সাহিনা মিতার একগুচ্ছ কবিতা

স্ত্রী
তারপর?
তারপর তোমাকে আর কোথাও দেখিনি,
যেই জবা রং শাড়িতে আমাকে রেখে গিয়েছিলে পূর্ব নিজড়ায়,
কাঁটা নদীর কুল ঘেসে দাঁড়িয়ে থাকা বটগাছটি জানে, কতকাল ছাড়িনী সেই রং,
জানে, কতটা বিশ্বাসে প্রতিদিন অপেক্ষা করি।
ফিরেছি আমি, কাঁচের মতো ভেঙেছি, সুযোগ পেলেই আবার জুঁড়েছি আমাকে।
কতজন হারিয়েছে শরীরের আর কতজন জীবনের অঙ্গ! তুমিওতো যুদ্ধে গেলে,
বেঁচেছো, নাকি বাঁচো নাই?
মুক্তির পরে শেষবারের মতো পার হয়েছি কাঁটা নদী, ভিটায় ফিরেছি,
আর কোনদিন যাওয়া হয়নি ওপারে,তোমাকে খুঁজিনি, মনে হলো আসবে ..!!
মায়ের মনে ছিল না আমার জন্মের দিন–ক্ষণ,
বড় হয়ে শুধু বলতে শুনেছি সেবার অনেক ধান হয়েছিল,
ধানপাকার মৌসুমে জন্ম আমার, বাড়ি বাড়ি মা-ঝিয়েদের কাজ আর কাজ,
কারোও একটুকু ফুসরৎ ছিল না পোয়াতি মায়ের খবর নেয়!
পঁচাত্তরে আমি, গ্রামের লোকে বলে।
বন্দি ফেরৎ বলে কেউ আর বুকে নিল না,
অথচ আমি কেমন বুক পেতে বশে আছি তোমাকে নিতে।
তবে কত জনাই হাতপেতে দানে চেয়েছে বাসি বৈভব!
অষ্টাদশরী কত চাঁদ তোমাকে দেখিয়ে তাচ্ছিল্য করে গেছে আমার চুল ও চিবুকের,
ঠোঁট ও হাসির,কি করে অশ্বিকার করি, নথের অভিমান বুঝনি তাও-তো নয়,
কেবল আমার টানের চেয়ে অধিক ছিলো যুদ্ধ নেশা।
ঘোলাটে চোখ দুটি বন্ধ হয় হয় বলে, এখন আর নদীটিকে দেখি না,
নিজড়ার ঘাটে ট্রলার থামলে ঠিক বুঝতে পারি না ওই ভীড়ে তুমি আছ কি না।
শুধু ধুপ-ধাপ শব্দ আর কোলাহল,তবে এখনো ঘাটে খানসেনা নামে,
বুটের আওয়াজ পাই, পাই শরীরের উৎকট গন্ধ।
আজও আসো নি তুমি! বাতাস শুকি, তোমার গায়ের ঘ্রাণ পাই না স্বামী!
দু’চোখ বন্ধ না হোক, আরেকটা জীবন এখানেই বশে থাকব,
একটা প্রশ্ন যে রয়ে গেছে বাকি,তোমার কাছে,
আমি কি তোমার সধবা ছিলাম, নাকি বিধবা?!!
অসাম্প্রদায়িকতা: ভিতর-বাহির
স্বাভাবিক আর্দ্রতা আমার অঞ্চল ফেরারি
মাঘীশীতে পথে পথে দাবদহ,
পুড়ে টিনের চাল,খড়ের গাদা,পালিত পশু,
পাগলের মতো খৈ হয়ে ফুটে গোলার ধান;
ভাত পুড়ে, মাছ পুড়ে,
মানুষের প্রতিলোকমা ভরে উঠে ছাইয়ে!
পানযোগ্য জল পুড়ে, গাত্রের বসন পুড়ে,
পুড়ে যায় যুবতীর লাজ।
একমাত্র ভ্যানপুড়ে,
মালোপাড়ার মন্ডা,মুদি-দোকানের মাল পুড়ে,
মন পুড়ে,জন পুড়ে, বারন্ত গাছ পুড়ে
হাটু-মাথা এক হওয়া বৃদ্ধার চুল পুড়ে!
তপ্ততা লোপ পায়,
দাবদহ থেমে আসে।
নবান্ন শুরু হয় বাঙালির প্রাণে প্রাণে,
পিঠা চলে, চিড়া চলে, খেঁজুরের রস চলে,
ঘরে ঘরে লালগুড়ে পুলি ও পায়েস চলে
উৎসব আমেজে তাঁদের বিদায় চলে!
