স্মরণে রমেশচন্দ্র দত্ত

বিশিষ্ট চিন্তাবিদ ও ঐতিহাসিক অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও মুক্তচিন্তক দেশপ্রেমিক, লেখক ও উপন্যাসিক এবং সর্বোপরি সুপন্ডিত ও নির্ভীক জীবনপ্রেমী রমেশচন্দ্র দত্ত ওরফে আর সি দত্ত।তিনি ১৮৪৮ সালে ১৩ আগস্ট কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁকে সশ্রদ্ধায় স্মরণ করি। প্রথাগত স্কুল শিক্ষা শুরু করেন এবং প্রথম স্থান অধিকার করায় ১৪ টাকার বৃত্তি লাভ করেন। ১৩৬৬ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফএ (First Arts) পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। প্রেসিডেন্সিতে বিএ পাশ করার পর তিনি ভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেয়ার সংকল্প করেন। পারিবারিক এবং সামাজিক বাধা পেরিয়ে ইংল্যান্ড পাড়ি দেন ১৮৬৮ সালে, সঙ্গী ছিলেন বন্ধু সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি ও বিহারীলাল গুপ্ত।
১৮৬৯ সালে আইএসসি পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হন এবং তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। শিক্ষানবিশীর পরীক্ষাতেও তিনি দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন এবং ‘বার’ এর জন্য যোগ্য বিবেচিত হন।
ভারতে কর্মজীবন শুরু করেন ১৮৭১ সালে সরকারি ম্যাজিস্ট্রেট পদে যোগদান করেন। নদীয়া, বাঁকুড়া, বালেশ্বর, বাকেরগঞ্জ, পাবনা, ময়মনসিংহ, বর্ধমান, দিনাজপুর ও মেদিনীপুরে তিনি ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট এবং উড়িষ্যায় প্রথম ভারতীয় হিসাবে বিভাগীয় কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর কর্মদক্ষতা প্রশংসিত হলেও ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক বৈষম্যের কারণে চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার নয় বছর আগেই তিনি অবসর নেন। বড় ভাইকে লেখা চিঠিতে তিনি জানান, ‘ইংরাজ সরকার তাঁর প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা না দেখানোয় তিনি অন্য উপায়ে দেশের স্বার্থে নিজের যোগ্যতা ও দক্ষতা কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেন। তিনি প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে যোগদান করেন এবং লেখা ও বক্তৃতা-বিবৃতি দ্বারা সরকারি নীতি সংশোধনের উদ্দেশ্যে ভাবত ও ইংল্যান্ডে জনমত গড়ে তোলায় ব্রতী হন। সুদক্ষ প্রশাসক রমেশচন্দ্রের সাহিত্যের প্রতি বিশেষ বুৎপত্তি প্রকাশ পায়। তিনি লেখার কাজকে তার ‘প্রথম প্রেম’ হিসেবে ব্যক্ত করেন।
তাঁর প্রথম লেখা Three years in Europe (১৮৭২), Bengal Peasantry (১৮৭৫) লেখায় ভারতের কৃষকদের খাজনা সংক্রান্ত সংশোধনী প্রবর্তনের স্বপক্ষে নির্দিষ্ট যুক্তি পেশ করেন। Bangali Literature (১৮৭৭) বাংলার সমকালীন সাহিত্যের পরম্পরা তুলে ধরেন পিতৃবন্ধু বঙ্কিমচন্দ্র তাঁক সাহিত্যের আঙ্গিনায় আহবান জানান এবং বঙ্গদর্শন পত্রিকায় লেখার অনুরোধ করেন।
রমেশচন্দ্র বলেন ‘বাংলা সাহিত্যের রচনাশৈলী তো কিছুই জানি না।’ উত্তরে বঙ্কিমচন্দ্র বলেন, ‘তোমার মত সংস্কৃতিবান মানুষ যা লিখিবে সেটাই হবে শৈলী।’ সেই শৈলী প্রকাশিত হলো তার লিখিত ঐতিহাসিক উপন্যাস (বঙ্গবিজেতা, মাধবী কঙ্কন, জীবন সন্ধ্যা ও মহারাষ্ট্র জীবন প্রভাত) ও সামাজিক উপন্যাস (সমাজ ও সংসারে)। সামাজিক উপন্যাসে তিনি সমালোচনা করলেন বিধবা বিবাহের এবং আগ্রহ প্রকাশ করলেন ভিন্ন বর্ণের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনে।
১৮৮৫ সালে তিনি বাংলায় ‘ঋগ্বেদ’ অনুবাদ করেন, যা তৎকালীন সমাজে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। এক অব্রাহ্মণের এই পবিত্র গ্রন্থের অনুবাদ রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ সমাজ এই কাজের জন্য দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ তাঁকে অকুন্ঠ প্রশংসা করেন। ১৮৯৮ সালে রামায়ণ এবং ১৮৯৯ সালে তিনি মহাভারত অনুবাদ করেন ইংরেজি ভাষায়।
এছাড়া তিনি রচনা করেন ইংরাজী পদ্যের গ্রন্থ ‘Lays of Ancient India‘(১৮৯৮), History of Civilisation in Ancient India, England India(১৮৯৭), Famine’s in India (১৯০০), Economic History of India (১৯০২).
অসামান্য পাণ্ডিত্যের তিনি ব্রিটিশ রাজত্বের শাসন ব্যবস্থার স্বরূপ, ভারতীয়দের স্বায়ত্ত শাসনের অধিকার প্রভৃতি বিষয়ে আলোকপাত করেন। ব্রিটিশ সরকারের অর্থনৈতিক প্রশাসনের সমালোচনাসহ ভারতীয় শিল্প ও কৃষির অবনতির মূল বিষয়গুলো তিনি বর্ণনা করেন।
চাকরি জীবনে অবসর গ্রহণের পর তিনি লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজে অধ্যাপনার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। তিনি সাতবার ইউরোপ ভ্রমণ ও ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করেছিলেন এক ঐতিহাসিক যুক্তিবাদী দৃষ্টিতে।
১৮৯৯ সালে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে যোগদান করেন এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। তৎকালীন ‘নরমপন্থী’ নেতাদের ন্যায় রমেশচন্দ্রের বিশ্বাস ছিল যে, ইংরাজ শাসন মূলত দেশের জন্য কল্যাণকর হলেও ইংরাজ শাসনের সংস্কার করা, জনমত গড়ে তোলা, প্রশাসনের সকল পর্যায়ে ভারতীয়দের অধিকতর নিযুক্ত করা বিশেষ প্রয়োজন।
তাঁর চাকরি জীবন সাহিত্যজীবন এবং রাজনৈতিক জীবন আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যথার্থ এই চিন্তায়কের জীবনাসান হয় ১৯০৯ সালে ৩০ নভেম্বর। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে মডার্ণ রিভিউ পত্রিকায় সিস্টার নিবেদিতা লিখেছিলেন —’ভবিষ্যতে মানুষের কাছে তিনি পাবেন পিতার সম্মান।’
মিতালী সরকার, অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত