ড. রাধাকৃষ্ণণ স্মরণে প্রতিবছর ‘শিক্ষক দিবস’ উদযাপনে শিক্ষকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বাড়িয়ে দেয়

শিক্ষক দিবসের আলোয় সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ। ছবি : agamikalarab
আবহমানকাল ব্যাপী এটা ধ্রুব সত্য যে শিক্ষক ছাড়া কোন জাতির সর্বাঙ্গীণ উন্নতি কখনই সম্ভব নয়। তাই শিক্ষা প্রদানের নিরবচ্ছিন্ন দায়িত্ব ভার যাঁদের হাতে ন্যস্ত, তাঁরা সকলেই সামাজিক চিরকালীন শ্রদ্ধার পাত্র। আমরা সকলেই জানি শিক্ষককুল মানুষ গড়ার কারিগর, অজ্ঞতার তমস দূর করে তারা কোমলমতি, নবীন শিক্ষার্থীদের নিয়ে যান জ্ঞানালোকের পরম তীর্থে অপরিণত ভাবনা, মেধা, মনন,চেতনাকে পরিণত ও পরিপূর্ণ হয় উঠতে সর্বাত্মক সাহায্য করেন তাঁরা। শিক্ষার্থীদের তাঁরা শুধু পুঁথিগত শিক্ষা প্রদান,বিষয়ভিত্তিক দান করেন না তাদের মধ্যে জাগ্রত করেন নীতিবোধ , মূল্যবোধ, বিবেক চেতন, সামাজিকতা, সহনশীলতা। মার্জিত করে তোলেন তাদের রুচিবোধ । তাদের সামনে তুলে ধরেন পরিপূর্ণ জীবনের আদর্শ যেখানে খুঁজে পাই মানুষ হবার সহজপাঠ চিরায়ত ও রসদ । সেজন্য প্রতিটি দেশে সমাজ জীবনে শিক্ষকদের গুরুত্ব এত বেশি ও সুদুরপ্রসারি।
তারা পরম শ্রদ্ধেয়, সম্মানীয়। সেজন্যই সমাজের কাছে শিক্ষক কূলের প্রচন্ড মান্যতা, সমাদর, ভক্তি ।তাই তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মাননা, কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা নিবেদনের জন্য এই দিনটিকে আলাদা করে রাখা হয়েছে। এই বিশেষ তারিখটিকেই বা কেন ‘শিক্ষক দিবস’ রূপে উৎসর্গীকৃত করা হয়েছে সে বিষয়ে আমাদের অবগত হওয়ার প্রয়োজন।এক জন সফল মানুষের পেছনে শিক্ষকের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে, তা নতুন করে বলার কিছু নেই। সেই শিক্ষক যে পড়াশোনার ক্ষেত্রেই হতে হবে, তানয়। তিনি থাকতে পারেন জীবনের যে কোনও ক্ষেত্রেই। তিনি যে পড়ুয়াকে শেখাবেন , তাই নয়। তিনি তাকে জীবনে চলার পথে পরামর্শ দেবেন, ব্যর্থতায় পাশা দাঁড়িয়ে উৎসাহ দেবেন, সাফল্যের দিনে নতুন লক্ষ্য স্থির করে দেবেন।
তিনি তাকে শুধু সফল নয়, একজন ভাল মানুষ হতে শেখাবেন।স্বাধীনতার সাড়ে ছয় দশক অতিক্রান্ত হলেও ভারতের প্রায় অর্ধেক মানুষ কার্যত নিরক্ষর। আর এই নিরক্ষর মানুষ অন্ধজনের সমান । কেননা তাঁদের চারিদিকে অজ্ঞানতার অন্ধকার। সেই নিরক্ষর অন্ধজনে প্রাণের প্রদীপ জ্বালাবে কে? কে জোগাবে মৃতজনে জীবনের উদ্ভাস ? সে তো একজন শিক্ষক । আদর্শ শিক্ষক । একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক । কেননা শিক্ষকরাই যুগে যুগে মানুষ গড়ার কারিগর। তাঁরাই দিনের পর দিন শিক্ষার্থীদের যথার্থ মানুষ করে তোলেন। তাঁদের কাছ থেকে পাঠ নিয়েই এই ছাত্র-ছাত্রীরা আদর্শ নাগরিক হয়ে ওঠে। দেশ ও জাতির মুখ উজ্জ্বল করে। সুতরাং সমাজে শিক্ষকের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।

