মৈত্রেয়ী দেবীর ১০৮তম জন্মদিনে অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ভালোবাসা ভালোবাসা।

আধুনিক বাংলা সাহিত্যে যে কয়েকজন আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস রচনা করে পাঠকসমাজে সমাদর, প্রশংসা, উজাড় করা ভালোবাসা প্রাপ্ত হয়েছেন তন্মধ্যে লেখিকা মৈত্রী দেবী অন্যতম। সৃজনশীল চিন্তাভাবনা, জীবন দর্শন, অভিজ্ঞতা লব্ধ, ঘটনার জারণে তিনি ছিলেন এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী অনন্য সাহিত্য নিবেদিতপ্রাণ প্রতিভূ। সামাজিক প্রতিচ্ছবি নিখুঁত প্রতিফলনের পাশাপাশি মনুষ্য জীবনের ঘটে যাওয়া ঘনঘটা, চিন্তা চেতনা, প্রেম ভালোবাসা, কামনা বাসনা, জৈবনিক প্রবৃত্তির ধারাকে সুচারু, সুষম সুললিতভাবে ভাষার বুনোটে বেঁধেছিলেন মৈত্রেয়ী দেবী। আপামর বাঙালি পাঠক তাঁর সৃষ্টিশীলতায় বুঁদ হয়েছিলেন। খুঁজে পেয়েছিলেন সাহিত্যের এক অচেনা অজানা অভিমুখ। যেখানে মিলেছিল মননের পরিপূর্ণতা, তৃপ্ততা অসীম মুগ্ধতা। রূঢ় বাস্তবতা থেকে বেরিয়ে এসে পাঠক প্রকৃতার্থে বিচরণ করেছিল আপন মনের মেলে দেওয়া এক অচেনা অজানা ভালোলাগার ভাবজগতে।মৈত্রেয়ী দেবী বাঙালি পাঠক সমাজে সৃষ্টি করেছিলেন এক উন্মাদনা। সহজাত, সৃজনশীল, বলিষ্ঠ লিখনী ক্ষমতায় স্থান করেছিলেন তৎকালীন পাঠক কুলে।
১৯১৪ সালে ১ সেপ্টেম্বর ইংরেজ শাসিত বাংলার চট্টগ্রাম জেলায় জন্মগ্রহণ করেন মৈত্রেয়ী দেবী। পিতা সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত একজন দার্শনিক এবং প্রবন্ধকার আর মা হিমানী মাধুরী রায়। যদিও তার শৈশব কাটে বরিশালে, পিতার আদিনিবাস বরিশালের আগৈলঝারা গ্রামে। পরে পিতার কর্মক্ষেত্রের সুবাদে কৈশোরেই সপরিবারে চলে আসেন কলকাতার ভবানীপুরে। একদিকে পিতার আদর্শ আর অন্যদিকে তৎকালীন কলকাতার ‘এলিট’ সম্প্রদায়ের সাহচর্য, মৈত্রেয়ী দেবীর মননে আনে দার্শনিকতার ছাপ। ১৯৩৬ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগমায়া দেবী কলেজ থেকে দর্শনে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন।মাত্র ২০ বছর বয়সে ১৯৩৪ সালে কলকাতার ড. মনমোহন সেনের সাথে বিয়ে হয়ে যায় মৈত্রেয়ী দেবীর। দুটি সন্তানের জনক জননী হন এই দম্পতি। কাজের সূত্রে হিমালয় ঘেঁষা দার্জিলিং এর মংপুতে থাকতেন এই দম্পতি। মংপুতে সিনকোনা চাষের গবেষণায় ড. মনমোহন সেনের বিশেষ অবদান ছিল। রবীন্দ্রনাথের ভাবশিষ্য আর স্নেহে লালিত মৈত্রেয়ী দেবী কবিগুরুকে আমন্ত্রণ জানান মংপুতে বেড়িয়ে যাবার জন্য। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে মৈত্রেয়ী দেবীর আমন্ত্রণে চারবার অবকাশ যাপনের জন্য মংপুতে গিয়েছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এভাবেই বিশ্বকবির সঙ্গে মৈত্রেয়ী দেবীর গড়ে উঠেছিল এক নিবিড় মানবিক সৃষ্টিশীল বন্ধন। যেটা আমৃত্যু অটুট ছিল।মাত্র ষোল বছর বয়সে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উদারতা’ প্রকাশিত হয়। এই বইয়ের ভূমিকা স্বচ্ছন্দে লিখে দিয়েছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘চিত্তছায়া’।
মংপুতে কবিগুরুর থাকাকালীন সময়ে কবিগুরুর সাথে তার অন্তরঙ্গ কথোপকথন নিয়ে মৈত্রেয়ী দেবীর অনবদ্য গ্রন্থ ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’ ১৯৪২ সালে প্রকাশিত হয়। পাঠক সমাজে ব্যাপক সমাদৃত এ গ্রন্থটি ‘টেগোর বাই ফায়ারসাইড’ নামে ইংরেজিতে অনূদিত হয়। রবীন্দ্র বিষয়ক তার অন্যান্য বইগুলো হল ‘স্বর্গের কাছাকাছি’, ‘কবি সার্বভৌম’, ‘রবীন্দ্রনাথ গৃহে ও বিশ্বে’, ‘রবীন্দ্রনাথ: দি ম্যান বিহাইন্ড হিজ পোয়েট্রি’।মৈত্রেয়ী দেবীকে পাঠক সমাজে এক অনন্য স্থান এনে দেয় ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত তার এই আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। লেখিকার গভীর জীবনবোধ আর নিপুন দক্ষতায় ব্যক্তিগত প্রেমের কাহিনী, উপন্যাসে উপস্থাপিত হয়ে, তা হয়ে উঠেছে সর্বজনীন। তাই ‘ন হন্যতে’ বাংলা ভাষায় বহুল পঠিত স্মৃতিচারণমূলক এক অসামান্য উপন্যাস। ১৯৭৬ সালে এই বইটির জন্য তিনি সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বলা হয়ে থাকে যে, ‘ন হন্যতে’ একাডেমিক পুরস্কারপ্রাপ্ত একালের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। বইটি ইংরেজি ভাষায় ‘ইট ডাজ নট ডাই’ নামে অনূদিত ও প্রকাশিত হয়।
এছাড়াও ভারতের বিভিন্ন ভাষায় বইটি অনুবাদ করা হয়েছে। ১৯৭৭ সালে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ সম্মান ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত হন। সাহিত্য ছাড়াও সমাজসেবায় অনন্য অবদান রেখেছেন। মংপুতে রবীন্দ্রনাথ মৈত্রেয়ী দেবীর আমন্ত্রণে ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে চারবার গিয়েছিলেন। মংপুর সে দিনগুলোকে নিয়ে ১৯৪৩ সালে মৈত্রেয়ী দেবী বই লেখেন ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’। অসাধারণ জনপ্রিয়তার কারণে বইটি ইংরেজিতে অনুদিত হয় ‘টেগোর বাই ফায়ারসাইড’ নামে। রবীন্দ্র বিষয়ক তাঁর অন্যান্য গ্রন্থ: স্বর্গের কাছাকাছি, বিশ্বসভায় রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ গৃহে ও বিশ্বে, কবি সার্বভৌম, রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ দি ম্যান বিহাউন্ড হিজ পেয়েট্রি প্রভৃতি।
১৯৬১-তে রবীন্দ্র শতবর্ষে বক্তৃতা দেয়ার জন্য আমন্ত্রিত হয়ে তিনি সোভিয়েত রাশিয়া, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া ও গণতান্ত্রিক জার্মানিতে গিয়েছিলেন। ১৯৭৭ সালে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ সম্মাননা পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৯০ সালের ৪ফেব্রুয়ারি তিনি প্রয়াত হন । বাংলা সাহিত্যে মৈত্রেয়ী দেবী এখনো চিরভাস্বর। মূলত আত্মজৈবনিক ঔপন্যাসিক হিসাবে বাঙালি পাঠকসমাজে তার গ্রহণযোগ্যতা জনপ্রিয়তা অমলিন। বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী ছিলেন মৈত্রেয়ী দেবী। ক্ষুরধার শাণিত মননশীল সাহিত্য প্রতিভায় মৈত্রেয়ী দেবী বর্তমান বাংলা সাহিত্যে এক বিশিষ্ট নাম।
যতদিন বাংলা সাহিত্য চির জাগরুক, পঠিত, প্রশংসিত, সম্মানিত, বেঁচে থাকার রসদ হিসেবে গণ্য হবে ততদিন মৈত্রেয়ী দেবীর সাহিত্য সম্ভার পাঠক সমাজে চিরজাগ্রত, চির নবীন। পরিশেষে সাহিত্য পিপাসু, অনুরাগী হিসেবে কবি লেখক ঔপন্যাসিক মৈত্রেয়ী দেবীর ১০৮ তম জন্মদিনে তাঁর প্রতি রইল অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ভক্তি অফুরন্ত ভালোবাসা।