ধ্যানচাঁদদের জন্মদিন স্মরণ ও জাতীয় ক্রীড়া দিবস পালন

আমরা সকলেই অবগত ছোট বয়স থেকেই স্কুল পড়ুয়াদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য খেলাধুলোর প্রয়োজন ও গুরুত্ব অপরিসীম। এর কোনো বিকল্প নেই। সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপনের অন্যতম মাধ্যম ক্রীড়া বা খেলাধুলার অনুশীলন। এর মাধ্যমে সামাজিক মানবিক নিবিড় যোগবন্ধন গড়ে ওঠে। প্রতিটা দেশেই খেলাধুলার গুরুত্ব সর্বজনবিদিত। আমাদের ভারতেও জাতীয় ক্রীড়া দিবস বা ন্যাশনাল স্পোর্টস ডে সেলিব্রেট করা হয় হকির জাদুকর মেজর ধ্যান চাঁদের জন্মদিনকে স্মরণীয় করে রাখতে। শুধু ভারতেই নয়, সারা বিশ্বের হকি খেলোয়াড়দের মধ্যে সেরা হকি খেলোয়াড় হিসেবে ধরা হয় ধ্যানচাঁদকে। তাঁকে হকির জাদুকরও বলা হত।বিশ্ব হকিতেও তাঁর অবদান অতুলনীয়।
আজ সেই ২৯ আগস্ট। কারণ, এই দিনে জন্ম হকির জাদুকরের। পরাধীন অবিভক্ত ভারতবর্ষে ১৯০৫ সালের ২৯ আগস্ট এলাহাবাদে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা যেহেতু সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন, সেই সূত্রে ছেলেবলাতেই ঝাঁসিতে চলে আসেন ধ্যানচাঁদরা। তাঁর বাবাও সেনাদলে নিয়মিত হকি খেলতেন।ধ্যানচাঁদ ছেলেবেলায় চাননি যে, তিনি বড় হয়ে হকি খেলোয়াড় হবেন। বরং, খেলাধুলোর মধ্যে তিনি পছন্দ করতেন কুস্তিকেই। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই ধ্যানচাঁদ নিজেও সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। আর তাঁর হকি খেলা মোটামুটিভাবে শুরু সেখান থেকেই।১৯২৮ (আমস্টারডাম অলিম্পিকে তিনি ১৪ গোল করেছিলেন), ১৯৩২ এবং ১৯৩৬ সালের অলিম্পিক হকিতে সোনা জিতে হ্যাটট্রিক করে ভারতীয় দল। যাতে বেশিটাই অবদান ছিল ধ্যানচাঁদের।দেশের হয়ে অলিম্পিকের (১৯২৮, ১৯৩৪, ১৯৩৬) আসর থেকে তিনবার স্বর্ণপদক ছিনিয়ে এনেছেন ধ্যান চাঁদ। ১৯২৬-১৯৪৮ পর্যন্ত খেলে ৪০০-র ওপর গোল করেছেন তিনি। আন্তর্জাতিক আঙিনায় হকি স্টিক হাতে শুধু দেশের নামই বিশ্বের মানচিত্রে নিয়ে যাননি ধ্যান চাঁদ, বিশ্ব হকিতেও অবদান রেখেছেন। এমনকি জার্মানির অ্যাডলফ হিটলার তাঁকে জার্মানির হয়ে খেলার জন্য টাকার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।ধ্যানচাঁদের নাম কিন্তু আদৌ ধ্যানচাঁদ নয়। আসলে তাঁর নাম ধ্যান সিং। কিন্তু তিনি এতটাই নিজের খেলাটার জন্য সাধনা করতেন যে, রাতের বেলায়ও তিনি সমানে প্র্যাকটিস করে যেতেন। সেইজন্যই চাঁদ মিলিয়ে তাঁর সতীর্থরা ধ্যানের সঙ্গে চাঁদ জুড়ে দেন। আর ধ্যানচাঁদ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন ধ্যানচাঁদ নামেই। ক্রীড়া নৈপুণ্য, দক্ষতা, ক্ষমতা, আত্মসম্মান, বিবেক বোধের পাশাপাশি তিনি ছিলেন খাঁটি দেশপ্রেমিক।ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা যদি বিভোর হয় পেলে-মারাদোনা জাদুতে, অস্ট্রেলিয়া যদি মাথা নত করে ডন ব্র্যাডম্যানকে শ্রদ্ধা জানাতে, তবে ভারতবাসীর কাছে রয়েছে বিশ্বজয়ী এক অমূল্য রত্ন। মেজর ধ্যানচাঁদ। যাঁর প্রতিভা, হকির মাঠে অসংখ্য রেকর্ড এবং ব্যক্তিত্ব আজও ক্রীড়াবিদদের অনুপ্রেরণা জোগায়।দেশকে জগতসভার শ্রেষ্ট আসনে বসিয়েছেন একাধিকবার। হিটলারের সামনে যেমন মাথা নত করেননি তেমনি বুক ছাড়া খেলে বিপক্ষকে চমকে দিয়েছেন। কিংবদন্তি জাদুকর হয়ে উঠেছেন। হয়ে উঠেছেন দেশের সর্বকালের সেরা ক্রীড়াবিদ। তাঁকে সম্মান জানিয়ে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় তৈরি হয়েছে তাঁর মূর্তি।দেশের ক্রীড়াক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পুরস্কারই তাঁর নামাঙ্কিত। দ্রোণাচার্য, অর্জুন পুরস্কার দেওয়া হয় শ্রেষ্ঠ ক্রীড়াবিদদের। এ বছর থেকে রাজীব গান্ধী খেলরত্ন পুরস্কারের নাম বদলে হচ্ছে ধ্যানচাঁদ খেলরত্ন পুরস্কার। জাতীয় ক্রীড়া দিবসে ধ্যানচাঁদকে স্মরণ করার পাশাপাশি আমাদের দেশে সেই সমস্ত উদীয়মান, সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়দের তুলে আনতে হবে খেলাধুলার ময়দানে, তাদেরকে প্রতিভা বিকাশের ক্ষেত্রে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। তবেই জাতীয় ক্রীড়া দিবস পালনের তাৎপর্য ও প্রাসঙ্গিকতা। আসুন আমরা সবাই আমাদের আশেপাশে প্রতিশ্রুতিমান খেলোয়াড়দের চিহ্নিত করে, তাদেরকে উৎসাহিত করি রোহিত খেলোয়াড় হিসেবে নিজেদের মেলে ধরতে। করোনাকালে একদিকে যখন অদৃশ্য ভাইরাসের সংক্রমণে খেলাধুলা স্তব্ধ, মাঠগুলো খাঁ খাঁ করছে তখন জাতীয় ক্রীড়া দিবস তাৎপর্য ও প্রাসঙ্গিকতা কে গুরুত্ব গুরুত্ব দিয়ে সরকার প্রশাসনের পাশাপাশি আমাদেরও খেলাধুলার প্রয়োজন অনুভব করে বাঁচিয়ে রাখতে হবে খেলোয়াড়দের, খেলোয়াড়ী মানসিকতাকে । তবেই জাতীয় ক্রীড়া দিবস পালনের বিশেষত্ব ও সর্বোপরি ধ্যানচাঁদের জন্মদিন পালনের প্রাসঙ্গিকতা। পরিশেষে এই সঙ্কটকালেও আমাদের দেশ সদ্য অনুষ্ঠিত টোকিও অলিম্পিক থেকে সাতটি পদক জয় আমাদের ভারতবর্ষে মননে খেলাধুলার উচ্ছাস উন্মাদনা, আগ্রহ, চেতনাকে প্রচণ্ডভাবে ছড়িয়ে দিয়েছে।
পাভেল আমান : হরিহরপাড়া, মুর্শিদাবাদ, ভারত।