চিত্রশিল্পী ও কথাসাহিত্যিক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস কী কী

বাংলার শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পী, কথাসাহিত্যিক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি ১৮৭১ সালের ৭ আগস্ট কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে তাঁর জন্ম। তাঁর বাবা গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৮৭৬ সালে নর্মাল স্কুলে অবনীন্দ্রনাথের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়। তারপর কিছুদিন তিনি সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়ন করেন, কিন্তু এন্ট্রান্স পরীক্ষার পূর্বেই কলেজ ত্যাগ করেন (১৮৯০)। পরে তিনি নিজ চেষ্টায় ইংরেজি, ফরাসি, সংস্কৃত ও বাংলা ভাষা-সাহিত্য এবং সঙ্গীতে দক্ষতা অর্জন করেন।
ছোটবেলা থেকে আকাঁজোকা প্রতি ছিল ব্যাপক আগ্রহ। তিনি প্রথমে পাশ্চাত্য এবং পরে প্রাচ্য রীতিতে ছবি আঁকেন। ইতালিয়ান গিলার্ডি, ইংরেজ পামার, জাপানি টাইকান প্রমুখ চিত্রশিল্পীর নিকট তিনি চিত্রাঙ্কন বিষয়ে শিক্ষালাভ করেন। তবে ভারতীয় চিত্ররীতিতেই তিনি সমধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন এবং তাঁর হাতেই ভারতীয় শিল্পকলা নতুন প্রাণ পায়। ‘নির্বাসিত যক্ষ’, ‘ভারতমাতা’ ও ‘সাজাহানের মৃত্যু’ তাঁর অমর শিল্পকীর্তি। Indian Society of Oriental Art (১৯০৭) তাঁরই উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়। লন্ডন, প্যারিস ও জাপানে তাঁর চিত্রকর্মের প্রদর্শনী হয়।
তিনি ১৮৯৮ সালে কলকাতার আর্ট কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। দীর্ঘকাল এ পদে দায়িত্ব পালনের পর ১৯২১ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বাগেশ্রী অধ্যাপক নিযুক্ত হন এবং ১৯৪২ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। বাংলা ভাষা নিয়ে আন্দোলন, বিদেশি পোশাক বর্জন, রাখিবন্ধন উৎসব, স্বদেশী শিল্পের উন্নয়ন ইত্যাদি জাতীয় কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন।
চিত্রশিল্পীতে তিনি খ্যাতিমান হয়ে ওঠলেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ অবনীন্দ্রনাথের বিশেষ একটি গুণ দেখে মুগ্ধ হলেন। সেই গুণটা হলো অবনীন্দ্রনাথ নানাবিধ বানানো গল্প দিয়ে ছোটদের আবিষ্ট করে রাখতে পারতেন। একদি এই দেখে রবীন্দ্রনাথ ডেকে বলেন, ‘অবন, তুমি লেখো না কেন? যেমন করে মুখে মুখে গল্প বানিয়ে ছোটদের বলো, তেমন করেই লেখো।’
অবনীন্দ্রনাথ বললেন, ‘আমি কি আর লিখতে পারব, বানানটানানের ঠিক নেই।’ রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘সে আমি দেখে দেব, তুমি লেখো।’
অবনীন্দ্রনাথ বললেন, ‘আমি কি আর লিখতে পারব, বানানটানানের ঠিক নেই।’ রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘সে আমি দেখে দেব, তুমি লেখো।’