আমার মতে, তারাই সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজবন্ধু । তাঁরা সকলেই শ্রদ্ধাভাজন এ হেন দৈনন্দিন শ্রেষ্ঠ সমাজ বন্ধুদের স্মরণে একটি বিশেষ দিন নির্দিষ্টকরণ একটি সামাজিক কর্তব্যও বটে । আর সেইটি যদি বিশিষ্ট শিক্ষাব্রতী ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের জন্মদিনকেই উৎসর্গ করা হয় তবে তার মতো উপযুক্ত দিবস উদযাপনের তাৎপর্য আর কী বা হতে পারে।একাধারে রাজনীতিবিদ, দার্শনিক ও অধ্যাপক এই শান্ত মানুষটি ছাত্রজীবনে অতি মেধাবী ছিলেন। জীবনে কোনও পরীক্ষায় দ্বিতীয় হননি। বিভিন্ন বৃত্তির মাধ্যমে তাঁর ছাত্রজীবন এগিয়ে চলে। ১৯০৫ সালে তিনি মাদ্রাজ খ্রিস্টান কলেজ থেকে দর্শনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তার বিষয় ছিল ‘বেদান্ত দর্শনের বিমূর্ত পূর্বকল্পনা’।
বিশ্বের দরবারে তিনি অতি জনপ্রিয় দার্শনিক অধ্যাপক হিসাবেও পরিচিত ছিলেন। ১৯৩১ সালে তাঁকে ব্রিটিশ নাইটহুডে সম্মানিত করা হয়। ১৯৫৪-তে ভারতরত্ন সম্মান পান। প্রথম জীবনে তিনি মহীশুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা করেন (১৯১৮)। এ সময় তিনি বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য পত্রিকায় লিখতেন। সে সময়েই তিনি লেখেন তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘ দ্য ফিলোজফি অফ রবীন্দ্রনাথ টেগোর’। দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘দ্য রেন অফ রিলিজিয়ন ইন কনটেমপোরারি ফিলোজফি’প্রকাশিত হয় ১৯২০সালে। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েও অধ্যাপনা করেন। দেশ–বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বারবার অধ্যাপনার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছেন।রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তাঁর গুণমুগ্ধ ছাত্র ও বন্ধুরা তাঁর জন্মদিন পালন করতে চাইলে তিনি বলেন জন্মদিনের পরিবর্তে ৫ সেপ্টেম্বর যদি শিক্ষক দিবস উদ্যাপিত হয় তবে আমি বিশেষরূপে অনুগ্রহ লাভ করব।সেই থেকে এই দিনটি ভারতে শিক্ষক দিবসরূপে পালিত হয়ে
স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে শিক্ষকদের এই দায়বদ্ধতা আরও অনেক বেশি। ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি সদয় কর্তব্যপরায়ণতা, নিষ্কলুষ চরিত্র, নিয়ম নিষ্ঠা ও সময়ানুবর্তিতা ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা শিক্ষকদের অন্যতম পালনীয় কর্তব্য । প্রতিবছর ‘শিক্ষক দিবস’ উদযাপন শিক্ষককূলের দায়িত্ব ও কর্তব্যকে যেন অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়।

আমাদের জাতীয় জীবনে শিক্ষা ও শিক্ষকের স্বার্থে ‘শিক্ষক দিবস’ উদযাপনের গুরুত্ব অপরিসীম । সমাজে শিক্ষককূল অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ । তাঁরাই জাতির মেরুদন্ডস্বরূপ । তাঁরাই আগামী দিনের কান্ডারী-নির্মাতা । তাঁদের অবলম্বন, অনুকরণ ও অনুসরণ করেই ছাত্র সমাজ তথা ভবিষ্যতের সুনাগরিকবৃন্দ গড়ে ওঠে । তবে একথা অনস্বীকার্য,এই করোনাকালীন শিক্ষকদের ভূমিকা খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তালা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তারা যেন ঝিমিয়ে পড়েছে। যতদিন না পরিস্থিতির স্বাভাবিকতায় স্কুল খুলছে শিক্ষকদের বিকল্প পদ্ধতিতে পাঠ দামের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ধারাকে বজায় রাখতে হবে। এই মুহূর্তে আপামর শিক্ষকদের এগিয়ে আসতে হবে নতুন চিন্তা ভাবনা সর্বোপরি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা প্রদানের কথাটিকে মাথায় রেখে ।
আমি মনে করি, উপযুক্ত শিক্ষকদের আরো শ্রদ্ধার আসনে বসাতে হবে। শিক্ষার্থীদের এই মানসিক সংকটের হাত থেকে তাদেরকে সুরক্ষা বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে শিক্ষা প্রদানে, পাঠদানের শিক্ষকদের সম্মিলিত মানবিক প্রয়াস চালাতে হবে । তাঁদের সব ধরনের নিরাপত্তা ও সুযোগ দিতে হবে । তাহলেই ভারত আত্মার শ্রেষ্ঠ প্রতীক দুর্জয়, মেধাবী, ভারত তথা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের জন্ম দিবস তথা ‘শিক্ষক দিবস’উদযাপন সার্থক হবে । আসন্ন শিক্ষক দিবসে শিক্ষকদের আরো বেশি দায়বদ্ধ, মানবিক, বাস্তবিক চিন্তাভাবনার পরিকল্পনা নিয়োগ এগোতে হবে যেখানে যেখানে শুধুই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রকৃত শিক্ষা প্রদানের মধ্যে দিয়ে আদর্শ মানুষ হওয়ার পাশাপাশি দেশ গঠনের কান্ডারি ও নাগরিক হিসেবে গড়ে কান্ডারি নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। করোনাকালে শিক্ষক দিবসে এটাই হয়ে উঠুক মানুষ গড়ার কারিগরদের চ্যালেঞ্জ ও সামাজিক অঙ্গীকার।