম ঠোঁট,
সে গল্প শোনাব।
তুমি আমার নখ দেখলে, চুলের গন্ধে আকুল হলে, নাকফুল, শাড়ি….
খা খা বুকে জাপটে ধরলে
আরেক শূন্য হৃদয়।
আমিও আকুল,
যেন কতকাল তৃষিত তপ্ত হৃদয়
তোমাকে পেলো।
তোমাকে লিখব আমার অনুভব,
তুমি যখন হাতে হাত ঘষে
সুগন্ধি ফেনা তুলে,
শিশুর মতো যত্নে
হাত ধুইয়ে দিচ্ছিলে,
তুমি যখন আমাকে
তুলে নিচ্ছিলে বুকের উপর,
তুমি যখন তোমার আরাধ্য চোখের পাতায়
চুমু খাচ্ছিলে অবিশ্রান্ত,
আমাকে পিষ্ট করছিলে বুকের তলায়,
ডাকছিলে আদুরে নাম ধরে,
দুরাগত নিশ্চিত প্লাবনে
ভেসে যাবার মুখে কি করে,
আমি সহসা বাঁধ দিলাম
সেই অনুভব তোমাকেই লিখবো।
তোমার অগোছালো চুলে আংগুল ডুবিয়ে,
কি করে আমি তোমার ভেতর পরে গেলাম,
ডুবে গেলাম আকন্ঠ।
সব লিখবো চিঠি।
কোথায় লিখবো এতো বড় চিঠি!!
সেই চিঠিতে তুমি আমার খোলা আকাশ,
মুক্তি আমার।
আমি তোমার
কাক চক্ষু গভীর জলের দীঘি।
প্রশান্তি তোমার সকল শ্রান্তিতে।
কোথায় লিখবো
এতো বড় চিঠি!!!!
অলৌকিক জীবন
আধেক রাতের আকাশ জুড়ে যৌবনা চাঁদ,
মায়াময় জোছনায় ভেসে যায় চরাচর।
ফিনিক ফোঁটা আলোর রাজ্যে,
আদিগন্তহীন রহস্যের বাঁক,
ছুটে যায় এ কূল ও কূল।
জোছনা পুড়িয়ে দেয় বিরহিনী আর্ত শরীর,
পুড়িয়ে দেয় হাক্লান্ত ভঙ্গুর মন।
এমনি এক আলোর ফুল ফোঁটা
হিমহিম মাঘী পূর্নিমার রাতে,
থইথই চান্নি পশরে,
রাতভর বসে থাকা পাশাপাশি,
বিনিময় হৃদয়ের ওম।
শুধু চুপচাপ বসে থেকে শুনে যাওয়া
অস্থির হৃদয়ের ডামাডোল।
এই অসহ্য সুন্দর শুভ্রতায়,
আচানক খুলে যায় হৃদয়ের দ্বার,
খুলে যায় মায়াবী সরোবর,
দূরে কোথা ডেকে যায় রাতজাগা নিশাচর,
বিষন্ন ডাহুকের গান।
চোখের কোলে
বিষাদ জমে জমে মায়ার কাজল।
অবরুদ্ধ স্বরে থেমে যায়,
সাগরের জলকল্লোল।
দূর হতে দুরাগত ঢেউ এসে,
চকিতে থমকে যায়
লুটিয়ে পরে চরন পল্লবে।
হাসিমুখ চাঁদখানা ঢলে ঢলে
বিলায় আলোর ফুল,
অকৃপন হৃদয়ের দান।
কত কাল যেন কেটে যায়,
পল অনুপলে, এই অলৌকিক আস্বাদে।
বন্ধ চোখের পাতা ছুঁয়ে থাকে হিমেল জোছনা,
যেন ভগ্ন হৃদয় জোছনায় পুড়ে হবে ছাই,
বুঝি চোখ মেললেই হারাবে নিমেষে
এই অপার্থিব অনুভব,
দুধ সায়রের ফেনিল অবগাহন।
নিশিডাক শুনে শুনে বিহবল মন,
জোছনা স্নানে পোহায় বিভাবরী।
তোমার ছায়া খুঁজি
আমার দেশে শিমুল রাঙা ভোর,
তোমার দেশে আলো কখন ফোটে??
একই রকম নরোম আলো?
মিষ্টি আছে ভরে?
জানতে ইচ্ছে করে।
তোমার দেশে পাখি ডাকে?
মৌমাছিরা ফুলে ফুলে ঘোরে?
ফিনিক দেয়া জোছনা রাতে শাপলা শালুক ফোটে?
হাসনাহেনার মাদক গন্ধে উদাসী হও বুঝি!!!
কারো হাসি, চুলের গন্ধ কভু মনে পড়ে?
তোমার দেশে তারার মেলা, অবাক জোনাক পোকা
আলোর ঝাপি মাথায় নিয়ে ঝোপে ঝাড়ে ঘোরে?
কচি ধানের শীষের দোলা
একটু মনে পড়ে?
আমার দেশের দখিন হাওয়ায় আমার বাঁশি সুর
ভাসিয়ে যদি দেই কখনো শুনতে পাবে তারে?
তোমার আকাশ জুড়ে কভু মেঘ জমেনা বুঝি?
আজো আমি মেঘের জলে তোমার ছায়া খুঁজি।
তোমার দেশে তুমি আছ,
আমার দেশে আমি।
কতটা ফাক, কত যোজন জানে অন্তর্যামী।
নদী ও নারী
এই নদী বয়ে চলে অবিরাম।
বয়ে চলে ক্লান্তিহীন, স্মৃতি জাগানিয়া।
এ নদী কথা কয়,
ডেকে চলে নিরন্তর জলের সিম্ফনি তুলে।
এখানে কাতর রমনীর চোখের জলের গাঁথা,
বাউড়ি বাতাসে কার দীর্ঘশ্বাস!!!
নদী বুঝি মন বোঝে রমনীর?
নদী বুঝি প্রিয়তমের মতো কখনো
ভালোবেসে ভুলিয়ে দেয় সব!!
কখনো আবার নিজেই হয় বিনিদ্র রজনীর শ্বাস?
নদী বুঝি ভালোবাসে!!!!
জলে জল ঢেউ তুলে মাতাল করে যখন
অপার্থিব তার জলকল্লোলে,
কখনো কি ডেকে নেয় তাকে?
যে রমনী হারায়েছে তার সব।
হারায়েছে উদাস দুপুর, বিকেলের খুনসুটি।
হারায়েছে বহু বছরের নিশ্চিন্তের ঘুম।
তার আলগোছে ফেলা বিরহের শ্বাসে,
কখনো কি জননীর মতো কাপে তার বুক?
কখনো জলের শব্দ শুনতে শুনতে
উদাস দুপুর কেটে যায়।
কখনো কান পেতে থেকে থেকে
শেষ হয় ত্রিযামা প্রহর।
কখনো প্রত্যুষের আধো অন্ধকারে
চোখ ফেটে জল আসে।
কখনো নির্জনতার ফাক গলে
নদীর জলে মিশিয়ে দেয় সে চোখের জল।
তবু আশায় থাকে মেয়ে,
কিশোরী থেকে রমনী হয়েছে যে
এ নদীর তীর ঘেসে, ভালোবেসে।
প্রিয় তার কখন আসে, কখন আসে।
রমনী
অলস দুপুর বেলা,
মগ্ন চৈতন্যে রমনী
শুনশান নিরবতা।
থেকে থেকে ঘুঘুর ডাক।
দুপুরের ঘ্রাণ!!!
রমনী!!!
রোদের গন্ধ পায়,
বাতাসের বার্তা বোঝে।
তাহার সখ্য দীঘির সাথে,
নদী আর মেঘের সাথে।
কাকচক্ষু জলের দীঘি
রমনীর দুচোখ।
কখনো উপচায়,
কখনো রাশ টানে
কাজলের সীমানায়।
নদীটা বয়ে যায়
সমগ্র জুড়ে।
তীর ঘেসে অশ্বত্থের গাছ,
পাখির কলতান, বিনম্র ছায়া।
জল মেখে শৈশব, কিশোরী বেলা,
ভীরু ভয় ছুয়ে ছুয়ে
রমনী হয়ে ওঠা।
নদী তার কাতরতা।
তার ঢেউয়ের ভাজে
খুন হওয়া দুপুর, রাতজাগা জোছনা,
নুপুরের ছন্দ, রাতের জোনাকি।
কথা গেঁথে গেঁথে বালুচরে ঘর।
প্রিয় মেঘ,
হৃদয়ের কোনে গেড়েছে আবাস।
যে মেঘে শরত নীল,
খোপার কাটা বেসামাল,
শিউলি, কামিনী ঘ্রাণ।
সেই মেঘ চুরি গেছে।
এখন মেঘ আকাশ ঢাকে
কেবলি আনত জলভারে।
নদীটা লুকালো দীঘির জলে।
এখন সে চোখ,
কাজলের বাঁধ না মানে,
যখন তখন উপচায়।
এখন দীঘি টইটম্বুর,
নদী পলাতক।
মেঘের মানে কেবল
বৃষ্টির আশংকা।
অলস দুপুর রমনীর,
নির্ঘুম রাত।
তাহার অসহ্য অবসর…
দীঘি, নদী, মেঘ।
জোবেদা আঁখি : কবি
কবি, অভিনন্দন! প্রতিটি কবিতাই বৈশিষ্ট্যময়। শব্দগুলোও সুন্দর, ইথারে ইথারে ভেসে আসা…। শুভকামনা রইল।