এভাবেই শুরু হলো বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য কথনরীতি, একেবারে আনকোরা ঝরঝরে এক ভাষাভঙ্গি। লেখালেখির ভুবনে আবির্ভূত হলেন আরেক ঠাকুর, ছবির মতো গল্প লিখে যাওয়া অবন ঠাকুর। লিখেন শকুন্তলা (১৮৯৫), ক্ষীরের পুতুল (১৮৯৬), রাজকাহিনী ও ভারতশিল্প (১৯০৯), বাংলার ব্রত (১৯১৯), খাজাঞ্চির খাতা ও প্রিয়দর্শিকা (১৯২১), চিত্রাক্ষর (১৯২৯), বাগেশ্বরী শিল্প (১৯৪১), জোড়াসাঁকোর ধারে (১৯৪৪), সহজ চিত্রশিক্ষা (১৯৪৬), ৪ খন্ডে প্রকাশিত অগ্রন্থিত অনেক গল্প (১৯৪৬), আপনকথা (১৯৪৬), ভারতশিল্পের ষড়ঙ্গ (১৯৪৭), আলোর ফুলকি (১৯৪৭), ভারতশিল্পে মূর্তি (১৯৪৭), শিল্পায়ন (১৯৫৫), কিশোর সঞ্চয়ন (১৯৬০), বাদশাহী গল্প (১৯৭৬) ইত্যাদি।

তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলো সর্ম্পক জেনে নিই
শকুন্তলা (১৮৯৫)
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম বই। সংস্কৃত সাহিত্য অবলম্বনে লেখা এই শকুন্তলা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাল্য গ্রন্থাবলী প্রকাশে উদ্যোগী হলে তাঁরই অনুরোধে অবনীন্দ্রনাথ শকুন্তলা রচনা করেন। এই বই রচনাকালে রবীন্দ্রনাথ অবনীন্দ্রনাথকে অভয় দিয়ে বলেছিলেন, “তুমি লেখই-না, ভাষার কিছু দোষ হয় আমিই তো আছি।”
ক্ষীরের পুতুল (১৮৯৬)
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা অন্যতম সেরা উপন্যাস। দীপনগরের রাজার দুই রানি ছিল, একজন সুয়োরানি এবং অন্যজন দুয়োরানি। রাজা সুয়োরানিকে ৭টা প্রাসাদ, ৭০০ পরিচারিকা, ৭ রাজ্য থেকে সেরা অলঙ্কার, ৭টা উদ্যান এবং ৭টা রথ উপহার দিয়েছিলেন। তিনি দুয়োরানিকে অবহেলা করেছিলেন এবং তাকে একটা ভাঙা ঘর, একটা বধির ও বোবা দাসী, ছেঁড়া পোশাক এবং নোংরা বিছানা দিয়েছিলেন। সাথে দিয়েছিলেন একটি মায়াবী বানর ছানা। আর সেই নিয়েই গল্প।
রাজকাহিনী (১৯০৯)
টডের রাজপুত্দের কাহিনি অবলম্বনে মধ্যযুগীয় রাজপুত রাজাদের বীরত্ব, ত্যাগের কাহিনি। টডের গল্প প্রেরণা হলেও রাজকাহিনিকে রূপ্ রেখা দিয়েছেন অবনীন্দ্রনাথ নিজের মতো করেই।
নালক (১৯১৬)
‘নালক’ হল গৌতমবুদ্ধের গল্প। দেবলঋষি যোগে বসেছিলেন। ছোট্ট ছেলে নালক ঋষির সেবা করছিল। এমন সময় অন্ধকারে আলো ফুটল। চাঁদের আলো নয়, সূর্যের আলো নয়, সমস্ত আলো মিশিয়ে এক আলোর আলো। সন্ন্যাসী নালককে বললেন, কপিলাবস্তুতে বুদ্ধদেব জন্ম নেবেন। আমি চললাম। একলা নালক চুপ করে বসে রইল বটতলাতেই। তার ধ্যানমগ্ন চোখের সামনে ফুটে উঠতে লাগল বুদ্ধের সারা জীবনের ছবি। একের পর এক।
বুড়ো আংলা (১৯৪১)
নাম রিদয়, কিন্তু ছেলেটা আসলে ছিল হৃদয়হীন। তার উপর যাকে বলে একেবারে বিচ্ছু ছেলে। নষ্টামি করেই দিন কাটত তার। মানুষ বলো, পশুপাখি বলো, কীটপতঙ্গ বলো – সব্বাই অতিষ্ট তার জ্বালাতনে। একদিন সেই বিচ্ছু রিদয় লাগল গণেশঠাকুরের পিছনে। আর যাবে কোথায়! ভীষণ রেগেমেগে গণেশঠাকুর তাকে এমন অভিশাপ দিলেন যে, দেখতে-না-দেখতে বুড়ো আঙুলের মতো ভয়ানক ছোট হয়ে শেষাবধি বুড়ো আংলা যক হয়ে গেল রিদয়। — তাই নিয়েই এই উপন্যাস, ‘বুড়ো আংলা’। লেখকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।
বাংলার এই চিত্রশিল্পী ও কথাসাহিত্যিক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আজ ১৫০তম জন্মদিনে জানাই শ্রদ্ধা ও অকুণ্ঠ ভালোবাসা।