মুক্তির যাত্রা
কাঁধে-পায়ে শিকল নিয়ে চলেছি ষোড়ষ যুগের বেশি
তেজি ঘোড়া ছুটিয়ে মাড়িয়েছি শিদ্ধ-নিশিদ্ধ পথ
আর ঘাড়ের উপর চেপে বসে ছিল দেঁতেল দানব
চাবুক চাপড়ে ছুটিয়েছে আরও তেঁজ, লাল-সোনালির দিনে!
বহুদূর যাব, যদিও এসেছি বহু দূর হতে।
সময়ের হিসাবে যত, দাসত্বের হিসাব তারচে বেশি
কাঁধে করে লাঙল জোয়াল,বলদের মতো চষে গেছি
বর্গ–বর্গ মাইল,ঘামে-শ্রমে আর চুয়েপড়া রক্তের দাগে
চিহ্নিত হয়েছে উনসত্তর হতে একাত্তরের পথ।
বৃক্ষপুরাণ
ফিরতি পথের রবি, দয়াভরে একবার চেয়েছিল এই চোখে,
তারপর পথগুলো ভুলে গেল পথ! ইটভাটা হয়ে কাচামাটি
জ্বালিয়েছি উদরের অতলে, দলা-দলা উগড়েছি কালো শ্বাস।
বন্ধ্যাবৃক্ষ! পারে না জাগাতে নব কিশলয়, দূরকথা ফুল আর ফল!
ভয়গুলো স্লোগান ধরে মিছিলের মতো, উপড়ে নেবে মূল!
আলোর দিকে মুখকরে তালবৃক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি বহুযুগ,
সে অবধি একটিও বাবুই বাসা বুনে নাই গায়ে, আবাসনের
আস্থাহীনতায় সবপাখি ফিরিয়েছে মুখ! হতাশাপোক্তপাতা
ভায়োলিনে ব্যথাসুর সাঁধে! আহা! মায়ামুখ, মোম চোখ!
স্রষ্টার মতো অস্পৃশ্য! নিস্ফলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি কতযুগ!
তবে, ঘুমদেবী স্নেহময়ী,আদরে আগলে রাখে গতিময় ঘড়ি।
বেতরঙ্গী প্রাণ
ক্ষুদ্রগুলি বৃহৎতের চেয়ে বৃহৎ, এই যেমন-ভেটফুল, ঘেচুদল,
ঠেসে থাকা কচুরির গাঁদা, নিয়তির মতো স্থির হয়ে থাকে
আধডোবা ব্রিজ, ইটাবাড়ি,খালপাড়,খড়গাদা,মেটেল ঘ্রাণ,
সাপের খোলস,আগাছাক্ষ্যতি। পলিশ নগরায়নের চেয়ে
ঢেরবেশি প্রাণেশ, ইচ্ছা মতো লম্বাশ্বাস….
মরিচাবাতি অথবা নিয়নপ্রিয় রাত,অবশ্যিক প্রসাধনীনন্দন
মুখোশাশ্রয়ী বড় প্রাণ থেকে প্রাণজ-শালুক পাতার উপরে
বসা আয়েশি ব্যাঙপ্রাণ,মৌসুমি পলির তলে তলিয়ে থাকা
জলকীট,শ্যওলা বা মীনপ্রাণ,শোলপোনা, পাতার পাথলা-
পলিশ আমি, তুমি, তাহাদের চেয়ে…
প্রসঙ্গ প্রাণগুলো আপাতদৃশ্যে প্রতিদিনের মতো পুরোনো।
এই যেমন কুপি-কেরোশিন, পুরনো হারিকেনের চিমনি,
ছারপোকা, তালি দেয়া পাল, নৌকার ছই, বেতরঙ্গী মাছ,
চলতি ভাষা, প্রাইমারি পাঠ, মাস্টার মশাই,ছোট ঢ্রেউ,
কেবল অগভীর থেকে গভীরের দিকে ধাবমান…
সাহিনা মিতা: ১৯৮১ সালে ২৪ মে কুমিল্লার দাউদকান্দিতে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকার ইডেন মহিলা কলেজ থেকে ‘বাংল’ য় সম্মান ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ লেখালেখি করেন। এখন পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে তিনটি বই।গ্রন্থ তিনটি হলো: অন্তকাব্য, বঙ্গবিলাপ, রুপার পরাগ। লেখালেখির ছাড়া সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। মুক্ত আসর এর সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে কাজ করছেন।
খুব ভাল লাগলো।
ভবিষ্যতের জন্য শুভকামনা রইল।
চমৎকার লেখনি
Please know I have deep feelings about your generous poetries.
I really appreciate you.
You are brilliant and that is splendid!
“বহুদূর যাবো, যদিও এসেছি বহুদূর হতে….”
কি অসাধারণ রূপকালঙ্কার দিয়ে সাজানো কবিতা গুলো…