২২শে শ্রাবণ: বাঙালি মননের এক হৃদয় বিদারক ও দুঃখের দিন

২৫ শে বৈশাখের মতো ২২শে শ্রাবণ ও আপামর বাঙালি মননের এক হৃদয় বিদারক, দুঃখের দিন। তবুও দুঃখের মাঝেই বাঙালি জাতিসত্ত্বার পথ প্রদর্শক, দিশারী হিসেবে তুমি আজও চির প্রতিভূ, মহামহিম। বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি, চেতনা, ঐতিহ্য, আবহমান ধ্যান ধারণা, লোকায়িত বিশ্বাস ও সর্বোপরি সমাজের চলমান দর্পণ সাহিত্যকে স্বতন্ত্র চিন্তাভাবনার বুনোট, সৃজনশীল, নান্দনিকতা, নিবিড় ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জীবন দর্শনের বহুমাত্রিক পটভূমিকায় বিশ্ব সাহিত্যের অঙ্গনে সসম্মানে, মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছিলেন। এক্ষেত্রে বলা যায় একা কুম্ভের ন্যায় আপন সহজাত প্রতিভা বলে বাংলা সাহিত্যকে করেছিলেন বিশ্বজনীন। তিনি যেন বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ, বিকশিত, প্রাণবন্ত, চিরায়ত করতে আজীবন নিবেদিতপ্রাণ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালির প্রাণের, কাছের ও সুখে দুঃখে সঙ্গী। বাঙালির নিঃশ্বাসে, বিশ্বাসে, নিরবধি পথ চলাতে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ যেন পরতে পরতে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। প্রবল অনুরাগ ও অকুণ্ঠ শ্রদ্ধার আসনে বাঙালির প্রাণে তাঁর অধিষ্ঠান। সুখে ও সংগ্রামে, বেদনা-দহনে—সর্বত্র তিনি!
তাঁর সৃষ্টি দিয়ে বাঙালির স্বদেশ ও সংস্কৃতির স্বরূপ-দর্শন। তাঁর চোখ দিয়েই বাঙালির বিশ্ববীক্ষা। বিপুল তাঁর রচনা, বিচিত্র তাঁর বিষয়। তিনি যেন সৃষ্টির জগতে এক মহাসাগর সহজে যার তল পাওয়া যায় না। তিনি যেখানে হাত দিয়েছেন সেখানেই ফলেছে রাশি রাশি সোনা। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, সংগীত, ভ্রমণকাহিনি, চিঠিপত্র, সমালোচনা, চিত্রকলা সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁর অনন্য সৃষ্টিতে। তিনি যেন প্রকৃতার্থে বহুমুখী প্রতিভার এক বিরলতম ব্যক্তিত্ব। রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুঞ্জয়ী। প্রতিটি বাঙালির প্রাত্যহিক জীবনে তুমি এখনো স্বমহিমায় বিরাজিত।
আকাশ জুড়ে শুনিনু ওই বাজে/ তোমারি নাম সকল তারার মাঝে ॥ সকল তারার মাঝে অত্যুজ্জ্বল তিনি। বাঙালির ‘আকাশভরা সূর্য তারা’ হয়ে ছিলেন। আজও ‘প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে।’ বাঙালির প্রতিটি আবেগ আর সূক্ষ্ম অনুভূতিকে স্পর্শ করে আছেন তিনি। বাঙালি যেন এখনো তার কালজয়ী সাহিত্য, সঙ্গীত, জীবন দর্শনের অনুগামী। আত্মার স্পন্দনে রক্ত ধারায় মিশে আছেন। আলোর অনন্ত উৎসটি রবীন্দ্রনাথ। তিনি চিরকালের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালীর আত্মপরিচয়। বাঙালি জাতির শাশ্বত অভিভাবক, কান্ডারি, মার্গদর্শক। তাঁর চিন্তাভাবনা, ধ্যান ধারণায় বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি, বাংলা সাহিত্যের উত্তরণ।
তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সঙ্গীতস্রষ্টা, নট ও নাট্যকার, চিত্রকর, প্রাবন্ধিক, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর সাহিত্য। তিনি হয়ে উঠেছিলেন দেশ কাল জাতি ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে এক বৈশ্বিক মানবপ্রেমিক ।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন পুরোদস্তুর একজন আধুনিক, সংস্কার মুক্ত, বিজ্ঞানমনস্ক, উদারচেতা, অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদি, বিশ্ব প্রেমের বার্তাবাহক ও পূজারী। তিনি চেয়েছিলেন ভাতৃত্ববোধ, বিশ্বজনীন সাম্য, সম্প্রীতি, ঐক্য, সংহতি, চিরায়ত শান্তির বাতাবরণ। ভাবতে অবাক লাগে আজকে যখন দেখি ক্ষমতাসীন সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল তাঁর চিন্তাভাবনা, দর্শন, জীবনাদর্শ, সৃষ্টিশীলতাকে বিকৃত করে রাজনৈতিক রং রং মিশিয়ে বিভাজনের প্রাচীর সৃষ্টি করছে। অথচ আমরা দেখেছি অন্যায়, শোষণ, নিপীড়ণ, বঞ্চনার, ধর্মীয় বিভাজন, বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তিনি গর্জে উঠেছেন। মানুষের সুখ শান্তি, নিরাপত্তার প্রাত্যহিক জীবনই ছিল তাঁর কাছে প্রাধান্য।
বর্তমান অস্থিরতার মুহূর্তে একদিকে যখন করোনা সংকটে মানুষ জেরবার ঠিক অন্যদিকে সমাজ ও দেশ জুড়ে উগ্র হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির আস্ফালন। মনুষ্য মাঝে নেমে এসেছে জোড়া বিপর্যয়। আসুন আমরা সবাই জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মনুষ্য চেতনায় বাঙালি আবেগে প্রাণিত হয়ে প্রয়াণ দিবসে আরো বেশি আঁকড়ে ধরি রবীন্দ্রনাথের আদর্শ, জীবন দর্শন। সেখানেই আমাদের সংকটমোচন।
পাভেল আমান: হরিহর পাড়া, মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত