সার্ধ দ্বিশতবর্ষেও প্রাতঃস্মরণীয় ভারতাত্মার মূর্ত মূর্তপ্রতীক রাজা রামমোহন রায়

জন্মের আড়াইশো বছর পরেও এখনো তিনি সমানভাবে ভারতীয় সমাজ সর্বোপরি বাঙালি মানুষের স্মরণীয়-বরণীয় গ্রহণীয়। লৌহসম মানসিকতা বিদগ্ধ পাণ্ডিত্য বিজ্ঞতা মহানুভবতা উদারতা সরলতা পরধর্ম সহিষ্ণুতা এবং আমৃত্যু মনুষ্যত্ব ও মানবতার পূজারি, বার্তাবাহক রূপে নিজেকে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। ঋজু ব্যক্তিত্ব চারিত্রিক দৃঢ়তা যুক্তিবাদী চেতনা সত্যবাদিতা আপোষহীনতা এবং যাপিত জীবনের পরতে পরতে নির্মাণ মুখী সৃষ্টিশীল কর্মমুখর চিন্তাভাবনার বাস্তবায়নের দৃঢ় অঙ্গীকার। আরাম-আয়েসের জীবন পরিত্যাগ করে জীর্ণ কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত সমাজব্যবস্থাকে জীবনকে বাজি রেখে পাল্টাতে চেয়েছিলেন। মনে প্রাণে মানবহিতৈষী বিজ্ঞানমনস্ক জ্ঞানদীপ্তির আদর্শে লালিত তার প্রতিবন্ধকতায় পূর্ণ জীবন। একেশ্বরবাদকে মনেপ্রাণে আঁকড়ে ধরে পেয়েছিলেন ধর্মের প্রকৃত অর্থ আদর্শবাদ সাধারণের বোধগম্য করতে। সামাজিক ভেদাভেদ জাত পাত গোঁড়ামি নির্মূল করে পাশ্চাত্য দর্শন ও শিক্ষা আলোয় উদ্ভাসিত করতে চেয়ে ছিলেন ভারতীয় জনসমাজকে।
আরাম-আয়েসের জীবন পরিত্যাগ করে জীর্ণ কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত সমাজব্যবস্থাকে জীবনকে বাজি রেখে পাল্টাতে চেয়েছিলেন। মনে প্রাণে মানবহিতৈষী বিজ্ঞানমনস্ক জ্ঞানদীপ্তির আদর্শে লালিত তার প্রতিবন্ধকতায় পূর্ণ জীবন। একেশ্বরবাদকে মনেপ্রাণে আঁকড়ে ধরে পেয়েছিলেন ধর্মের প্রকৃত অর্থ আদর্শবাদ সাধারণের বোধগম্য করতে। সামাজিক ভেদাভেদ জাত পাত গোঁড়ামি নির্মূল করে পাশ্চাত্য দর্শন ও শিক্ষা আলোয় উদ্ভাসিত করতে চেয়ে ছিলেন ভারতীয় জনসমাজকে।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না আঠারো এবং উনিশ শতকে বাংলার মাটিতে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা-এসব ক্ষেত্রে যে যে পরিবর্তন এসেছে তার জন্য পুরো কৃতিত্ব রাজা রামমোহন রায়ের। তাঁর সঙ্গে আরও অনেকেই সে সময় কাজ করেছেন। কিন্তু শুরুটা করে দিয়েছিলেন তিনিই।

আজকে আমরা বাংলায় যে সমাজ দেখি, শিক্ষার দিক দিয়ে যে পরিবর্তনের ধারা দেখি, তার বীজ বপন করে দিয়েছিলেন রাজা রামমোহন রায়। তার অবদান আরও বেশি করে মনে রাখার মতো এবং গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সে সময় ইংরেজদের আধিপত্য ছিল বেশি। তাদের নির্দেশেই সকল কাজ হতো। এরকম সময়ে বাঙালি হয়ে নিজের মতাদর্শ প্রকাশ করা এবং প্রচার করা অত্যন্ত সাহসিকতার কাজ ছিল নিঃসন্দেহে।
অবিভক্ত বাংলায় পলাশীর যুদ্ধের পনেরো বছর পরে বাংলার রাধানগরে ১৭৭২ সালের ২২ মে রাজা রামমোহন রায়ের জন্ম। একটি সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম হয়েছিল তার। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে কাজ করে ইচ্ছা করলে তিনি আভিজাত্যপূর্ণ জীবন অতিবাহিত করতে পারতেন। কিন্তু সেটা না করে তিনি বাংলার বাইরে বের হয়েছেন। বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন, সেসব দেশের সংস্কৃতি, সামাজিকতা ও রাজনীতির সংস্পর্শে এসেছেন। নিজ দেশের বাংলা, ইংরেজি কিংবা হিন্দি ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি অন্য দেশের মানুষের সাথে নিজেকে যুক্ত করার জন্য ফার্সি, আরবি, হিব্রু ও গ্রিক ভাষা শিখেছেন। নিজের দেশের সাহিত্যের পাশাপাশি পশ্চিমা বিশ্বের সংস্কৃতি এবং তাদের সৃষ্ট সাহিত্য আয়ত্ত করেছিলেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, পৃথিবীর পূর্ব দিকে অবস্থিত অন্যান্য দেশের সাহিত্যকর্ম নিয়েও তার অগাধ জ্ঞান ছিল। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তার পড়াশোনা থাকার কারণে তিনি ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বাংলার বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক অবস্থা নিয়ে সমালোচনা করতে পেরেছেন এবং সেখানকার রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে নিজের ভাবনাকে প্রকাশ করতে পেরেছেন।উত্তর উনিশ শতকে বাংলার সমাজ সংস্কারক আন্দোলনের ইতিহাসে যে-সমস্ত জ্যোতিষ্ক চিরস্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন,তাঁদের মধ্যে একজন বাস্তববাদী ও মানবতাবাদী সংস্কারক ছিলেন ভারত পথিক রাজা রামমোহন রায়। তিনি ছিলেন, ভারতীয় উপমহাদেশের আধুনিক চিন্তা-চেতনার ধারক ও বাহক, কট্টর বর্ণবাদী হিন্দু সমাজের নানা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠ, সামাজিক সংস্কারক, শিক্ষানুরাগী এবং নারী মুক্তি আন্দোলনের অগ্র পথিক। তাই কেউ তাকে ভারতের আধুনিক যুগের প্রবর্তক, কেউ মানবতার প্রবক্তা হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি ভারতের আধুনিকীকরণের সূর্যকরোজ্জ্বল প্রত্যুষ ঘোষণা করেছিলেন।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই যথার্থই বলেছেন,”He was born at a time when….we had entered the zone of uncreative habit.of decadent tradition and ceased to exercise our humanity.” তাই যথার্থই তিনি হলেন,”The inaugurator of the modern age in India.”তিনিই সর্বপ্রথম অস্পৃশ্যতার কুফল কে তুলে ধরেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, সমগ্র পৃথিবীতে শুধুমাত্র একটাই জাতি আছে, আর তা হল মানব জাতি। তাই তিনি মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ, জাত্যাভিমান এবং জাতি বিদ্বেষকে পুরোপুরি ভাবে দূর করতে সর্বোত্তম হয়েছিলেন ও এইভাবেই তিনি তদানীন্তন হিন্দু সমাজের মানুষজনের মধ্যে কার জল-অচল জাত প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন অত্যন্ত জোরালো প্রতিধ্বনিতে। আমৃত্যু চেয়েছিলেন এক আধুনিক, সংস্কারমুক্ত জ্ঞানের আলোয় প্রসারিত মনুষ্যত্বের চেতনায় উদ্বেলিত অনুপ্রাণিত ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থা।

রাজা রামমোহন রায় ছিলেন আধুনিক ভারতের এক নব ও মহান রূপকার।
রামমোহন রায় মনে করতেন শিক্ষার লক্ষ্য হবে ব্যক্তি ও সমাজকল্যাণ। শিক্ষার মাধ্যমে যাতে শিশুর চিন্তা চেতনা ও যুক্তিবাদী মননের বিকাশ ঘটে। শিক্ষার মাধ্যমে তিনি মানুষের মনে পরিপূর্ণ বিকাশ ও উন্নতির ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি শিক্ষার মাধ্যমে- পাশ্চাত্যের জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রয়োজনীয় দিকগুলিকে গ্রহণ করে প্রাচ্যশিক্ষার পুনুরুজ্জীবন ঘটানোর কথা বলেছেন। সঙ্গে ভারতীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতির উৎকৃষ্ট দিকগুলিকে সংরক্ষণ করে জনগণের নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ সাধনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছিলেন।

রামমোহন রায় মনে করতেন শিক্ষার লক্ষ্য হবে ব্যক্তি ও সমাজকল্যাণ। শিক্ষার মাধ্যমে যাতে শিশুর চিন্তা চেতনা ও যুক্তিবাদী মননের বিকাশ ঘটে। শিক্ষার মাধ্যমে তিনি মানুষের মনে পরিপূর্ণ বিকাশ ও উন্নতির ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি শিক্ষার মাধ্যমে- পাশ্চাত্যের জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রয়োজনীয় দিকগুলিকে গ্রহণ করে প্রাচ্যশিক্ষার পুনুরুজ্জীবন ঘটানোর কথা বলেছেন। সঙ্গে ভারতীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতির উৎকৃষ্ট দিকগুলিকে সংরক্ষণ করে জনগণের নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ সাধনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছিলেন। ভারতে বহু-বিবাহ ও বর্ণভেদ প্রথার বিরুদ্ধেও রাজা রামমোহন রায় তীব্র আন্দোলন চালিয়ে যান। নারী ও পুরুষের সমানাধিকার এবং বিষয় সম্পত্তিতে নারীদের উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যও তিনি লড়াই চালিয়ে গেছেন।তিনি তদানীন্তন কু-সংস্কারাচ্ছন্ন ভারতবর্ষকে আধুনিকীকৃত উন্নত চিন্তা চেতনার আলোকে প্রস্ফুটিত করে তোলার ক্ষেত্রে পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি তাঁর অদম্য উৎসাহ, তেজস্বী মনোবল, প্রগাঢ় প্রজ্ঞা, উন্নত চিন্তা ধারা এবং ব্যাপক দূর- দৃষ্টির মাধ্যমে ভারতের ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন। তিনিই ছিলেন ভারতের নবজাগরণের পথে আলোকবর্তিকা তথা ধ্রুবতারা স্বরূপ এবং উনবিংশ শতাব্দীর উন্নয়নমুখী ভারতের আলোর দিশারী প্রমেথিউস এবং আধুনিক ভারতের মহান রূপকার।এইখানেই নিহিত রয়েছে আধুনিক ভারতের গঠনে রাজা রামমোহন রায়ের অনন্য অবদান। তাঁর অবদান আধুনিক ভারতের ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত আছে,আর থাকবেও।তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন আধুনিক এক ভারতের। দেশের মানুষকে অতীতমুখী, মধ্যযুগীয় মানসিকতার গণ্ডি থেকে বের করে এনে এক নতুন যুগের জীবন দর্শনের আলো দেখানোই ছিল উদ্দেশ্য। গভীর ইতিহাস চেতনা, দৃঢ়তা আর ঈশ্বরবিশ্বাস তাঁর জীবন সংগ্রামে বার বার প্রকাশ পেয়েছে। তবু, তাঁর কর্মকাণ্ডের জন্য তৎকালীন হিন্দু পণ্ডিতসমাজ তাঁকে ‘পাষণ্ড’, ‘ম্লেচ্ছ’, ‘বকধূর্ত’, ‘কাপটিক’, কিংবা ‘নগরান্তবাসী’ নামে সম্বোধন করেছিলেন। এমনকী, এক সময় হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের গোঁড়া, ধর্মান্ধ, অসহিষ্ণু কিছু মানুষ তাঁর প্রাণনাশেরও চেষ্টা করেছিল। সে জন্য তাঁকে কম হেনস্থাও হতে হয়নি। তবু, চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও মানুষকে ভালবেসে, বদ্ধ এই সমাজের মধ্যে আলোড়ন তুলে তিনি চেয়েছিলেন সমাজ ব্যবস্থার ক্ষতিকারক নানা দিক বদলে ফেলতে- তিনি রাজা রামমোহন রায়।

এখন প্রশ্ন উঠছে আজকের ভারতে এমন এক ফ্যাসিবাদের শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন যারা প্রাক-আধুনিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী যারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে ভারতকে নিয়ে যেতে চাই প্রাক আধুনিকতার তার একটি বিশেষ ধর্মের দর্শনের অনুশাসনে বিশ্বাসী যারা প্রত্যাখ্যান করে সর্বধর্ম সমন্বয়ের ভাবনা, যারা প্রতিনিয়ত ছড়াই বিদ্বেষ বাণী ভেঙে দেয় সম্প্রীতির আজন্ম লালিত স্থিতিশীলতা, গড়ে দেয় অবিশ্বাস অশান্তির অমানবিক প্রাচীর। নিয়তির কি নিষ্ঠুর পরিহাস রামমোহনের সময়কালে যারা ছিলেন তার প্রচন্ড প্রতিপক্ষ তারা যেন আবারো পুনরাবির্ভাবে সম্প্রীতির পীঠস্থান বহুত্বের মিলনক্ষেত্র ভারতবর্ষে মেলে দিয়েছে ক্ষমতার জাল । কেবলমাত্র অনুপস্থিত রামমোহন। এই আদ্যান্ত যুক্তিবাদী জ্ঞানদীপ্ত সংস্কার সচেতন তথা মানবতার মূর্ত প্রতীক ও ভারত পথিক রাজা রামমোহন রায় কে হিন্দুত্বের নির্মাণ করার অপপ্রয়াসকে যদি সমূলে উৎপাটন করতে হয় তাহলে প্রয়োজন হবে তার পুনর্নির্মাণ এবং তার জন্য অবশ্যই প্রয়োজন যথাযথ ইতিহাস চেতনা গবেষণা অধ্যায়ন। বর্তমান সাম্প্রদায়িকতা , হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রচন্ড আস্ফালন, উগ্র জাতীয়তাবাদ, অসহিষ্ণুতার বিষবাষ্পে জর্জরিত সম্প্রীতির বৈচিত্রের সর্বধর্ম সমন্বয়ের অনুসারী লালিত ভারতবর্ষে রাজা রামমোহন রায়ের জীবন দর্শন চিন্তা ভাবনা ও কর্মকান্ড স্মরণ ও মেনে চলা দারুণভাবে গুরুত্ব পূর্ন ও প্রাসঙ্গিক। কিন্তু আজও বোধ হয় আমরা আত্মসমীক্ষা আত্মপর্যালোচনা মূল্যবোধ নৈতিকতার দরকার নেই নিজেদের মূল্যায়ন করতে অপারগ হয়েছি এবং আত্তীকরণে যথেষ্ট ফাঁকফোকর থেকে গিয়েছ রামমোহনকে। আসুন আমরা মুক্তমনে জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে মানবতার দর্শনে উদ্বুদ্ধ অনুপ্রাণিত হয়ে আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরি মেনে চলি স্মরণ করি প্রথম ভারতীয় আধুনিক রাজা রামমোহন রায়ের জীবন দর্শন প্রতিটি পদক্ষেপে আমাদের জীবনের চলার পথে। সেখানেই লুকিয়ে আছে উত্তরণের জিয়ন কাঠি।